Thursday, November 3, 2011

প্রাচীন বৃক্ষ -- অরণ্য

খুব ছোটবেলা থেকেই তাকে চিনতাম। আমাদের বাড়ির ছোট্ট উঠোনের এক পুরোনো পেয়ারা গাছ। সেই আমার আম্মার জিন ধরা নানির বড়ো আদরের পেয়ারা গাছ। যে নানি খুব সহজেই সাদা জিন
বা কালো জিনকে ভরে ফেলতেন একটা আশ্চর্য বোতলে। আর আমরা দুই ভাই আম্মার কাছ থেকে গোগ্রাসে গিলতাম সেই নানির গল্প। আমাদের অবাক করা সেই নানির কাছে এই পেয়ারা গাছ বেশ দুর্বল একটা জায়গা ছিল। সেই গাছের কোলে পিঠে চড়ে আমরা দুই ভাই মানুষ হয়েছিলাম। আমরা যখন খুব ছোট তখন এই গাছের বার্ধক্য জীবন শুরু হয়ে গেছে। সেই বুড়ো গাছে যখন বড় বড় পেয়ারা আসতো তখন তার মগডাল অবধি আমাদের দুই ভাইয়ের অবাধ যাতায়াত ছিল। সারাটা বেলা কেটে যেত, আম্মা হাজার বার নেমে আসতে বললেও কিছুতেই তার থেকে নেমে পড়তে ইচ্ছে করতো না। কতবার এই নিয়ে আম্মার হাতে মার খেয়েছি। তাতেও আমাদের কোনোদিন শিক্ষা হয়নি। সেই গাছে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে যখন পেয়ারা খেতাম..পাড়ার অন্যান্য ছেলেরা এসে
পেয়ারা চাইলে..হিংসে ভরে ঠিক জমিদারি ঢঙে তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খুব মজা করে পেয়ারায় কামড় দিতাম।
তারপর কত কত দিন কেটে গেলো..আমরা বড়ো হতে থাকলাম, সে বুড়ো। তার কাছে যাওয়া ক্রমশ কমে এলো। অনেক মুহূর্ত চলে গেলো..অনেক মান-অভিমান আমাদের না জানাই থেকে গেলো.. আমাদের পেয়ারা গাছেও আর আগের মত পেয়ারা আসে না। অসমর্থ তার এই রূপের কাছে সেই আদুরে চঞ্চল ছেলে দুটিও আর ধরা দেয় না। অভিমানের পরত কোথাও জমছে... তার খবর কেউ রাখে না।
মাঝে পর পর দুবছর আমাদের পেয়ারা গাছে কোনো পেয়ারা এলো না। পাতার অভাবে তার হাড়গিলে চেহারাটা ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে এলো। চারিদিকে শুরু ফিসফাস। কিছু কথা আড়ালে আমার কানেও এলো। বাড়িতে গাছটাকে কেটে ফেলার কথা উঠেছে। এতদিন পর দূরে এককোণে জীর্ণতায় পড়ে থাকা পুরোনো গাছটার কথা ভেবে আমার মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের সামনে ভাসতে থাকলো সেই সমস্ত -লৌকিক দুপুরগুলো দুঃসাহসিক পারাপারশীতঘুম কাটানো আস্বাদনগুলো হঠাৎ এই আকস্মিক ভাবী বিপর্যয়ের কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে উঠলো..
বুড়ো পেয়ারা গাছ বিদায় নিয়েছে। তার প্রত্যেকটা শাখা-প্রশাখা নিখুঁত ভাবে পেশাদার লোকেরা কেটে নিয়ে চলে গেছে। উঠোনের সেই প্রান্ত, তার হঠাৎ শূন্যতায় বিপর্যস্ত। আমরাও।
গাছটিকে কেটে ফেলার আগে দু’ বছর ধরে তার ফল আসেনি। বদলে ধীরে ধীরে সমস্ত পাতা ঝরে গেছে। যেন সে নিজেকে প্রস্তুত করছিল, এই বিদায়ের। অভিমানে,  জীবন থেকে যে নিজেকে এইভাবে ক্রমশ Withdraw করে নিয়েছিল সেই বুড়ো পেয়ারা গাছটিকে আমি চিনতাম। সে ছিল আমার ছেলেবেলার নিপুণ সঙ্গী। তাকে পৃথিবী থেকে ঝেড়ে ফেলার বছরে, ঠিক দু’ বছর নিষ্ফলা থাকার পর সে আবার শেষ বারের মত ফিরে এসেছিল। জীবনকে সে দিয়ে গেছিল তার শেষ সম্বল। শেষবারের মত তার শরীরে আবার আগের মতন ফল এসেছিল

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই