Thursday, September 29, 2011

তবক -- নির্মাল্য


দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে দেবযানীর। গায়ের ভারী গয়না, দামী শাড়ি সবই যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে আন্তরিক চোখের জলে। আন্তরিক? যদি হতো! যদি সত্যিই কাঁদতে পারত দেবযানী, ভাবতে ভাবতে সত্যিই যেন ভেতরটা ভারী হয়ে আসতে চায় তার- কাট্‌- এক্সেলেন্ট! চিৎকার করে ওঠেন পরিচালক। চিন্তার চাকাটা অজানার দিকে গড়িয়ে যায় দেবযানীর। স্পটগার্লের এনে দেওয়া রুমালে চোখের তলার কালি মুছে ফেলে সে। স্পটের একধারে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দেয়, চুল খুলে, দুচোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে। আজ করবী লাহিড়ীকে একডাকে চেনে সারা বাংলা। বছর দুয়েক আগেও ব্যাপারটা এতো সহজ ছিল না-'পারিবারিকধারাবাহিকের জনপ্রিয় গৃহবধূ করবী- বাস্তবের দেবযানীর অস্তিত্ব যেন গ্রাস করেছে। পরিচালকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, অসংখ্য বাঙালী বধূর শুভেচ্ছাবার্তার মাঝে সে কতটুকু আর দেবযানী? তাকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নিয়ে পরিচালক মিঃ ব্যানার্জী শুরু করেছিলেন পারিবারিক। আজ সবকটা চ্যানেলের সমস্ত ধারাবাহিককে অনেক পিছিয়ে ফেলে পারিবারিকপ্রথম-দি নাম্বার ওয়ান। বাবার বয়সী পরিচালকের কাছে সে শুধু করবী লাহিড়ীই নয়, স্নেহের পাত্রীও বটে।
আজকাল প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সংবর্ধনাসভায় যেতে হয় তাকে। সাম্মানিক গ্রহণ করে করবী লাহিড়ীও সর্বাগ্রে ধন্যবাদ জানায় নিজের পিতৃপ্রতিম পরিচালককে। শাশুড়িদের প্রিয় বউমা, দেওরদের প্রিয় বড়বউদি, উদয়ের গৃহকর্মনিপুণা স্ত্রী, অর্ক-অণুর মা, রুপোলি পর্দার ভরা পরিবার- মাঝখানে সুরূপা বধূ করবী, গল্পের কল্যাণে একাধারে স্পষ্টবাদিনী আবার চূড়ান্ত নমনীয় মহিলা, ঠাকুরঘর থেকে রান্নাঘর, করবী ছাড়া সিরিয়াল অন্ধকার। দিকে দিকে একটাই কথা, করবী- লৌকিক সংসারে অলৌকিক দেবীত্বের মূর্তি। মাঝে মাঝে হিংসে হয় দেবযানীর। কখনো যদি করবীর সংসারের একটুও তার জীবনে নেমে আসতো। কখনো একটু অভিনয়ও যদি বাস্তব হয়ে যেত...............
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে ওঠে দেবযানীর। বিকাশের ফোন। হঠাৎ নতুন করে খুশী হয়ে ওঠে সে। ফোন তুলতেই বিকাশ ঠাণ্ডা গলায় বলে- দেবী, আজ রাতে ফিরতে দেরী হবে। সমুর কম্পিউটার ঠিক করার লোক পাঠিয়ে দেবো, যদি তুমি তাড়াতাড়ি ফিরতে পার, সমুকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেও
-ঠিক আছে
অনেক কথা বলবে ভেবেছিল দেবযানী। তারপর খানিকটা যেন অপরিচিতের মতোই নামিয়ে রাখে মোবাইল। শুভমিতা চক্রবর্তী পাশে এসে বসেন- তার সিরিয়ালের সৎমা। দেবযানীর মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে প্রশ্ন করেন- কিরে? বরের?”
মৃদু হেসে এড়িয়ে যায় দেবযানী। উনি অনেকদিনের অভিজ্ঞ অভিনেত্রী, ধারাবাহিকে যথেষ্ট গুরুত্ব পাননি বলে একদা পরিচালকের সঙ্গে ঝামেলা করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরে নিজেই যোগাযোগ করে ফিরে আসেন। মুশকিল আসান আছেই প্লাস্টিক সার্জারি। যাহোক, পারতপক্ষে ওকে এড়িয়েই চলে দেবযানী। এরপর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে- নতুন করে অভিনয়ের জন্য। ফ্লাডলাইটের আলোয় একে একে হারিয়ে যায় বিকাশ, সমু। দেবযানীকে ভেঙ্গে চুড়ে বেরিয়ে আসে করবী লাহিড়ী।
সন্ধ্যায় যথারীতি ফিরতে দেরী হয় দেবযানীর। ইউনিটের গাড়ি নয়, নিজের ঝাঁ-চকচকে ইণ্ডিকায় করে ফিরে আসে সে। প্রিন্স আনোয়ার শাহ্‌ রোডে যেতে যেতে ট্রাফিক জ্যামে আটকে যায় গাড়ি। জানলার তোলা কাঁচ প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে সে অসাধারণ’, বহির্জগতের থেকে যত বিচ্ছিন্ন থাকবে, ততই বাড়বে জনপ্রিয়তা। সাধারণত ড্রাইভার তার সাথে কথা বলে না, কিন্তু আজ সেও বিরক্ত হয়ে বলে – “মনে হয় বহুত দেরী হবে ম্যাডাম। বিরক্ত হয় দেবযানীও। মোবাইলটা তুলে বাড়িতে ফোন করে। ওপারে সমু......
-বাবু, তুমি খেয়েছো?”
ওদিক থেকে কোন উত্তর আসে না।
-সমু, মায়ের ওপর রাগ করেছো? কম্পিউটারের লোক এসেছিল?”
-এসেছিল
-তুমি খাওনি এখনো?”
-মা, তুমি কখন আসবে?”
বুক থেকে উথলে ওঠা কান্না চেপে দেবযানী বলে
-এই যে, সোনা আসি, তুমি হাসিদিদিকে ফোনটা দাও।
পরিচারিকাকে সমুকে খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে দেয় দেবী, সে জানে তার ফিরতে এখনো বেশ কিছুক্ষণ দেরী আছে। আঙ্গুলের ডগায় ভিজে চোখের কোণা মুছে ফেলে সে, অবাক হয়ে দেখে আঙ্গুলে মেক্‌-আপের চড়া রঙ লেগে গেলো।
হঠাৎ রাস্তার সব আলো নিভে গেলো। যাক, বিশেষ কিছু নয়, লোডশেডিং, নাগরিকদের দৈনিক প্রাপ্য। কিন্তু দেবযানী কি সাধারণ নাগরিক? আর পাঁচজনের মতো? বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ইনভার্টার, টালিগঞ্জের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ির এসি- তার জন্য একটুকরো স্বাচ্ছন্দ্য সবসময় রচনা করে রেখেছে, বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সাধারণদের থেকে।
জ্যাম কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সিটের পেছনে রাখা ইংরেজি দৈনিকটা হাতে তুলে নেয় দেবযানী। বিনোদন সেকশানে নিজের সাক্ষাৎকার খুঁজে পায়। ওহ্‌, এটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। গত সপ্তাহে নেওয়া। খুব কৌশলে তাকে কলেজ প্রেমের কথা জিজ্ঞেস করেছিল সাংবাদিক। মুহূর্তে জেগে ওঠে করবী লাহিড়ী। যৌথ পরিবারের গৃহলক্ষ্মী- তার আবার পুরনো প্রেম? ‘নাবলতে দ্বিধা করেনি সে। শুভময়ের কথা তাকে বলতে দেয়নি করবী। শুভময়, দেবযানীর প্রথম প্রেম। যথেষ্ট পরিণত বয়সেরই। শুভময় নাটক করত, দেবযানীও। শুভময় সেই নাটকেই থেকে গেছে। আজও মধুসূদন মঞ্চ, নজরুল মঞ্চ, বাংলাদেশেও আমন্ত্রিত হয়ে নাটক করতে যায় শুভময়ের গ্রুপ। দেবযানী নাটকের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। থাকেনি বলেই আজ তার জীবনে এই সোনার অভিনয়। করবীর সতীত্বে, তার ভারী গয়নায়, বালুচরী শাড়ির জৌলুসে উত্তরণ ঘটেছে দেবযানীর। লাহিড়ী বাড়ির গৃহবধূর সৌভাগ্য তার অভিনয়ে, এমনকি তার সংসারেও। কোথায় আজ শুভময়? কোথায় তাদের স্বপ্ন? সেই ভিক্টোরিয়া, সেই নন্দন, সেই বারো নম্বর বাস......বাসটা চলতে শুরু করলো। না বারো নম্বর নয়, ট্রাফিকে আটকে পড়া বাস, ড্রাইভার হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, গাড়িতে স্টার্ট দেয়।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে দেবযানীও। একটা মৃত স্বপ্নের কঙ্কালে এতক্ষণ যেন আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সে, এখন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে – “মা, তুমি কখন আসবে?”
-এই যে যাই সোনা।
কিন্তু কোথায় তার সোনা? সোনালী- রূপালী অসংখ্য পর্দার আড়ালে তাকে খুঁজতে গিয়ে দেরী হয়ে যায় দেবযানীর। বাড়ি ফিরে সমুকে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়। হাসি যথারীতি তার জন্য চা করে আনে। সমুর ব্যাপারে কোন কথা হয়না পরিচারিকার সাথে, ছেলে খেয়েছে কিনা তাও জানতে ভয় পায় সে। কেমন যেন একটা অপরাধবোধ গ্রাস করে তাকে। করবি লাহিড়ী এতটা অসহায় নয়। অর্ক- অণুর মা করবী, তাদের কাছে একমাত্র অস্তিত্বের পরিচয়- তাদের মা।
হাসি নিজেই কথা বলে প্রথমে।
- বাবুকে খাইয়ে দিয়েছি।
একটু থেমে বলে,
- আজ আবার কুশলবাবু এসেছিলেন দিদি। চায়ের কাপ থেকে ঠোঁট সরায় দেবযানী। শ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
-কে এসেছিল? কুশলবাবু!
মনে পড়ে দেবযানীর, কর্পোরেশনের সদস্য। তাদের অ্যাপার্টমেন্টেই থাকেন। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা। তাকে অনেক বিষয়েই সাহায্য করেছিলেন। অভিনয় জগতে আজকাল প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সে। একাধিক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন ওই কুশল সাহা-ই। তার কর সংক্রান্ত অনেক সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন তিনিই। কিন্তু তিনি হঠাৎ খোঁজ করছেন দেবযানীর?
বাড়িতে করবী লাহিড়ীর আর খোঁজ পাওয়া যায় না। দেবযানীর সংসারে কখনোই তার মধ্যে ফুটে ওঠে না করবী। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহে ছেলের ঘরে যায় দেবযানী। সমু শুয়ে আছে নির্জীবভাবে। মুখে কোন কষ্টের চিহ্ন নেই। সমু, তার আর বিকাশের সমু। তার মনে হয় এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে করবী লাহিড়ী হেরে গেছে তার কাছে। অর্ক অণুর মা তাদেরকে যতটুকু ভালোবাসে তার মধ্যে কণামাত্রও স্নেহ নেই, বুকচাপা দুঃখ নেই। আছে গ্লিসারিণ, চড়া মেক আপে আবৃত পেশাদারী অভিনয়, ভালোবাসার- স্নেহের অভিনয়। কিন্তু দেবযানী? সমু যে তার কাছে কি, তা শুধু সেই জানে। লাখো লাখো বাঙালি দর্শক সেই ভালোবাসাকে অনুভব করতে পারে না। সমুর প্রতি মায়ের কর্তব্যের খুব সামান্য অংশই সে পালন করতে পারে। তাই না পারার যন্ত্রণাতেই হয়তো আরো একটু বেশি ভালোবাসে তার একমাত্র সমুকে। অর্ক-অণু, তোমাদের মা কি কখনো এত ভালোবেসেছে?
ধীর পায়ে সে বাথরুমের দিকে এগোয়। বিলাসবহুল বিশাল ফ্ল্যাটের বাথরুমও সুন্দর, সাজানো বাথটব, শাওয়ার, ঠাণ্ডা-গরম জল, স্বাচ্ছন্দ্যের বাড়াবাড়ি রকমের ঘটা। এই রাত নটায় নিজেকে নতুন করে পবিত্র করে নিতে চায় দেবযানী। শুধু ক্লান্ত দেহকে ফ্রেশ করে নিতেই নয়, সারাটা দিনে তার দেহে-মনে-অস্তিত্বে লেপ্টে যাওয়া করবী লাহিড়ীকে মুছে ফেলতে চায় সে। অন্ততঃ বিকাশের জন্য। তাদের জীবনটা যে কখন ছন্দ হারিয়ে পুরনো ইঞ্জিনের মত যান্ত্রিক শব্দে চলতে শুরু করেছিল তা সে টের পায়নি। আজকাল সেটা মাঝে মাঝেই বুঝতে পারে। যদিও বিকাশ কখনো কোন আচরণে, ভাবে-ভঙ্গীতে সে কথা বুঝতে দেয়নি তাকে। তবুও দেবযানী ভালো করেই জানে অভিনয় কাকে বলে। করবীর গ্লিসারিন-কান্না যেমন দেবযানীর ভেতরের কষ্টটাকে প্রকাশ করতে পারবে না, তেমনি হাসিমুখ কোনদিনই বিকাশের ভেতরের অনিহা-বিরক্তি ঢেকে রাখতে পারে না। অন্ততঃ তার কাছে তো নয়ই। তার, থুড়ি করবীর চোখের জলে গলে পড়া অনেক লোকের ফ্যান মেল পেয়েছে সে। এমনও হয়েছে যে তারা দেবযানীকে সমবেদনাও জানিয়েছে। ঐ যেদিন সিরিয়ালে মাসতুতো ননদের হাতে লাঞ্ছিতা হল করবী, সেই এপিসোড যেদিন টেলিকাস্ট হল, রাতেই অনেকে তার ফেসবুক পেজ-এ সমবেদনা জানিয়ে দিয়েছে...হাসি পায় দেবযানীর, বেশ গর্বিতও লাগে। পেইড দুঃখের এই মহিমা দেখে। কিন্তু তাদের জীবনে যে অভিনয়টা চলছে, তারও মূল্য অনেক, মূল্যটা সবচেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে সমুকে। তবুও দেবযানী চুপ করে থাকে। সমাধানের উপায় তার জানা নেই।
কিন্তু সত্যিই কি অজানা? সে কি পারে না এক ঝটকায় করবীর মিথ্যে সংসার টান মেরে ফেলে দিয়ে নিজের এই ছোট্ট সংসারটাকে বাঁচাতে? দেবযানীর মা একবার তাকে একথা বলেছিলেন। দেবযানী তখন সদ্য মা হওয়ার পরেই অভিনয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে। তার কেরিয়ারে তখন সত্যি বলার মত কিছু ছিল না। শুভময়ের মতো বাউণ্ডুলে পাত্রের হাতে নিজের মেয়ের ভাগ্য সঁপে দিতে চাননি মা। ঠিক খুঁজে বার করেছিলেন বিকাশকে। বহুজাতিক কোম্পানির জোনাল ম্যানেজার, সুরূপ, সম্ভ্রান্তবংশীয়। নিজের মনকে বুঝিয়েছিল দেবযানী। শুভময় নেই তো কি হয়েছে? সে তো আছে। সুন্দরী, ঘরোয়া, লক্ষ্মীশ্রী চেহারাটা তো আছে। জন্মগত অভিনয় প্রতিভা, নাটকের অভিজ্ঞতা- সবই আছে। সে নিজে এগিয়ে যাবে, যাবেই। বিকাশও প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ দিয়েছিল। তারি কোম্পানির কোন এক পার্টিতে দেখা হয়েছিলো পরিচালক মিঃ ব্যানার্জীর সাথে। তারপর, তারপর বাকিটা শুধু আলো আর আলো, একতরফা ভাবে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। সমুর জন্মের পর মা বাধা দিয়েছিলেন। দেবযানী একবার থমকে গিয়েছিল। স্বামীর মতামত জানতে চেয়েছিল। বিকাশ অত্যন্ত উদাসীনভাবে উত্তর দিয়েছিল
- চলুক না, ভালোই তো প্রোগ্রেস করছ......
পরের দিনই কোম্পানির কাজে এক সপ্তাহের জন্য প্যারিস চলে যায় বিকাশ। দেবযানীও দেরি করে নি। হাসিকে কাজে রেখে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল পারিবারিক’-এর জন্য। রাগে-অভিমানে। হায় বিকাশ! সেদিন যদি একবারও নিষেধ করতে! আমার ওপর এতটুকু অধিকারও কি তুমি অনুভব কর না?
অস্বস্তিকর শব্দে বেজে উঠলো বাড়ির ল্যান্ডফোনটা। অর্থাৎ ওপারে যিনি আছেন, তিনি দেবযানীর খুব বেশি ঘনিষ্ঠ নন। একমাত্র কাছের মানুষদেরকেই নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছে দেবযানী। হাসিই ফোন ধরে-
- দাঁড়ান, দিদিকে জিজ্ঞেস করি।
তারপর ধীর গলায় প্রশ্ন করে, দিদি......কুশল সাহা-
বিস্মিত দেবযানী ফোন ধরে, - নমস্কার ম্যাডাম, ভাল আছেন?
- আজ্ঞে নমস্কার।
বেশ কয়েকটা আজেবাজে বাঁধা গতের কথাবার্তা বলার পর ভদ্রলোক কাজের কথাটা পাড়েন। প্রায় মিনিট পনেরো কেটে যায়।
অবাক দেবযানী জানায়-
- কুশলবাবু এ বিষয়ে আমি নেক্সট উইকে আপনাকে কিছু বলতে পারব, আসলে আমার তো টাইট শুটিং শিডিউল, আর তাছাড়া......
- ওকে, টেক ইয়োর টাইম, কিন্তু নেক্সট উইকে পজিটিভলি, মনে থাকবে তো?
-শিওর
ফোনটা নামিয়ে রাখে দেবযানী। কুশল সাহার প্রস্তাব শুনে সে হতভম্ব। লোকটা তাকে রাজনীতিতে নামার প্রস্তাব দিয়েছে। বিশেষ কিছুই নয়, আসন্ন অ্যাসেম্বলি ইলেকশানে দেবযানীকে তার দলের হয়ে প্রচার করতে হবে। উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার- করবী লাহিড়ীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চান উনি। বিনিময়ে? হ্যাঁ, তারও টোপ দিয়ে রেখেছেন ভদ্রলোক। বিনিময়ে দেবযানীকে নাকি জাতীয় স্তরে আইনসভায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবে তা দল। অর্থাৎ করবী লাহিড়ী গুডউইলের খুব প্রত্যক্ষ ফলাফল হাতে পাবে সে। কিন্তু তার কেরিয়ার? পিতৃপ্রতিম মিঃ ব্যানার্জী কি রাজি হবেন? অবশ্য কুশল সাহা-র মতে এসব নাকি কোন সমস্যাই নয়, উনি বললেই নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। কুশলবাবুকে সরাসরি না করে দিয়ে চটাতে চায় না দেবযানী। তাছাড়া এতদিন ধরে যে নাম, যশ, খ্যাতির স্বপ্ন দেখেছে সে, তার সবটাই কিন্তু পূরণ হয়েছে প্রাদেশিক গণ্ডির মধ্যে। আজ যদি কোন ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াই সে আরও একটু উঁচুতে উঠতে পারে, তাহলে ক্ষতি কি?
ইনভেস্টমেন্ট- এটাই বোধহয় ঠিকঠাক শব্দ। সে কি চেষ্টা করেনি এর আগে? বোম্বের কোন একটা বড় ব্যানারে কাজ করার? ‘পারিবারিকসিরিয়ালে বেশ প্রশংসা পাওয়ার পর নিজে থেকেই যোগাযোগ করেছিল বোম্বেতে। তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সেখানকার প্রোডিউসার তার কাছ থেকে বেশ নির্লজ্জের মতো একটি তথাকথিত অশোভন প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। তখন কিছুই করতে পারে নি দেবযানী। বিকাশ বলেছিল প্রতিবাদ করতে। মিঃ ব্যানার্জী বরং বলেছিলেন লাভ নেই, তুমি তো আর এগোও নি। কাজেই ওসব লোকের সঙ্গে আর ঝামেলা বাড়িয়ে কাজ নেই। সেদিন এগিয়ে যায়নি দেবযানী, সেই উন্নতিও হয় নি। আজ যদি এরকম একটা সুযোগ আসে আবার ন্যাশনাল সেলিব্রিটি হওয়ার, কেন সেই সোনালি ভবিষ্যৎ ছাড়বে সে?
বিকাশ কি কখনও চেয়েছে তাকে? চাইলে প্রথমেই সে তাকে বাধা দিত। শাসনে আদরে দেবযানীকে ধরে রাখতে পারত। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষার তাড়নায় সেও এগিয়ে গেছে, দেবযানীকেও ঠেলে দিয়েছে করবী হওয়ার পথে।
হ্যাঁ, আজ সে সত্যিই করবী। করবী লাহিড়ী হয়ে বাংলার প্রতিটি ঘরে যেতে পেরেছে সে। কুশল সাহার প্রস্তাবটা তা তাই সে একবাক্যে উড়িয়ে দিতে পারে নি। সে নিশ্চয় এগোবে, আজ রাতেই কথা বলবে বিকাশের সাথে।
অনেক রাত করে বিকাশ ফেরে। হাল্কা ড্রিঙ্ক করেছে বোঝা যাচ্ছে। ড্রয়িংরুমে বসে শুটিং এর স্ক্রিপ্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল দেবযানী। ভাবটা যেন, বিকাশকে সে দেখতেই পায়নি। বিকাশও বুঝতে পারে যে দেবযানী হয়তো কিছু বলতে চায়। দেবযানীও স্পষ্ট বোঝে বিকাশ তার কথা শুরু করার অপেক্ষায়। হঠাৎ করে দেবযানীর মনে হয়, আচ্ছা, এও তো একটা অভিনয়। স্ত্রী তার স্বামীকে কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু নিজের অনুভূতিগুলো ঢাকতে চাইছে কাগজপত্রের দিকে তাকিয়ে। আচ্ছা তার গোটা জীবনটাই এরকম অভিনয় হয়ে যাবে না তো?
হঠাৎ বিকাশের জড়ানো কণ্ঠস্বরে সচেতন হয় দেবযানী।
-কিছু বলবে?
-না, সেরকম কিছু নয়, গত কদিন ধরে মিঃ কুশল ফোন করছেন।
-ওহ্‌ দ্যাট পলটিশিয়ান? কিন্তু হঠাৎ?
ধীরে ধীরে কুশল সাহার প্রস্তাবের কথাটা জানায় দেবযানী এবং নিজের কাটা কাটা কথায় বুঝিয়ে দেয় যে সে সত্যিই আগ্রহী। প্রস্তুত হয় বিকাশের সাথে একপ্রস্থ কথা-কাটাকাটির জন্য। সে জানে বিকাশ বলবে সমুর কথা। সমুকে নিয়ে তুমি আর কথা বলতে এসো না বিকাশ, সমুর চিন্তা কোনদিনও তুমি করনি, আজও করতে হবে না, তোমার তো সময় নেই-ই, আমিও যখন সমুকে সময় দিতে পারছিনা, তখন ওকে কোন বোর্ডিং স্কুলে রেখে বা মায়ের কাছে রাখাই ভাল, তাছাড়া সমুর দায়িত্ব কি আমার একার? এসব কড়া কড়া কথায় নিজেকে সাজিয়ে নেয় দেবযানী, বিকাশকে মুখের ওপর জবাব দেওয়ার জন্য। দেখা যাক আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই......
-ওহ্‌, অলরাইট দেন।
দেবযানীকে কোন যুদ্ধের সুযোগ না দিয়ে বিকাশ ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দেয়। একটু ঠাট্টাও করার চেষ্টা করে...
-তাহলে, আমি আশা করতে পারি কিছুদিনের মধ্যেই পার্লামেন্টের সেই ফিউরিয়াস ঝগড়ায় নামবে আমার বউ- মাই বিলাভেড ওয়াইফ্‌।
অল্প হেসে আশ্বস্ত হয় দেবযানী। হাসিটা করবীর মতো নয় মোটেই, আন্তরিকতাও নেই আর আন্তরিকতার অভিনয়ও নেই।
রাতের মায়াবী আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অদ্ভুত এক চিন্তা মাথায় আসে তার। যেন করবী লাহিড়ী আবার জেগে উঠেছে। এগিয়ে যাচ্ছে রাজপথে। গলায় ফুলের মালা, হাতজোড় করে উদ্বেল জনতার মধ্যে দিয়ে হুডখোলা জিপে এগিয়ে যাচ্ছে পাক্কা জননেত্রীর মত।
রবিবার। আজ শুটিং নেই। সকালে বহু দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে দেবযানী। আকাশ মেঘলা। ছেলের ঘরে দেখে সমু কম্পিউটার গেম্‌স এ মত্ত। তাকে দেখে মুখ ফেরায় সমু।
-গুড মর্নিং মা।
-গুড মর্নিং সোনা।
করবী এগিয়ে যায় ছেলের খাটের দিকে, মমতা মাখানো গলায় প্রশ্ন করে-
-ব্রেকফাস্ট হয়েছে তোমার?
-হ্যাঁ, হাসিদিদি দিয়েছে। মা, প্রতিদিন হাসিদিদি ব্রেকফাস্টে টোস্ট করে কেন?
-কেন? তুমি কি চাও? কেক?
-নো, নট অ্যাট অল মম। কেক তো ডেইলি টিফিনে খাই আমি-হাসিদিদি দেয়। জানো, রাহুলের মম ওকে রোজ ভ্যারাইটিজ টিফিন দেয়। প্রতিদিন নতুন নতুন রান্না করে দেয়। সি ইজ ভেরী গুড।
-তোমার মম তোমাকে কিচ্ছু দেয় না, তাই না?
-ওহ্‌, তুমি কি করে দেবে? ইউ আর সো বিজি আই নো। আমাকে সেদিন মহুয়া ম্যাডাম জিজ্ঞাসা করছিল তোমার কথা। বলছিল সৌম্য, কি সুন্দর কথা বলতে পারেন তোমার মা, কি দারুণ লাগে ওনাকে, সি ইজ রিয়েলি গর্জাস।
-আর কি বলছিল তোমার ম্যাডাম?
-বলছিল তুমি কি ভীষণ ভাল, সবার কথা ভাব।
ছেলেকে ছোট থেকেই তারা শিখিয়েছে সেলিব্রিটির সন্তান হলে সেই চাপটা ঘরে বাইরে কি করে সামলাতে হয়, তাই কৌতূহলে প্রশ্ন করল-
-তুমি কি বললে?আমি বললাম, ধুৎ, সে তো সিরিয়ালের মম।
হঠাৎ সশব্দে বাজ পড়ে কাছেই কোথাও। বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের কাঁচের জানলা ঝন ঝন করে ওঠে। দেবযানী সজোরে জড়িয়ে ধরে সমুকে। বাজ পড়ার শব্দের চেয়েও সে জোরে শুনেছে অন্য দুটি শব্দ- সিরিয়ালের মম।
-মম, লিভ মি, কম্পিউটার শাট ডাউন করতে হবে, কি হল মম? ছাড়ো আমাকে, বাজ পড়ল তো? আর ইউ আফ্রেড? মম?
দেবযানী ছেড়ে দেয় তাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় টেলিফোনের দিকে। গাইড হাতে খুঁজতে থাকে কুশল সাহার ফোন নম্বর। তাকে নাবলতে আজ আর বাধবে না তার। করবীর কোন নিষেধ শুনবে না সে। খুব শিগ্‌গিরই আরো একটা ফোন করতে হবে তাকে। মিঃ ব্যানার্জীকে। পারিবারিকধারাবাহিকের জন্য একটা নতুন প্লট ভেবেছে সে, কার
অ্যাকসিডেন্টে করবী লাহিড়ীর ভয়াবহ রকমের আহত হয়ে যাওয়া এবং প্লাস্টিক সার্জারীর পর সম্পূর্ণ ভোল বদলে যাওয়া এক অন্য করবী- অন্য একজন।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই