Monday, August 8, 2011

চাওয়া- পাওয়ার Tower -- উড়ুক্কু


(সব ছবি: উড়ুক্কু )
ছোটবেলায় শুনেছিলাম প্যারিসের কথা, সে নাকি এক স্বপ্নের শহর- সেই আকাশ ফুঁড়ে বেড়িয়ে যাওয়া লম্বামত সেই আইফেল টাওয়ার(Eiffel Tower)- ছবিতেই এতদিন দেখেছিলাম, সেটা যে সত্যি নিজের চোখে
কোনদিন দেখতে পারব সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি...



কাজের সূত্রে থাকি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। সেখান থেকে প্যারিস মোটামুটি ৩০০ কিমি মত। সেখান থেকে এক ভয়ংকর ট্রেন যায়, যার নাম থ্যালিস। ভয়ংকর এই জন্য, কারণ এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে গিয়ে ফেলে মাত্র ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটেই। ব্রাসেলসের মিডি স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল ৭:৩৮ এ, এক্কেবারে কাঁটায় কাঁটায়। ট্রেনে চেপে বসলে আর বোঝার উপায় নেই যে ঘণ্টায় ৩০০ কিমির বেশি জোরে ট্রেনটা ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে তাকালেই বোঝা যায় সে কি জোর, কি জোর। জানলার ধারে বসে পড়লাম, কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেল থ্যালিসের কামাল। জানলা দিয়ে সামনের দিকে তাকালাম, দেখি সব কি কিরকম ঝাপ্সা- মনে করার চেষ্টা করলাম যে কাল রাতে নেশা করেছিলাম কিনা, সে রকম কিছু মনে পড়ল না-

তাই চোখ কচলে আবার দেখলাম, দেখি তখনও ঝাপ্সা। তখন বুঝলাম ট্রেনটা সত্যি সত্যিই এত জোরে দৌড়চ্ছে। সব চোখের সামনে হুহু করে পেরিয়ে যাচ্ছে। কখন যে বেলজিয়ামের সীমানা পেরিয়ে ফ্রান্সে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। ট্রেনটা পৌঁছনোর কথা ৮:৫৮ তে, ৮টা ৫৫ নাগাদ একটা ঘোষণা হল – “যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য আমাদের ট্রেন পারিস পৌছতে একটু দেরি হবে”। আমি ভাবলাম হয়ে গেল, কখন পৌঁছব কোনও ঠিক নেই- মুহূর্তের মধ্যেই আবার শোনা গেল আমাদের ট্রেন চার মিনিট দেরি তে পৌঁছবে, আমরা এর জন্য খুবই দুঃখিত। আমি তো শুনে সিট থেকে পড়ে যাই আর কি, এ কোথায় এলাম!! হাওড়া স্টেশনে  ট্রেন চার ঘণ্টা দেরি করে আসে, সেটাই নরমাল টাইম। কেউ সেই নিয়ে কোনও অভিযোগ অবধি করে না, আর এরা চার মিনিট দেরিকেও দেরি বলেই মনে করে- বোঝা যায় আমরা কত পিছিয়ে এখনও এই সব দিকে...

প্যারিস নর্ড স্টেশন থেকে মেট্রো চেপে সোজা পৌঁছে গেলাম হোটেল এ।সোজা ঠিক বলা যায় না, প্যারিসে ১৪ রকম মেট্রো চলে, একটা থেকে বারবার পালটে আর একটায় উঠতে হয়। আমরা কোলকাতার ১ টা মেট্রো লাইন নিয়েই এত গর্ব করি, আর এদের লাল, নীল, সবুজ, হলুদ- আরো হরেক রঙের ১৪ রকম মেট্রো চলে, (একটা মেট্রোয় আবার দেখি লোহার চাকার বদলে টায়ার লাগানো)। এরপরেই বেরিয়ে পড়লাম আইফেল টাওয়ার এর উদ্দেশে...

মাটির নিচ দিয়ে যেতে যেতে মেট্রোটা সোজা মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো- সামনেই দেখি সেন (Seine) নদী। আর তার উলটো দিকেই দেখলাম খয়েরি রঙ এর জং ধরা লোহার ল্যাম্প পোস্ট এর মত কি একটা... ভাল করে দেখলাম আবার... আরে, একি... এটাই তো সেই আইফেল টাওয়ার!

একেবারে সামনে যখন পৌঁছলাম দেখে মনটা ভরে গেল, এই এত্তো বড় একটা বিশাল জিনিস চোখের সামনে ১২২ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে, হাওয়াতে দুলছে না, ঠেললে পড়ে যাচ্ছেনা, বৃষ্টিতে ভিজে মরচে পড়ছে না, ভাবতেই কি রকম অবাক লাগে। নিচে গিয়ে যখন দেখলাম, চার দিকের চারটে পিলারের দিকে যখন ঘুরে ঘুরে দেখছি, মুখটা কখন যে হাঁ হয়ে গেছে, বন্ধ করতেই ভুলে গেছি। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম চার দিকের চারটে পা দিয়ে দেখি লোকজন সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। ৩ দিকে আবার লিফট ও আছে। সেইটা দেখে একটু স্বস্তি পেলাম যে এই এত্তো উঁচু জিনিসটায় অন্তত হেঁটে উঠতে হবে না। আইফেল নামে একজন লোক ৩২৪ মিটার উঁচু এই জিনিসটা মাত্র ২ বছর ২ মাস ৫ দিনে বানিয়ে ফেলেছিল।
এটা জানার পরে বলতেই হয় বাবা আইফেল, তুই ‘Paris’ ও বটে।

দাঁড়িয়ে পড়লাম টিকেট কাউন্টারের সামনে, সামনে বললে অবশ্য একটু ভুল বলা হবে।সে কি লম্বা লাইন। পুজোর সময় কলকাতার পুজো প্যান্ডেলেও এই রকম লম্বা লাইন পড়ে না। আইফেল টাওয়ারের নিচে চারিদিক থেকে মাঝে মাঝেই চাকুম চুকুম শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল, শুরুতে বুঝিনি ব্যাপারটা কি, পরে বুঝলাম। এতক্ষণ লাইনে দাড়িয়ে কি আর করবে, সাহেব মেমদের মধ্যে দেখি তখন চুমু খাওয়ার ধুম পড়ে গেছে। এই রকম রোম্যান্টিক পরিবেশে মনের আনন্দে আর কি বা করবে...

চারিদিকে মাদাম
মধ্যে আমি বাদাম
চাকুম চুকুম শব্দ
চারিদিক নিঃশব্দ
একারা কাঁদিয়া যায় সাথে...

পাক্কা দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম, তবে পেলাম টিকেট। ভেবেছিলাম তখন টিকেট কেটে সন্ধেবেলা উপরে উঠবো, কিন্তু দেখি সে গুড়ে বালি, তখনি নাকি উঠে পড়তে হবে। উঠে পড়লাম লিফটে। ৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে একটা লিফট উঠতে শুরু করল উত্তর দিকের পা বেয়ে, নিচের সব কিছু ছোট হতে শুরু করল, প্লেনে উঠলে যে রকম অনুভূতি হয়, সেই রকম। যখন দোতলায় উঠলাম তখনি নিচের দিকে তাকিয়ে পারিস এর অর্ধেক দেখা যাচ্ছিলো, সামনে দিয়ে সেন নদী বয়ে চলেছে, দূরে সব অনেক মেমোরিয়াল, প্যালেস, মিউজিয়াম দেখা যাছে ছোট ছোট। দোতলার বারান্দায় কিছুক্ষণ থেকে আমরা একেবারে ওপরে ওঠার জন্য আর একটা লিফট এ উঠে বসলাম। সবচেয়ে ওপরটাকে বলে সমেট। তারপরে উঠে এলাম একেবারে আইফেল টাওয়ার এর চূড়ায়। সেখান থেকে সে এক অসাধারণ দৃশ্য। যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় বিশাল আকাশ, নিচে সরু সেন নদী, নিচের রাস্তা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট খেলনা গাড়ি যাচ্ছে। একটা ফুটবল মাঠে দেখি খেলা হচ্ছে, টপ-ভিউ থেকে এই রকম ফুটবল শুধু কম্পিউটার গেমসেই দেখেছিলাম আগে।

এবারে বুঝতে পারলাম যে এরা এত বড় শহরটাকে কি করে রঙ করে। আইফেল টাওয়ারের মাথায় উঠে পড়ে যখন সব ছোট্ট হয়ে যায়, তখন তুলি দিয়ে টুক করে রঙ করে দেয়।

উঁচু কোনও জায়গায় উঠলে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। আমার সেখান থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছেটা আইফেল এর চূড়ায় উঠেও খুব হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই লাফিয়ে পড়ি। আমাদের লোকজন কলকাতার মেট্রোয় লাইনে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এখানে এসে মনে হলে আইফেল টাওয়ার এর মাথা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার মত সুখ আর কিছুতে নেই। হিসেব করে দেখলাম, ওপর থেকে নিচে পড়তে ৫ সেকেন্ড মত লাগবে। যারা মরতেই চায়, একটু কষ্ট করে জীবনের শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়ে একবার আইফেল টাওয়ার চলে আসুক, তারপরে ওপর থেকে লাফ দিয়ে শান্তির মৃত্যু। এই আইডিয়াটা খারাপ নয় খুব একটা।

যারা এই লেখাটা এতদূর পড়েছে, তারা নিশ্চয় ভাবতে শুরু করেছে এই লেখাটাই আমার জীবনের শেষ লেখা কিনা। তাদের বলি, না, আমি আর লাফটা দিয়ে উঠতে পারিনি শেষ অবধি। বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছি, থাকবও, বাকি অংশটা লেখার জন্য।

আইফেল টাওয়ার থেকে নেমে এলাম, যদিও নামতে ইচ্ছেই করছিলো না। ওখানে অনেক লোক দেখি এক ইউরোতে পাঁচটা করে আইফেল টাওয়ার বিক্রি করছে, ৫ টা আইফেল টাওয়ার তাড়াতাড়ি পকেটস্থ করলাম। এবার যখন কেউ জিজ্ঞেস করবে তেরে পাস কেয়া হ্যায়? আমি বলব মেরে পাস ৫ আইফেল টাওয়ার হ্যায়।
আরও এদিক ওদিক ঘুরে এসে বসলাম সেন নদীর তীরে। নদীর দুপার সুন্দর করে বাঁধানো, একটু একটু অন্তরই একটা করে ব্রিজ রয়েছে, জলের মধ্যে দিয়ে ভেসে চলেছে বিভিন্ন রকম বোট। ভেসে চলেছে ব্যাটোবাস- একরকম বোট, যেটায় চেপেও প্যারিসের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায়- যাকে বলে হপ-অন-হপ-অফ। নদীর পারে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। জলের ওপরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা আইফেল টাওয়ারের প্রতিচ্ছবি ভেসে রয়েছে... বোটগুলো যখন যাচ্ছিলো, তখন সেই ছায়াটা আরও ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। আবার একটু পরেই আবার জল স্থির হয়ে গিয়ে গোটা আইফেল টাওয়ারটা দেখা যাচ্ছিলো।
সূর্য অস্ত যায় এখানে অনেক পরে, তাই সন্ধে নামতে বেশ সময় লাগে। রাতের বেলার আইফেল টাওয়ার দেখার জন্য অনেকক্ষণ বসে রইলাম- একটু পরে আস্তে আস্তে আলোগুলো একে একে জ্বলে উঠলো। সে এক অদ্ভুত সুন্দর, স্বপ্নের মত অভিজ্ঞতা। এতদিন যেটা ছবিতে দেখে এসেছি সেই মায়াবী আইফেল টাওয়ারের সামনে বসে আছি, ভাবতেই কি রকম একটা লাগছিল...


রাত ১০টা মত তখন বাজে, হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এতক্ষণ হলুদ আলোয় ঝলমল করছিল আইফেল টাওয়ারটা, এখন- মাঝে মাঝে হাজার হাজার সাদা আলো জ্বলে উঠলো, পুরোটা ঝিকমিক করতে শুরু করল। পুরো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পাতা ফেলতে পারলাম না, মনে হচ্ছিল চোখ বন্ধ করলেই এই অদ্ভুত সিনটা মিস করে যাবো। ৫ মিনিট পরে এই ঝিকমিক যখন বন্ধ হল তখন মনে হচ্ছিল কি রকম ঘোরের মধ্যে আছি, আইফেল টাওয়ারের নেশায় তখন বুঁদ হয়ে গেছি। সেই নেশা কাটতে সময় লাগলো অনেক- পরে আবার ১১টার সময় আর ১২টার সময় ২ বার ওই রকম ঝিকিমিকি হল, ৫ মিনিটের জন্য। সেই একই রকম নেশাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইলাম। মোট ১৫ মিনিটের ঝিকিমিকি দেখে অদ্ভুত একটা ভালোলাগা নিয়ে হোটেলে যখন ফিরলাম, তখন ১টা বেজে গেছে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই