Thursday, August 4, 2011

বলার মত কিছু নয় -- ইচ্ছেডানা

ছবির উৎস: লিঙ্ক

বৃষ্টি-ভেজা বিকেলে বারিস্তায় বসে গরম গরম আমেরিকান কফিতে চুমুক দিচ্ছি। শহর মুম্বাই, স্থান প্রসিদ্ধ (বা এখন খানিকটা ভীতিপ্রদ)
তাজ হোটেলের পেছনের কোলাবা মার্কেট। মুম্বাইয়ের এই এলাকায় বিদেশীদের আনাগোনা প্রায়ই  চোখে পড়ে। এখনো পড়ছে। বারিস্তার কাঁচের দেয়াল দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে হঠাৎ অনতি-দূরে চোখে পড়ল একটি বছর দশেকের মেয়ে, নোংরা তার পোশাক,
নোংরা তার হাত আর তাতে সে ধরে আছে এক গুচ্ছ ফুলের মালা  (মারাঠীরা যাকে বলে গাজরা)। সে কাকে জানি ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা করছে। মনে হল বলতে চাইছে "মাত্র পাঁচ টাকা, খিদে পেয়েছে, খাব "। কৌতূহল জাগতে আরো একটু উঁকি দিয়ে দেখি মেয়েটি এক বিদেশিনীকে একটি মালা বেচার চেষ্টা করছে আর বিদেশিনী ভারি বিপদে পড়ে তাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছে। দৃশ্যটি খুব অপরিচিত নয়। তাই চোখ ফিরিয়ে আবার বৃষ্টি দেখতে শুরু করলাম। খানিক পরে চোখ আবার গেল মেয়েটির দিকে। নাহ, বিদেশিনীর আজ কপাল খারাপ। মেয়েটি তাকে বেশ কোণ ঠাসা করেছে। এখনো সে ছাড়া পায়নি। মনে মনে একটু হাসলাম। আবার রাস্তার দিকে নজর দিলাম।
বারিস্তার সামনেই ফুটপাথে একটি বড় (এবং নিঃসন্দেহে দামী) গাড়ি এসে থামল। বৃষ্টি এখনো পড়ে চলেছে ঝিরিঝিরি করে। কফি প্রায় শেষ। বৃষ্টিতে বেরোব কিনা ভাবছি এমন সময় সেই গাড়ি থেকে একটি যুবক, ভারতীয় (যদিও পোশাকে আশাকে পুরোটাই "Branded "), নেমে এসে সেই মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল। pocket থেকে একটি একশটাকার নোট বের করে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিল আর বিদেশিনীকে ইশারায় চলে যেতে বলল। বিদেশিনী তার এই আকস্মিক মুক্তিতে খুশি হয়ে একটি মিষ্টি হাসি যুবকটিকে উপহার দিয়ে পাশ কাটিয়ে মিশে গেল ভিড়ে। ছেলেটি আবার গাড়িতে গিয়ে উঠলো আর সেই নোংরা মেয়েটি সেই একশ টাকার নোটটি আকাশে দুলিয়ে হাসি মুখে কাকে জানি দেখাতে লাগলো। ভাবলাম নাটকের যবনিকা পতন হলো বুঝি। আর সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি নাটকে এরই মধ্যে আরেকটি চরিত্রের উদয় হয়েছে। অনুমানে মনে হয় সেই মেয়েটির মা। ছেলেটির গাড়ির কাঁচ নামানো আর মেয়েটির মা হাসি মুখে গাজরার থোকাটা ওই ছেলেটির গাড়ির ভেতর লাগিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটি আর বিলম্ব না করে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল আর যাবার আগে ওই ছোট মেয়েটির হাতে সেই থোকা থেকে একটি মালা দিয়ে গেল। বারিস্তা থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম মেয়েটির মা সেই একশ টাকাটি নিয়ে চলে যাচ্ছে আর আমার সামনে ফুটপাথে বসা সেই মেয়েটি, হাতে তার ধরা একটি ফুলের মালা, আনমনে সে নতুন হিন্দী ছবির একটি গান গুনগুন করে গেয়ে চলেছে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো "ছেলেটি আসলে কার উপকার করে গেল?" 
ছবির উৎসঃ লিঙ্ক

সেই বিদেশিনীর যে কিনা ভারতবর্ষের মত পবিত্র স্থান দর্শন করতে প্রায় অপবিত্র হয়ে যাচ্ছিল একটি অস্পৃশ্য মেয়ের ছোঁয়ায়? নাকি সেই অস্পৃশ্য মেয়েটির- যে কিনা সারাদিন রোদে জলে ঘুরেও একশটি টাকা উপার্জনের কথা স্বপ্নেও ভাবে না!  ছেলেটির এই উদারতায় আজকের মত হয়ত সে ছুটি পেল, আজকে হয়ত এই মিষ্টি বিকেলে তাকে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে লোককে বলতে হবে না "বাবু, একটা মালা নিন, খিদে পেয়েছে, খাব"। আজ হয়ত সেও তার অবশিষ্ট বাল্যকালের কিছুটা সময় বালক-সুলভ(বালিকা-সুলভ?) আচরণ করেই কাটাতে পারবে। নাকি ছেলেটি আজ এই পোড়া অভাগা দেশ ভারতবর্ষেরই কিছুটা উপকার করে দিয়ে গেল? সে কি এক ভিন-দেশীকে জানিয়ে গেল যে ভারতবর্ষের সকলেই "এমন" নয়? খিদে-জ্বালায় নিপীড়িত ভারতবর্ষের এই চিত্র তার এই আচরণে সে কি মুছে দিতে চাইল সেই বিদেশিনীর মন থেকে? জানিয়ে দিতে চাইল কি যে ফিরে গিয়ে এই অভাগা দেশের এই মর্মান্তিক ছবি যেন সে বিশ্ব-জগতের কাছে না তুলে ধরে

আকাশ আবার কালো হয়ে আসছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম বাসস্টপের দিকে। মনে মনে ভাবলাম "এমন তো আকছারই হয় আমাদের দেশে। এতে এত ভাবার বা এটা নিয়ে এত কিছু বলার আর কি আছে"।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই