Tuesday, September 20, 2011

ডুমুর গাছে কিছুক্ষণ -- সুনন্দ

ডেভিড অ্যাটেনবরো র খুব পছন্দের বিষয় হলো বর্ষাবন (Rainforest)এর অগণন প্রজাতি, বেঁচে থাকার লড়াই আর
প্রতিনিয়ত একসাথে অভিনীত হওয়া অসংখ্য টানটান নাটক- সব কিছুই মনে হয় তাঁকে আর তাঁর কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে যুক্ত আমাদের সকলকে বর্ষাবন নিয়ে অদ্ভুত কৌতূহলী করে তোলে। Planet Earth- এই টিভি সিরিজটি, IMDB(Internet Movie Database) র মতে দুনিয়ার সর্বাধিক সুপারিশ(rating) পাওয়া শো। আজ দুপুরে এর
বর্ষাবন নিয়ে তৈরি episode টায় দেখি, সেই মহারণ্যের সবচেয়ে চাহিদার আর সবথেকে বাসযোগ্য অঞ্চল হলো জঙ্গলের ছাদ(Canopy)সেখানেই শেষ নয়, সবচেয়ে নামকরা গাছ হলো ডুমুর(Fig)সারা বচ্ছর ফল ধরে বলে, সেখানে সব সময়েই প্রচুর প্রজাতির বাঁদর ঘুরে বেড়ায়। সে যে কত্ত রকমের বাঁদর, তা আর কি বলবো- ছোট, বড়, বেঁটে, লম্বা, গম্ভীর-চুপচাপ, গলা-ফোলা গলাবাজ... সব্বাই এসে জড় হয় ওই এক গাছে। সেখান থেকেই তারা নিজেদের সীমানা ঘোষণা করে, কমজোরদের গলা-ধাক্কা দেয়, প্রচুর পরিমাণে খায় আর খাওয়া হয়ে গেলে মহানন্দে দোল খায়। এর সাথে আমি কল্পচক্ষে যোগ করে নিলাম পরিচিত বাঁদর-সুলভ অন্যান্য আচরণ- উকুন বাছা, খুনসুটি, নিজের গায়ে হাত বোলানো আর সর্বোপরি, ভাব-গম্ভীর হয়ে বসে থাকা। অসাধারণ ক্যামেরা, বর্ণন আর চোখ জুড়নো দৃশ্যাবলি ছাপিয়ে কেন কে জানে আনমনা হয়ে পড়লুম। মনে পড়ে গেলো মাসখানেক আগের এক low-contrast বিকেলের কথা। মঞ্চ গাছের ডাল নয়- সমুদ্রতীর, আর জায়গাটা জঙ্গল বটে, তবে ইঁট-কাঠের।
ছবির উৎস: লিঙ্ক
মেরিন- ড্রাইভ। মুম্বই। সময় মোটামুটি বিকেল ৫টা। দারুণ মেঘলা হওয়ায়, দেখে ৬টা-সাড়ে ৬টা মনে হচ্ছে। চারজন প্রায় সমবয়সী ছোকরা অটোতে করে এসে পৌঁছলাম Trident হোটেলের সামনে। একজনকে আগে থেকে অল্প চিনি, বাকি দুজনের সঙ্গে সেই সকালেই আলাপ। আমাদের লক্ষ্য স্বনামধন্য মেরিন ড্রাইভে হাঁটা। ঠিক কেন নামকরা, সে বিষয়ে কাউকে জিগ্যেস করেই সদুত্তর পাওয়া যায়নি। কলকাতার ছেলে, স্বভাবতই যে কোন বিষয়ে না আঁচিয়ে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠেনা। চারজনে মিলে উঠে বসলাম সামনের সিমেন্টের প্রাচীরে। মনে মনে ভাবছি- কি এমন জায়গা? কয়েকটা অদ্ভুতদর্শন বোল্ডার পড়ে থাকলে, আর তার গায়ে কিছু গোদা কাঁকড়া ঘুরে বেড়ালেই কি সেটা দেখার জিনিস হয়? বাঙালিসুলভ নাক কোঁচকানোও হল দু’-একবার- ধুস্‌, একটা সমুদ্র আছে বলে মেরিন-ড্রাইভ করে করে মলো... এই যদি একখান আমাদের কলকাতায় থাকতো-... আরে! ওটা কি পাখি? তিড়িং-বিড়িং করেই চলেছে? ক্যামেরা তাক করে খ্যাচখ্যাচ কয়েকবার করার পর View-finder এর মধ্যে দিয়েই প্রথম দেখলাম ব্যাপারটা- সামনে সমুদ্র বুকে পেতে নিয়ে মুম্বই Skylineডানদিকে চোখ গেল- প্রাচীরের গা দিয়ে সার সার ঝুলে আছে রং-বেরঙের পা। ধূসর, একঘেয়ে সমুদ্র অনেকক্ষণ থেকেই আর ভাল লাগছিলো না। চোখ ঘোরালাম মানুষ-জনের দিকে।
আমাদের পাশেই বসে আছে এক পরিবার। মুখ দেখে শুধু বুঝি মঙ্গোলয়েড, কোন রাজ্য, (নাকি নেপাল-ভুটান) বুঝতে মোটেই পারিনা আমি। উত্তেজিত কথা শুনে বুঝলাম দলের কনিষ্ঠ সদস্য, বছর ৪-৫ এর একটি দস্যি, জীবনে প্রথম কাঁকড়া দেখেছে, তাই সে প্রাচীরের ওদিকে আজ না নেমে ছাড়বেনা। (সম্ভবত) তার দুই দিদি, ব্যাপারটা মহাস্থবির-সুলভ গাম্ভীর্যে পর্যবেক্ষণ-রত। ভাইয়ের এহেন দৌরাত্ম্য তাদের মোটেই পছন্দ নয় বোঝা গেল। রাস্তার উলটো দিকে সুদৃশ্য কিছু কুকুর হাতে সুন্দরী মেয়েরা পায়চারি করছে। পাশ দিয়ে যাওয়া ছেলেদের “So cute!” মন্তব্য বোধহয় কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যেই- ঠিক জানি না...
হাঁটতে শুরু করলাম, যেদিক থেকে এসেছি, তার উলটোদিকে। ঘনঘন পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য-সচেতন দৌড়বীরেরা, কারুর কানে গান গোঁজা, কারুর ফোনের হেডসেট। একঝলক তাকালেই বোঝা যায় ঠিক কতটা বিচিত্র এই জায়গা। মেলার সাথে এর মিল নেই, জনতা মোটেই উচ্ছৃঙ্খল নয়। পরিষ্কার বোঝা যায়, একটু খুঁজলেই গোটা ভারতের যে কোন অঞ্চলের, যে কোন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি পাওয়া যাবে এখানে। শুধু কি তাই? ধনী, দরিদ্র, যুবক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ- সব সমান মাপে। জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে যারা, 
ছবির উৎস: লিঙ্ক

সেখানে হাজির সব বয়সি মানুষ। ছিপছিপে তরুণের কোমর জড়িয়ে প্রায় এক হয়ে বসা তরুণী- দুজনেই চুপ, হয়তো আগামীর স্বপ্নে বিভোর নাকি আসন্ন বিচ্ছেদের কল্পনায় স্তব্ধ- কে জানে? এক প্রৌঢ়ের- যাঁর পোশাক একঝলকেই Branded বলে চেনা যায়, পাশে বসে আছে এক উঁচু মেকআপের তরুণী। প্রথমে ভেবেছি বাবা-মেয়ে। পাশ দিয়ে পেরনোর সময় ফিস্‌ফিসে কথার ধরন অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করলো। তা আমার অত ভেবে কাজ কি?
হঠাৎ দেখি, কিছু কমবয়সী ছেলে ইউনিফর্ম গোছের কিছু একটা পরে গোল হয়ে বসে আছে এক জায়গায়, আর থেকে থেকে মারাঠি তে কি সব চিৎকার করছে। কাছে গিয়ে পড়তে পারলাম- “I am Anna Hajare.” তাদের পাশ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল চকচকে থ্রি-কোয়ার্টার্স পরা যুবক, ব্যবসা নিয়ে জোরে কথা বলতে বলতে। এতক্ষণ পরে হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরলো। শোঁ-শোঁ করে গর্জন করছে সমুদ্র, তাকে ছাপিয়ে উঠছে মানুষের শব্দ। ধাক্কার মতো বুঝতে পারলাম, এত কম জায়গায় আগে কখনো এত রকমের, গড়নের, ধরনের মানুষ দেখিনি। সারা ভারত, এমনকি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের এত রকম মানুষ এই একটা জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে, কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নেই, নেই মহৎ কোন নীতির সমর্থন বা প্রতিবাদ। কেউ অন্য কাউকে নিয়ে উৎসাহী নয়- প্রত্যেকে নিজের মতো করে কাটাচ্ছে সন্ধের আগের একটু সময়। কেউ এখানেই জন্মেছে, অধিকাংশ এসেছে নিজের পরিচিতির গণ্ডি ছেড়ে, স্বপ্ন দেখে বা স্বপ্ন দেখাতে। কান পাতলেই শোনা যায় অগুনতি স্বার্থের কক্‌টেল। কেউ ভাবছে ফ্ল্যাট নিয়ে, কেউ চাকরি। কিন্তু সব মিলিয়ে যে কোরাসটা শোনা যাচ্ছে, সেটা এই শহরের হৃৎস্পন্দন। সচেতন হয়ে উঠলাম নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে যেমন নিজেকে ছোট্ট- ক্ষুদ্র মনে হয়, ঠিক তেমনটা নয়। মনে হল, এই ভিড়েও আমি হারিয়ে যাইনি। ছোট হলেও, এক হলেও, নিজেকে দিয়ে বাড়িয়ে তুলেছি এই বর্ণালীর প্রস্থ- একটু হলেও। অবশেষে বুঝলাম খ্যাতিটা কিসের। মেরিন-ড্রাইভ অবশেষে শেষ হাসি হাসলো।
সম্বিৎ ফিরলো। অ্যাটেনবরো বলে চলেছেন নিউ গিনির বার্ডস্‌ অব প্যারাডাইসের রঙিন courtship এর গল্প। ডুমুরগাছের বাঁদরগুলোর কথা মনে পড়ল। নিজের মনে মুচকি হেসে ভাবলাম, একদিন আসুন, আমারও আপনাকে অন্য বনের গল্প বলার আছে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই