Thursday, November 17, 2011

বাঙ্ময় নৈঃশব্দ্য -- সুনন্দ


“The most terrifying fact about the universe is not that it is hostile but that it is indifferent; but if we can come to terms with this
indifference and accept the challenges of life within the boundaries of death- however mutable man may be able to make them- our existence as a species can have genuine meaning and fulfillment. However vast the darkness, we must supply our own light.”
- Stanley Kubrick
উপরের লেখাগুলো পড়ে কি মনে হলো? আঁতেল, তাই না? বিলক্ষণ! এই শতকের অন্যতম সেরা একজন দাড়িবাজ। (সত্যিই দাড়ি ছিল লোকটার, অন্তত যতগুলো ছবি দেখেছি।) ভদ্রলোকের অনেক ছবির মধ্যে একটা হলো-
2001: A Space Odyssey ভাবতে পারেন, মহাশূন্যে এক স্পেস-স্টেশনে আরেক স্পেস-শিপের ডকিং দেখানো হলো পাক্কা ১৫ মিনিট ধরে! সে তার যতই গভীর অর্থ থাক আর নেপথ্যে যতই জগদ্বিখ্যাত সুরের মূর্ছনা থাক না কেন। অথচ কি আশ্চর্য! সেই কোন ১৯৬৯ সালে তৈরি সিনেমা এতদিন পর দেখতে বসেও মনে হয়, কি করে করেছিল লোকটা? হাঁ হয়ে যেতে হয় এখনো। এ দেখলে তর্ক উঠতে বাধ্য, যে কোন পরিচালক যদি শুধু সৌন্দর্যের জন্যেই খরচ করতে চান একটা গোটা সিনেমা, তবে তাতে কি অর্থ যোগ করা সম্ভব? নাকি ভবিষ্যৎ তা দেখতে বসে মাঝপথে উঠে চলে যাবে- এই সব মিলিয়ে মনের মধ্যে যে নিরাকার একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ রূপ পেল এই সেদিন রাতে, যখন বারাকা (Baraka, ১৯৯২) দেখলাম।
বারাকা, দেড় ঘণ্টার নিশ্ছিদ্র অভিজ্ঞতা। সিনেমা –এই আর্ট ফর্মের অর্ধেক-ই ব্যবহার না করে, অর্থাৎ সংলাপ, অভিনয়, এসব না রেখেও যে কি অনবদ্য চলচ্চিত্র অভিজ্ঞতা নির্মাণ করা যায়, বারাকা না দেখলে জানা হতো না। বিষয়, পটভূমি, নায়ক, বক্তব্য- সব কিছু এখানে পৃথিবী। আর হ্যাঁ, তার বুকে বিচরণকারী এক শ্রেণীর বানর। সবচেয়ে শক্তিশালী, সবথেকে বুদ্ধিমান, আর একই সঙ্গে নির্বোধ মানুষ। Kim Sterelny-র ভাষা ধার  করতেই হয়, বারাকা হল সেই গভীর প্রশ্ন- ‘how we can be simultaneously so smart and so dumb!’ নাঃ, বারাকা কি আমি বলার কেউ নই। যে কোন ভাল কবিতার মতো, আমি নিশ্চিত এই সিনেমা প্রত্যেককে তার নিজের মতো করে ছুঁয়ে যাবে। কি বলতে পারি এর সম্পর্কে? অসাধারণ ফটোগ্রাফি, নিখুঁত নেপথ্য সঙ্গীত, অতুলনীয় চিত্রনাট্য- এ সবই হতেই হতোর মত শোনাবে। আমি বরং ছোট্ট কিছু অংশ বর্ণনা করি, কেমন?
আমার কাছে যে প্রিন্টটা আছে, তার প্রায় ৪১ মিনিট থেকে প্রায় ৫০ মিনিট, মানে সাকুল্যে ৯ মিনিট সময় পরিচালক খরচা করেছেন শিল্পায়ন আর নগরায়ণ দেখাতে। পটভূমি, এই দুই বিষয়ের শেষ কথা- জাপান। নেপথ্যে দ্রুত ছন্দের percussion, যেমনটা বিদেশে রাস্তার ধারে উঠতি শিল্পীদের কাছে শোনা যায়। টাইম-ল্যাপ্স ক্যামেরায় ধরা পড়ছে জনবহুল টোকিয়ো শহরের এক বড় রাস্তা। ছন্দে ছন্দে ঘুরে চলে গাড়ি, তার ফাঁকে ফাঁকে মানুষ। অন্য ভঙ্গীতে মানুষের ছন্দোবদ্ধ গতি দেখে আপনি যখন হাঁ, ঠিক তখনই চমকে দিয়ে দেখা দিল এক বিরাট পোল্ট্রির অন্দর। কনভেয়ার বেল্টে থিকথিক করছে মুরগিছানা, আলাদা আলাদা খোপে পাঠানো হচ্ছে তাদের। এক মুহূর্ত বিশ্রাম না দিয়ে পরবর্তী দৃশ্য- জাপানী মেট্রো স্টেশনে এস্কালেটর থেকে নেমে মানুষ বেরোচ্ছে গেট দিয়ে- গায়ে কাঁটা দেওয়া মিল দেখে শিহরিত আপনাকে আরও চমকে দিল পরের দৃশ্য- সারে সারে বসে আছে বড় বড় মুরগি, আলাদা আলাদা খোপে- এর সঙ্গে ঠিক কি দেখালে আঁতকে উঠবেন আপনি, জানেন পরিচালক; দেখানো হল ক্যাপ্সুল হোটেল।
আপনি যদি আমার মতো কল্পনা-বিলাসী হন, তবে এই অপার পৃথিবীর সৌন্দর্যে ভিজতে ভিজতে অন্য কোন জগতে চলে যাওয়া আশ্চর্য নয়। বালি দ্বীপের রোমাঞ্চকর ‘Kecak’ (কোরাসে বানর ডাক) শোনার সময় যেমন আমি হাঁ করে ভাবতে বসেছিলাম, আচ্ছা, এদেরই পূর্বপুরুষ কি যুদ্ধ করেছিল এক ভারতীয় রাজার হয়ে, এক সিংহলী রাজার বিরুদ্ধে? অথবা, কুয়েতের তেলের আগুন দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, এর সঙ্গে কিসের মিল আছে ভেবে- নরক, নাকি রাবণের চিতা? কিন্তু শেষ অবধি বারাকা আপনাকে বাধ্য করবে বিষয়ে ফিরে আসতে। শেষ অবধি ভাবতে বাধ্য হবেন, আমরা কি সত্যিই বুদ্ধিমান? নাকি Sterenly-র কথামতো ‘‘perversely intelligent’?
ইন্টারনেটে বারাকার সমস্ত রিভিউ বলে এর implicit religious theme এর কথা। আমার কিন্তু তা মোটেও মনে হয়নি। পৃথিবীর সমস্ত কোণে মানুষের ধর্মাচরণ দেখানো মানেই কি religious হওয়া? মানতে পারলাম না। আমার বরং মনে হয়েছে, এই বিপুলা প্রকৃতির সামনে দাঁড়ালে যে মৌনতা আসা উচিত, তাতেই পরিচালক জোর দিয়েছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অনুষঙ্গ এনে। আর বাকি যত আড়ম্বর, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, তাতে সমন্বয়ের বাণীর সাথে মিশে ছিল- ‘To an evolutionist, religious rituals ‘stand out like peacocks in a sunlit glade’’-এই বোধ। মানুষই হয়তো এই গ্রহে একমাত্র প্রজাতি, যার আত্মমগ্ন আচরণের মধ্যে নিহিত নিজের উৎস ভুলে প্রকৃতির প্রতি শীতল ঔদাসীন্য। এবার একবার একদম প্রথমে লেখা উদ্ধৃতিটা পড়ুন, একমত হলে জানবেন ‘the feeling is mutual’- ওই একই ঔদাসীন্য আমাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে প্রকৃতি।
প্রথমে বলেছিলাম না, ওই তর্কের কথা- আমার ব্যক্তিগত মত, বারাকা দেখতে বসে কোন প্রজন্মেরই উঠে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ যদিও 2001…odyssey এর মতো এও চিরন্তন সত্যের কথা বলে- সঙ্গে এর তুরুপের তাস- নিছক বাস্তবের দৃশ্যায়ন। ১৯৯২ তে তৈরি এই সিনেমা দেখলে যত না কি করে করল, তার থেকেও অনেক বেশি অবাক করে- কি করে দেখাতে পারল এভাবে?
বারাকা কথাটার মানে আশীর্বাদ, তাও কোন একটি ভাষায় নয়, অনেক ভাষায়। পরিচালক Ron Fricke স্বনামধন্য Cinematographer, নিজের তৈরি ক্যামেরা ব্যবহার করেন ছবি তোলার সময়। এ রকম সব তথ্যই জানতে পারবেন গুগ্‌ল্‌ এ খোঁজ করলে, কিন্তু দয়া করে you-tube এ দেখবেন না সিনেমাটা। Photography প্রধান বিষয়, তাই সবচেয়ে ভাল হয় ব্লু-রে প্রিন্ট দেখলে, না  পেলে ডিভিডি তে দেখুন। কথা দিচ্ছি, কান- চোখ জুড়িয়ে যাবে। আর বেশি কথা বলে লাভ কি? আগে দেখে না থাকলে তাড়াতাড়ি দেখে ফেলুন, আর পারলে আমাদের ফোরামে জানান আপনার অভিজ্ঞতা, মন্তব্য।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই