Monday, August 22, 2011

তোমরা যে বল দিবস রজনী -- দিদিমণি

আমরা যারা মফঃস্বল শহরে পড়াশুনা শুরু করেছি তারা বেশির ভাগই co-education এর অভিজ্ঞতা লাভ করেছি কলেজে ভর্তি
হওয়ার পর। তার আগে পর্যন্ত সমবয়সি বিপরীত লিঙ্গের প্রাণ গুলির সাথে মেলামেশার সুযোগ মিলত খুব কম- কোন স্যারের কোচিং ক্লাসে, সরস্বতী পূজোয়, অষ্টমীতে, বইমেলায় বা স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা স্পোর্টসের মাঠে। আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন তো অর্কুট বা ফেসবুকের চল ছিল না, মোবাইলে এসএমএসিং ও ছিল না তাই ঐসব জায়গা গুলোই

ছেলেমেয়েদের কথা বলার কয়েকটি অজুহাত ছিল। বলাবাহুল্য ওই বয়সটাই প্রথম কাউকে ভালো লাগারও বয়স। তাই আমাদের সমসাময়িক কমবেশি সকলেরই ঐ বয়সে কাউকে না কাউকে ভাল লাগত। আর সবচেয়ে বোধহয় ভাল লাগত নিজেকে। সাইকেল চালানোর সময় মনে হত ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক বাজছে, ভিড়ে মনে হত সবাই আমাকেই দেখছে, গান গাইলে মনে হত বড় হলে গায়িকাই হব, ক্লাস মনিটর হলে নিজেকে নেত্রী গোছের মনে হত। জানি, আমার মত আপনাদেরও প্রায় একই অভিজ্ঞতা। ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়াকালীনই সহপাঠীদের কেউ কেউ “প্রেম” করত। দেখতাম তাদের “বয়ফ্রেন্ড” তাদের চিঠি দেয়, টেডি বিয়ার দেয়, আরো সব কিসব হয়- ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে। কিন্তু কারোর “খবর” জানাজানি হয়ে গেলে সে টিচার ও গার্জেন দের কাছে “খারাপ” হয়ে যেত। তার সাথে মেলামেশা করা পরোক্ষে নিষেধ ছিল। সেই বেচারি তখন একটা “rebel” সুলভ আচরণ করত। লেখাপড়া ছেড়ে দিত; discipline কে কাঁচকলা দেখাত, ব্লেড দিয়ে হাত কাটতো এবং শেষে result খারাপ করে “খারাপ” নামের যৌক্তিকতা প্রমাণ করত।
(তবে কিনা, যে সম্পর্কের জন্য ওরা নানা ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটাতো সেই সম্পর্কগুলো বেশিদিন টিকতো না, এখন ভাবলেও আশ্চর্য লাগে......)
ছবির উৎসঃ লিঙ্ক

এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা অনেক এগিয়ে। যারা co-education- স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় এবং যারা পায়না সবাই একে অন্যের সাথে মেলামেশা করার বা কথাবার্তা বলার সুযোগ পায় প্রযুক্তির কল্যাণে আগের থেকে অনেক বেশি। তবে ওদের প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের থেকে খুব আলাদা নয়। বয়সের ধর্ম আমাদের যেমন ছিল, ওদেরও তেমনি। হয়তো প্রকাশটা সব জায়গায় এক নয়। আগের থেকে ছেলে-মেয়েদের বন্ধুত্ব ও মেলামেশার ব্যাপারটা অনেক স্বাভাবিক হয়েছে হয়তো কিন্তু স্কুলজীবনের ‘প্রেম’ ব্যাপারটাও আছে স্ব-মহিমায়। অনেক সময়েই ছাত্রীদের কাছ থেকে তার নিদর্শন স্বরূপ জিনিসপত্র বেরিয়ে আসে। তখন আবিষ্কর্তা দিদিমণির দায়িত্ব বর্তায় সেই ছাত্রীকে শাসন করার। তার ‘গার্জেন কল’ হয়, তাকে সাময়িক ‘suspend’ করা হয়। কখনও অবশ্য শুধু বকাঝকা করে বা ‘কমবয়সের প্রেম’ এর বিরুদ্ধে মগজধোলাই করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এই অপ্রিয় কাজটা আমাকেও করতে হয়েছে একাধিকবার। যখনই এরকম কিছু করতে হয়, ভাবি, বয়ঃসন্ধির যে সময়টা ওরা পার করছে, সেই সময় ওদের একে অন্যকে জানতে চাওয়া, পছন্দ করা আর ভাল লাগাটা নিতান্ত স্বাভাবিক। যুগটা T.V. থেকে ইন্টারনেটে বদলে গেলেও অনুভূতিগুলো বদলায় কি? সত্যিই কি ওদের কঠোর শাসন করা উচিত?
তবে এমন কিছু ঘটনাও ঘটে যায়, যার পরে ওদের ব্যাপারে নাক গলানোটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নিজের দেখা ঘটনাই বলছি- যেমন ধরুন ক্লাস সেভেন বা এইটের কোন মেয়ে স্কুল পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেললো কালীঘাটে। ছেলে বা মেয়ে কেউই বিবাহ-উপযুক্ত নয়। বা ধরুন হঠাৎ কানে এল, ক্লাস টেনের একজন দীর্ঘদিন স্কুলে আসেনা কারণ ‘she is expecting’! আবার, ‘প্রেম করা’র কথা বাবা-মা জানতে পেরে বকাবকি করায় কেউ ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলছে। স্কুলে মোবাইল নিয়ে আসা ও বাথরুমে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, দিনের পর দিন স্কুলে না এসে অন্য কোথাও যাওয়া, ব্যাগে পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিন এমনকি কন্ডোম আবিষ্কার হওয়া- এসব কিছুই অস্বাভাবিক নয়।
ছবির উৎস: লিঙ্ক

Lifestyle বা জীবনশৈলী নামের যে বিষয়টি পড়ানো স্কুলে এখন বাধ্যতামূলক হয়েছে, সেটি এই সমস্যাগুলো সমাধানে বিশেষ কার্যকরী হয়েছে বলে অন্তত আমার তো জানা নেই। শিক্ষিকা হিসেবে শুধু মনে হয়- ‘অতঃকিম্‌’? ‘B.Ed’ এর পাঠে অবশ্য পড়েছি যে ছোটবেলা থেকে ‘Co-ed’এ পড়লে বয়ঃসন্ধির অনেক জটিলতা নাকি স্বাভাবিক হয়ে যায় নিজে থেকে, কিন্তু এখনো এদেশে সে সু্যোগ কই? সামাজিক কারণেই এখনো Boys’ বা Girls’ School এর রমরমাই বেশি। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা, এমনকি অভিভাবক বোঝেনই না এই সময় ছেলে-মেয়েরা বড়দের কাছ থেকে কেমন ব্যবহার আশা করে। ওঁরা নিজেদের অজান্তেই শাসনের ঠেলায় নিজের থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেন সন্তানকে। ওরাও নিজেদের লুকোতে শুরু করে আর অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে বাবা-মা অবাক হয়ে ভাবতে বসেন, ‘আমার বাড়িতে কি করে এমন জিনিস হল?’
সময়ের সঙ্গে এখন দিদিমণিরা আগের থেকে অনেকটাই নরম। অনেকের ভিড়েও কারুর আচরণ অন্যরকম ঠেকলে, সকলে না হলেও অধিকাংশই চেষ্টা করেন আলাদা করে কথা বলে যদি কিছু সহজ করা যায়। সত্যি বলুন তো, হৃদয় তথা জীবনের আমরা নিজেরাই কতটা জানি-বুঝি? কিই বা করার আছে আমাদের চেষ্টা করা ছাড়া?

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই