Wednesday, July 25, 2012

পুরনো কথা (১)

আজকের ‘পুরনো কথা’: ‘সুখ-শাড়ি -- দিদিমণি’ (১/৮/১১, সকাল ১০:৩৬)
ছবি: সুনন্দ
ক্লাস এইট থেকে যখন ক্লাস নাইনে উঠেছিলাম তখন প্রথম নিয়মিত শাড়ি পরা অভ্যেস করতে হয়েছিল। তার আগে পর্যন্ত আমরা টিউনিক পরে স্কুলে যেতাম। অফুরন্ত স্বাধীনতা ছিল। হয়তো ততদিনই ছোট ছিলাম। স্কুলে ছুটোছুটি করতাম, কাবাডি খেলতাম, ‘বুড়িচ্চু’, ‘গোল্লাছুট’- আরও কত কি! ক্লাস নাইনে শাড়ি পরে স্কুলে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক ছিল। ক্লাস নাইনের দিদিদের শাড়ি নিয়ে হয়রানি দেখে ক্লাস এইটের শেষের দিকে ক্লাস টিচারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-শাড়ি কেন দিদিমণি? চুড়িদার নয় কেন?” দিদিমণি হয়তো নিজেও সঠিক জানতেন না। তাই ঠিক উত্তর দিতে পারেননি। বলেছিলেন মেয়েদের শরীরের গঠনটা এমন যে একটা সময়ের পর শুধু শাড়িতেই সেটা সঠিক মানায়। অন্য পোষাকে বেমানান লাগে।
অচিরেই নাইনে উঠে শাড়ি পরে স্কুল যাওয়া শুরু করতে হল।
প্রথমদিন খুব উত্তেজিত ছিলাম, আনন্দও হচ্ছিল। শাড়ি পরাটা এর আগে একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল কারণ শুধুমাত্র সরস্বতী

পূজোয় এবং অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার সময় শখে শাড়ি পরতাম। একদম কম বয়সে আমার জন্য মা একটা ছোট শাড়ির ব্যবস্থাও করেছিলেন। যাইহোক, এরপর তো শুরু হল এক পর্ব। আমরা অনেকেই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম ধাক্কাটা খেলাম শাড়ি পরে সাইকেলে উঠতে গিয়ে। নতুন শাড়ি কড়কড়ে হয়ে আছে। একবার সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতেই গোড়ালির কাছে পাড়ের কাপড় সোজা হাঁটুর ওপর। একহাতে হ্যান্ডেল ধরে অন্যহাতে সেই কাপড় নামানোর চেষ্টা করছি। আঁচল ততক্ষণে হাওয়ায় পাল তুলেছে। রাস্তায় যেসব ছেলেরা রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় আওয়াজ দিত তাদের সেদিন মস্তি। লজ্জায় লাল হয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকে তারপর নিঃশ্বাস নিলাম।গিয়ে দেখলাম আমারই মত অবস্থা বাকিদেরও। তাও কেউ কেউ খুব গুছিয়ে শাড়ি পরেছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ শাড়ি পরত চিত্রলেখা। বেচারির বাড়িতে বাবা ছাড়া কেউ ছিলনা। ফলে অপটু হাতে নিজেই ধরে বেঁধে শাড়ি পরত। ও যেভাবে শাড়ি পরত তাতে মানান- বেমানানের যে যুক্তিটা ক্লাস এইটে দিদিমণি দিয়েছিলেন তার যৌক্তিকতা পেতাম না। এখানেই শেষ নয়, পরবর্তী যন্ত্রণা প্রকৃতির ছোট-বড় ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে। বিস্তারিত বিবরণ থাক, শুধু বলি, সে trauma আজও কাটেনি।
সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে পড়তাম যেদিন রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে বৃষ্টি নামতো। কেউ শাড়ি পরে কাকভেজা হয়ে স্কুলে ঢুকলে তাকে আমরা রাম তেরি গঙ্গা ম্যায়লিমন্দাকিনীর মত লাগছে বলতাম। নিজেরাই! রাস্তার ছেলে-ছোকরারা না জানি কি বলতো!
এইভাবে অনেকদিন কেটেছে, আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গেছে বিরক্তিটা। কলেজে উঠে রেহাই পেলাম। কিন্তু কৈশোরের  অনেকটা আর ফিরে পেলাম না। আর কাবাডি খেলা হল না, বুড়িচ্চু, গোল্লাছুট, ছোঁয়াছুঁয়ি-ঐ শেষ খেলেছি ক্লাস এইটে। কলেজে উঠে আর বয়স বা ইচ্ছে কিছুই বাকি ছিল না।
ছবি: সুনন্দ
তারপরের পর্ব টিচার হয়ে স্কুলে। আবার সেই শাড়ি। বাসে করে ডেলি প্যাসেঞ্জারি। বাসে গাদাগাদি ভিড়, ভিড়ের মধ্যে কেউ বেরোতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত ভাবে আঁচল টেনে নিয়ে এগিয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার- আরে,আরে,করেন কি? করেন কি?’ ততক্ষণে বেচারা সেফটি-পিন টানাটানি সহ্য করতে না পেরে হার স্বীকার করেছে। কোনরকমে গন্তব্যে পৌঁছে হাত দিয়ে আঁচল চেপে ধরে বাস থেকে নামা। এরপর কখনো কখনো স্কুলে পৌঁছতে রিকশো বা ভ্যানে উঠতে গিয়ে ফড়া-আ-ৎ। রিকশো থেকে বেরিয়ে আসা কোন পেরেকে শাড়ি ছিঁড়ে কুপোকাৎ। স্কুলে পৌঁছে কর্মশিক্ষার দিদিমণির কাছ থেকে সুঁচসুতো চেয়ে সেলাই করতে বসতাম। ভ্যানে করে যাচ্ছি, পাশ দিয়ে অসতর্কে যাওয়া সাইকেলওয়ালা শাড়ি ছিঁড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল। স্টাফরুমে ঢুকে চ্যাঁচামেচি করতাম। সাহস করে চুড়িদার পরিনি তাও। বড়রা একটা গল্প বলত। চন্দ্রাদি একবার চুড়িদার পরে আসায় ওকে কি পরিমাণ অপমান সহ্য করতে হয়েছিল সেই জুজুর গল্প। গ্রামের লোকম্যানেজিং কমিটির সভ্য(পড়ুন অসভ্য), বয়স্কা দিদিমণি, বড়-দিদিমণি সব্বাই ক-ও-ও-ত্ত বড় বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন চন্দ্রাদিকে শাড়ি পরতে বাধ্য করিয়ে- সেই গল্প। চন্দ্রাদি হার স্বীকার করে শাড়িই পরে আসতো। তবে ওর ব্লাউজ গুলো ছিল ভারি অদ্ভুত। ছেলেদের শার্টের মত করে ব্লাউজ বানাতো। যাতে দেহের কিছু খোলা অংশের দিকে জনগণের অবাধ তাকানোর অধিকারকে খর্ব করা যায়।
ইতিমধ্যে এল হাইকোর্টের রায়। যা যা জলঘোলা হয়েছে তার মোটামুটি সবই আপনাদের জানা। তাই এ নিয়ে কিছু আর বললাম না। আমরা শুধু কয়েকজন চুড়িদার পরতে শুরু করলাম। শাড়ি পরলাম শখে। সত্যি বলছি বৃষ্টির দিনে যে কি সুবিধে হল! যারা জানেন তারা বুঝলেন নিশ্চয়ই। রাগ হল অনেকের। কিন্তু কেউ কিছু বলার আর সাহস পেল না।
তারপর স্কুল বদলে জেলার পাড়াগাঁয়ের স্কুলের দিদিমণি এল খাস কলকাতায়।ওখান থেকে আসার সময় কলিগরা বলেছিল, ‘দেখ ওখানে গিয়ে তোকে আবার না এক ঝক্কি নিতে হয়। তাই হল। প্রথম দিনই প্রধান শিক্ষিকা ওঁর বিধান জানিয়ে দিলেন, “শাড়ি পরে আসতে হবে। বেশ, হবেখন।
আরেকটু বিরক্তি চাপতে হবে তো, আরেকবার? সে আর এমন কি বড় ব্যাপার- অভ্যেস তো আছেই। রোদ-জল-বৃষ্টি-ঝড়, জ্যাম, গাড়ি, ভিড়, সব ঠেঙিয়ে আবার শাড়ি। রোজ মনে হয়, চুড়িদার পরে চলে যাই, কি আর হবে? কি আর বলবেন? অঞ্জনাদি তো পরে চুড়িদার। ও-ও তো চাকরি করছে। কিন্তু নিজের চোখেই তো দেখেছি অঞ্জনাদি কোথায় অন্যদের থেকে আলাদা, বা কোথায় কোথায় বড়দির ব্যবহার ওর সাথে আলাদা। একটা ছোট্ট উদাহরণ মনে পড়ছে, আমরা তিনদিন লেটে এলে একটা casual leave নষ্ট হয় (প্রাপ্য ছুটি একটা কমে যায়), তাই দুএক মিনিট দেরিতে কেউ এলে বড়দি মায়া করে তার খাতায় আর লাল কালি দেননা। অঞ্জনাদির বেলায়? বুঝতেই পারছেন... থাক না, নিজে একটু compromise করলে যদি উনি না চটেন? Boss যখন, চটিয়ে লাভ কি? তাছাড়া ওঁকে অমান্য করে চুড়িদার পরে গেলে গুরুজন হিসেবেও তো অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়।
এভাবেই হয়তো চলবে। যতদিন না সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। সহ্যের সীমা কোনটা? এই ধরুন, অসহ্য গরমে স্কিনের সমস্যা হচ্ছে বলে দুদিনের জন্য চুড়িদার পরার অনুমতি চাইলাম, দিলেন না। বর্ষায় একদিন পুরো ভিজে, ভেজা শাড়ি নিয়ে বসে থাকলাম শেষ অবধি, ছাড়লেন না। তার পরদিন চুড়িদার পরে যাওয়ায় চোখের চাহনিতে বুঝিয়ে দিলেন তিনি কতটা অসন্তুষ্ট। ভয়ে ভয়ে আবার ব্যাক টু শাড়ি।
আমার এগারো-বারো ক্লাসের ছাত্রীরাও শাড়ি পরে। অসহ্য গরমে বা প্যাচপেচে বর্ষায় ওদের অবস্থা দেখি আর নিজের পুরনো কথা মনে পড়ে। হয়তো ওরাও যখন আমার মত কোন স্কুলে শিক্ষিকা হয়ে ঢুকবে তখন এই অবস্থা ওদের সহ্য করতে হবেনা, বিরক্তি চাপতে হবেনা, অসুবিধে পোহাতে হবেনা, কারণ ততদিনে আমি ও আমার মত অনেকে ছবিটা পাল্টে ফেলেছি।
সত্যিই পারব তো, পাল্টাতে?

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই