Saturday, September 3, 2011

পুজো - এখন ও তখন -- শমিত

ছবি: হরিদাস

পুজোর গন্ধ এসেছে। ঢাকে কাঠি পড়তে হাতে গোনা আর কয়েকটা মাত্র দিন। বৃষ্টির অলস দুপুরে বসে থাকতে থাকতে চোখে ভেসে উঠলো বদলে যাওয়া সময়ের
জলছবি। তাই ভাবলাম মনের কথা মন খুলে বলবার এই মঞ্চে আমিও অবতীর্ণ হয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরি পুজো নিয়ে কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা।
ছোটদের পুজো তো সেই মহালয়া থেকেই শুরু, দেবীপক্ষের সূচনার দিনটিতে ভোরবেলা ওঠা ছিল বাধ্যতামূলক। ঘুমভাঙ্গা চোখে বছরের পর বছর মহিষাসুর বধের সেই একই দৃশ্য দেখেও বিন্দুমাত্র ক্লান্ত হতাম না, কিন্তু কাল হলো মহিষাসুর-মর্দিনী'র রেডি-মেড সিডি কিনে এনে। মনে হলো এই তো
..আর চিন্তা কি! এবার যখন তখন দেখব ..ব্যাস, মহালয়ার ভোরে ওঠার ইতি ওখানেই। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় মহিষাসুর-মর্দিনী'র সেই সিডি এখনো একদিনও চালিয়ে দেখা হয়ে ওঠেনি!!
প্রতিমা গড়ার সময় রোজ বিকেল মৃৎশিল্পীর বাড়িতে ধরনা দিতাম সদলবলে...প্রতিমা রং করা থেকে চক্ষুদান, কোন ক্লাবের প্রতিমা ও আলোকসজ্জা কেমন হচ্ছে - এই হত তখন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ও আলোচনার বিষয় (এখন পুজোর আগে যেটা বেশি করে থাকি সেটা হলো -প্রাপ্য বোনাস না মেলায় সরকারের তুলোধোনা )। মণ্ডপে মণ্ডপে গিয়ে প্রতিমা দর্শনও করতাম খঁটিয়ে খুঁটিয়ে ... কোন ইঁদুরের লেজ দেখা যাচ্ছে না অথবা কোন সিংহের চোখটা একটু ট্যারা - এইসবেই মশগুল থাকতাম। প্রতিমা এখনো যে খুঁটিয়ে দেখি না তা নয়, কিন্তু দেখার চোখ অনেকটা পাল্টে গেছে- "অসুরদের কি দেহে ক্লোরোফিল থাকে, নইলে সবুজ রং কেন", "সরস্বতীর ফিগারটা মাইরি চাবুক"....এইসব সরেস অথবা আঁতেল-ধর্মী চর্চা এখন বেশি হয়ে থাকে। অবশ্য "থিম পুজো'র" বাড়-বাড়ন্ত আজকাল এতটাই যে সেই মিষ্টি সাবেকি প্রতিমা বিরল।
পুজো নিয়ে ভাবতেই মনে পড়ে নতুন জামা- নতুন জুতো পরিহিত, ক্যাপ ফাটানো বন্দুক ও এরকমই বন্দুকবাজ সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এপাড়া-ওপাড়া দাপিয়ে বেড়ানো সেই রঙিন দিনগুলি। ছেলেবেলায় নতুন পোশাক অনেক পেতাম কিন্তু তা নিয়ে অহেতুক মাথাব্যাথা ছিলো না। পোশাকের খুঁটিনাটি নিয়েও ভাবতাম না, সময় এগিয়েছে...এখন শুধু নতুন পোশাক হলেই চলবে না...কেনার আগেই ট্রায়াল দিয়ে দেখে নিতে হবে কোনটা এই "অরূপ-কান্তি"র জন্যে লাগসই...পেন্টালুনস, বিগবাজার, স্মলবাজার ঘুরে ঘুরে যেভাবেই হোক নিজেকে কেতাদুরস্ত (কেতা দূর অস্ত?) করে তুলতেই হবে। জিন্‌স্‌ যদি নামজাদা হয় তাহলে বেল্ট নৈব নৈব চ..নেহাত পরতেই হলে কায়দা করে এমন ভাবে গলিয়ে দিতে হবে যাতে ব্র্যান্ড নেম-টা ঢাকা না পড়ে যায়.."আই য়াম এ ব্রান্ডেড বয়", দেখো আমি বেড়েছি মাম্মি।
ছবি: হরিদাস

রোসো! শুধু পোশাকেই শেষ না, চাই মাঞ্জা দেওয়ারও হরেক উপকরণ... শুধু টেরি বাগালেই চলবে না এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগ বাপু! সাদা গুঁড়ো পাউডারের মনোপলি শেষ... (যেমন পুজো প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে মুন্নির বদনাম আর শীলার যৌবন কিশোর কুমার আর কুমার শানুকে একঘরে করে দিয়েছে) তাই সুগন্ধি আর হরেক কিসিমের প্রসাধন অত্যাবশ্যক। কয়েকজন বন্ধুর দেখাদেখি আমিও একবার ভেবেছিলাম ফেসিয়াল করাবো পুজোর আগে। তা বাড়িতে বলায় মা বলেন যে ওসব করলে নাকি কম বয়সেই মুখের চামড়া কুচকে যায়। তাই নিজের কুঞ্চিত মুখশ্রী কল্পনা করে ভয়ে সেটা আর করানো হয়ে ওঠেনি।
শহরের একটি পুজো প্রাঙ্গণে বেশ জমজমাট মেলার মত হতো। সেখানে চিত্রহার নামে একটি "আইটেম" থাকতো।এটা আর কিছুই না চটুল হিন্দি গানের সাথে স্বল্প -বসনা নর্তকীদের উত্তেজক নাচ। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্যে আবার মাঝে মাঝে পর্দা তুলে সেই উদ্দাম নাচের একটু ঝলক দেখানো হতো।বন্ধুরা মিলে দুরুদুরু বুকে একবার দেখেছিলাম সেই নাচ। "দুরুদুরু" কারণ চেনা পরিচিত কেউ দেখে ফেলবার ভয় আর ওরকম লাস্যময়ী নারী শরীর প্রথম প্রত্যক্ষ করার উত্তেজনা...সে এক আশ্চর্য অনুভূতি....সেই চিত্রহারের আসর এরপরে আর একবারও আসেনি ওই পূজা প্রাঙ্গণে।

ছবি: সুনন্দ

পুজোর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে আর যা জড়িয়ে আছে সেটা হলো পেটপুজো....টক-ঝাল-মিষ্টি রকমারি খাবারে পুজোর দিনগুলো ভরপুর থাকে বরাবরই। তখনকার ফুচকা, রোল, চপ, ঘুগনির জায়গা নিয়েছে পোলাও- কাবাব- তন্দুর..একটা ঘটনা মনে পড়ে...একবার পুজোতে আমাদের শহরের এক নামকরা রেস্তোরাঁয় খেতে গেছিলাম চার জন বন্ধু মিলে... সেটাই প্রথম সব বন্ধুরা মিলে কোন রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া ..তো প্রত্যেকে ১৫ টাকা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (ভুল পড়েননি! প-নে-রো টাকাই) ...তো যাই হোক, তৃপ্তি করেও যে আধপেটা খাওয়া যায় সেটা ঐদিনই প্রথম বুঝি কিন্তু গোল বাধলো অন্য জায়গায়। এক বন্ধু তার রেস্তোরায় খাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বেয়ারাকে ১০ টাকা বখশিস দিয়ে দেয় আমাদের সম্মিলিত তহবিল থেকে, সেটাই নাকি দস্তুর শুনে অন্যেরা তো তাকে এই মারে আর সেই মারে আর কি!
বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়া দশমীর প্রণাম করাটা ছিল আর এক ইভেন্ট...ভক্তি-বশত যতটা না করতাম তার চেয়ে বেশি করতাম নাড়ু, নিমকি আর গজার লোভে। এখন সেই নাড়ু নিমকির লোভও নেই আর প্রণাম করা? দূর ছাই! শুধু তক্ষুনি যে কেন মনে পড়ে যায় "বল বীর চির উন্নত মম শির "...
"সপ্তমীতে প্রথম দেখা, অষ্টমীতে হাসি "....সত্যিই অষ্টমীর অঞ্জলি, বাঁকা ভ্রূর চাউনি, অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে ঝাড়ি মারা, দুষ্টু - মিষ্টি প্রেম পর্বের সূচনা এইসব না হলে বাঙালির মেগা ইভেন্ট ঠিক পূর্ণতা পায়না ... কিন্তু সেসব নিয়ে লিখতে বসলে একটা আলাদা উপাখ্যান..সে নাহয় অন্য একদিন বলা যাবে।
হয়তো আঙ্গিক বদলেছে...পাল্টে গেছে রুচিবোধ...সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে আরো অনেক কিছু। কিন্তু এখনো পাল্টায়নি অন্তত একটা জিনিস...তা হলো নবমীর রাত্রের চোখ ছলছল, মন আকুল করা মন-খারাপ নিয়ে আবার একটা বছরের দিনগোনা শুরু করা...এর জন্যেই পুজো চিরন্তন, যার আবেদন সময়োত্তীর্ণ ...(সমাপ্ত)

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই