Monday, August 15, 2011

তবু ভাল লাগে... -- দিদিমণি

ছবি: সুনন্দ

স্কুলের চাকরীতে ঢুকেছিলাম এক দোটানায় পড়ে। উচ্চশিক্ষা বনাম চাকরীর নিরাপত্তা- এই টানাপড়েন নিয়েই পাড়াগাঁয়ের স্কুলের
দিদিমণি হলাম। যে স্কুলের শিক্ষিকা হলাম তার চেহারা, পরিবেশ আমি যে স্কুলের ছাত্রী ছিলাম তার থেকে একেবারেই আলাদা। এর আগে গাঁয়ের স্কুলের চেহারাটাই পরিষ্কার ছিল না আমার কাছে। বাসরাস্তা থেকে প্রায় দুকিলোমিটার দূরে স্কুল। স্কুলে পৌঁছনোর জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় কিছু পাওয়া যেতনা। স্কুল বিল্ডিংটা এক মজা নদীর ধারে। ওপারে বাংলাদেশ। নদীটাই এখানে সীমান্ত। এপারে B.S.F ওপারে B.D.R-  স্কুলে যাতায়াতের পথে সবসময় চোখে পড়ত। স্কুল বিল্ডিং পাকা তবে রঙ করা বা সিমেন্ট পালিশ নেই। ক্লাসরুম গুলোতে দরজা-জানলা আছে কিন্তু পাল্লা নেই; বৃষ্টি-রোদ তাই কিছুই আটকায় না। ক্লাস চলার সময় বৃষ্টি এলে মেয়েরা ক্লাসের মাঝখানে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দিদিমণিরা ক্লাস ছেড়ে স্টাফরুমে চলে আসেন। সেখানেও ফাঁক-ফোকর দিয়ে জল ঢুকে ঘর ভেসে যায়। বাথরুম আছে তবে প্রয়োজনের তুলনায় পরিমাণ আর পরিচ্ছন্নতা দুটোই অপ্রতুল। বাথরুমের অবস্থা টিফিনের পর এত ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে আশেপাশের ক্লাসরুমগুলোতে পঞ্চম পিরিয়ডে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসবে বলে মনে হয়। দুজন বয়স্কা সাফাইকর্মীর (যারা পাকাপাকি ভাবে আমৃত্যু কাজ করে যাবেন, তাঁদের আর্থিক প্রয়োজনে ও স্কুলের ফান্ড থেকে সাফাই বাবদ ন্যূনতম খরচ হচ্ছে বলে) এ সময় নাভিশ্বাস ওঠে- জল ও ফিনাইল ঢালতে ঢালতে। স্কুলে জলের ব্যবস্থা বলতে একটা টিউওবয়েল পনেরোশ মেয়ের জন্য- গরমকালে টিউবওয়েল থেকে জল ওঠেনা। (কিছুদিন আগে অবশ্য জলের ব্যবস্থা হয়েছে।)

ছবির উৎস: লিঙ্ক

স্কুলে electricity আছে কিন্তু প্রতিদিন লোড-শেডিং হয় এবং একবার ‘current’ গেলে আবার কখন আসবে কেউ বলতে পারেনা। ঝড়-বৃষ্টি হয়ে থাকলে দুতিন দিন electricity থাকেনা। পায়রার খুপরির মত আলো-বাতাসহীন ঘরগুলোর প্রত্যেকটাতে প্রায় একশোজন করে ছাত্রী বসে। অনেকক্ষণ current না থাকলে ভ্যাপ্সা, দমবন্ধ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পড়ানো ও পড়া দুটোই অসম্ভব হয়ে ওঠে। ছাত্রীদের অবস্থা তখন আউশুইৎজএর ইহুদিদের মত। স্কুলে libraryর নামে যা আছে তা হল তালাবন্ধ তিনটে কাঠের আলমারি। Laboratory হল একটিমাত্র মানুষের কঙ্কাল, কয়েকটি ম্যাপ ও চার্ট। ব্যস্‌।
সত্যিটা স্বীকার করতে দোষ নেই। প্রথম প্রথম নাক সিটকোতাম। তারপর M.A. পড়া ছেড়ে আসার দুঃখ। কলিগরা প্রায় মায়ের বয়সী এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগ শাসনও করেন মায়ের মত। খুব খারাপ অবস্থা হল।
ছবির উৎস: লিঙ্ক

কিন্তু বিশ্বাস করুন, সেই জায়গাটা ছেড়ে যখন বেরোচ্ছি পরদিন অন্য স্কুল জয়েন করবো বলে, তখন খুব কষ্ট পেয়েছি। ওই স্কুল ছেড়েছি স্কুল অপছন্দ বলে নয়, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। খারাপ লাগার জায়গা অবশ্যই কিছু ছিল কিন্তু স্কুলটার সঙ্গে জড়িয়ে গেছিলাম মেয়েদের মধ্যে নিজের স্কুলজীবনের ছবি অনেকটা খুঁজে পেয়ে। স্কুলে যতক্ষণ ওদের সঙ্গে থাকতাম, অন্য সব কিছু ভুলে যেতাম। ওরা কতটা আমাকে ভালবেসেছিল এখন ওদের থেকে দূরে এসে আরও বেশী করে বুঝি। ওই স্কুলে শেষদিন কেউ জিজ্ঞেস করেছিল- ম্যাডাম, আমাদের মনে রাখবেন তো?” কেউ বলেছিল, “ম্যাডাম, আবার আসবেন তো?” কেউ কেউ এখনো ফোন করে, খোঁজখবর নেয়, পড়ার বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করে। পড়ায় মন বসছেনা বলে কি করবে জানতে চায়। নিউ ইয়ার, রাখী, টিচার্স ডে, সরস্বতী পুজো, স্পোর্টস- এইসব অনুষ্ঠানে ওরা ওদের মত করে যথেষ্ট চেষ্টা করতো দিদিমণিদের নিজেদের ভালবাসার জানান দিতে। ওদের দেওয়া উপহারগুলো ছিল খুব অদ্ভুত - কাশ, শালুক, কদম, বকফুল, আবার পেয়ারা, আমড়া, কামরাঙা, খাগের কলম, আরও কত কি! আমার এখানকার স্কুলের ছাত্রীদের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কিন্তু যাদের ফেলে এসেছি, তাদের কথা খুব মনে পড়ে। বাবা-মার যেমন দুর্বল সন্তানের প্রতি বেশি টান থাকে, এক্ষেত্রেও হয়তো ব্যাপারটা সেই রকমই।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই