Monday, December 5, 2011

'উস্তাদ জিন্দা রহেগা' -- শ্রীজিত

সব ছবি: শ্রীজিত
আচ্ছা বেনারস-এর কথা বললে সবার আগে কি মনে পড়ে বলুন তো? বিশ্বনাথ মন্দির বা
দশাশ্বমেধ ঘাট? অথবা জয় বাবা ফেলুনাথের টুকরো দৃশ্য? আর? আরে আসল কথাটাই তো ভুলে গেলেন। বেনারস এর সঙ্গীতসম্ভার? গোটা দুনিয়ায় এই বিশাল সম্পদের তুলনা মেলা ভার! ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত এর আকাশে বহু উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কই বেনারসের জলবায়ু সেবন করে লালিত পালিত হয়েছেন। যদিও বেনারসকে আমরা মূলত ধর্মীয় স্থান হিসেবেই গুরুত্ব দিয়ে থাকি কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হয় ওখানকার জলহাওয়ার কিছু একটা বিশেষ গুণ রয়েছে না হলে ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর মতো লোক এত খ্যাতি, যশ পেয়েও যথেচ্ছ বিলাসিতার সুযোগ ত্যাগ করে কেন
নিজের ভিটে ছেড়ে নড়তে চাননি একবারের জন্যও? মনে মনে ভেবেছিলাম যদি কখনো সুযোগ পাই তাহলে ওঁর সাথে বেনারসের বাসস্থানেই একবার দেখা করবো। কিন্তু ২১শে আগষ্ট ২০০৬ এ উনি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চিরতরে বিদায় নিলেন! ফলে ওঁকে একবার চোখে দেখার আশাও শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে বিসমিল্লা খাঁর বাস্তুভিটে দর্শন করার একটা সুযোগ এসে গেছিল তাঁর মৃত্যুর পরের বছরেই।
তখন সবেমাত্র হাই এনার্জি ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি কলকাতার সাহা ইনস্টিটিউটে।  বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি তে SERC-School এর আসর বসেছে। পড়াশুনোর অভ্যেসটা তখনো ছিল তাই স্কুলে যেতে খুব অনিচ্ছা করলো না। সাহা ইনস্টিটিউট থেকে আমি, রানা আর  রাজাবাজার সাইন্স কলেজ থেকে অমিত তিনজন একসাথেই গিয়েছিলাম। আমরা তিনজনই যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে সেই ২০০১ থেকে এক ক্লাস শেয়ার করে এসেছি। তাই আবার একসাথে হওয়ার সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া রতে চাইনি। স্কুল চলাকালীন আমরা বার দুয়েক সন্ধ্যারতি দেখতে দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়েছিলাম। কিন্তু আসল জায়গায় যাবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল স্কুল শেষ হবার পরের দিনটা অবধি কারণ স্কুলের চাপে সময় পাওয়া যাচ্ছিল না।  তারিখটা ছিল ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৭। আমাদের ফেরার ট্রেন ছিল সন্ধ্যাবেলা। তাই গোটা দিনটা হাতে ছিল। সেদিন আমরা হোটেল থেকে অটো ধরে সকাল-সকাল দশাশ্বমেধ ঘাটে পৌঁছে গেছিলাম। ঘাটে পৌঁছে প্রথমে আমরা নৌকো করে গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করতে শুরু করলাম। তার আগে অবশ্য আমাদের জয় বাবা ফেলুনাথ এর মগনলাল মেঘরাজের বজরার মতো এক ঢাউস বজরা করে ঘোরানো হয়েছিল স্কুলের পক্ষ থেকে। কিন্তু তাতেও মন ভরেনি আমাদের তাই সেদিন নিজেদের মতো করে ঘুরবো বলে আবার নৌকায় চড়ে বসলাম। 
নৌকার মাঝিদের থেকে নানান তথ্য জানবার চেষ্টা হল। ঘাটে ফিরে এসে মন্দিরের গলিতে ঢুকে খবর নিতে শুরু করলাম বিসমিল্লা খাঁ, রাজন‌‌ ও সাজন মিশ্র প্রমুখ শিল্পীদের বাড়ি কীভাবে যাওয়া যাবে। আমার ইচ্ছে ছিল বেনারসের গানবাজনা কিছু সংগ্রহ করার, বিশ্বনাথ মন্দিরের গলিতে কয়েকটা সিডি, ক্যাসেটের দোকানও পেয়ে গেলাম। সেরকমই একটা দোকানে ভালো স্টক দেখে ঢুকে পড়লাম। শুধু যে সিডি কেনার উদ্দেশ্যই ছিল তা নয়, আসলে কেউ কি বিনে পয়সায় আজকাল সাহায্য করতে চায়? তাই প্রথমে কিছু ওঁর পছন্দমতো গানের সিডি দেখাতে বললাম। উনি পণ্ডিত ছানুলাল মিশ্রের কিছু সিডি দেখালেন। কয়েকটা আমার পছন্দও হল, কিনে নিলাম। দোকানদার তো খুশি হল এবার আমাকে অথেন্টিক খবর নিতে হবে। দেখলাম এটাই সেরা সুযোগ আর চেষ্টায় সফলও হলাম। দোকানদার সাগ্রহেই আমাদের বিসমিল্লা খাঁর বাড়ি যাবার রাস্তা এবং কীভাবে যেতে হবে বলে দিলেন। ব্যস, আমরা তিনমূর্তি বেরিয়ে পড়লাম। একটা অটোরিকশা করে আমরা নামলাম বেনিয়া বাগের কাছে। তারপর টিপিকাল বেনারস মার্কা অলিগলির ভিতর হাঁটতে থাকলাম আর মাঝে মাঝে স্থানীয় লোককে জিজ্ঞাসা করলাম। মনে তখন নিদারুণ উত্তেজনা অনুভব করছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দর্শন হবে ভারতের এক কিংবদন্তি শিল্পীর সাধনক্ষেত্র! চলতে চলতে হঠাৎ ধাক্কা খেলাম সেই প্রবাদপ্রিতম সানাইবাদক এর নামাঙ্কিত লেটারবক্সে
আমরা প্রথমটায় একটু থ হয়ে গেছিলাম। সানাইসম্রাটের বসতবাড়ি যে এত সাধারণ হতে পারে আমার ধারণা ছিল না! এই বাড়িতেই উনি থাকতেন? অমিত বাইরের দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরের লোককে ডাকার চেষ্টা করছিল। বাড়ির সামনে গলিতে কিছু বাচ্চা খেলছিল, ওরা আমাদের দেখে খাঁ সাহেবের বাড়ির লোকদের জানালো যে বাইরে আমরা অপেক্ষা করছি। একটু পরে এক কিশোর দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আমরা বললাম কলকাতা থেকে এসেছি খাঁ সাহেবের বাড়ি দেখতে। ছেলেটি কি বুঝলো জানিনা আমাদের ভিতরে আসতে বলে বসতে বলল। আমরা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেই যে ঘরটা দেখলাম সেটাকে একটা ছোট্ট মিউজিয়াম বলা চলে। খাঁ সাহেব জীবনে যত পুরস্কার পেয়েছেন তার অভিজ্ঞান পত্র সাজিয়ে রাখা রয়েছে ওই ছোট্ট বৈঠকখানায়
আমরা তিনজনেই তখন ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে হাঁ হয়ে গেছি। রানার ডিজিটাল ক্যামেরাটা সঙ্গেই ছিল। অমিত ওটা নিয়ে ছবি তুলতে লাগলো। এই প্রথম কোনো ভারতরত্নের বাড়িতে পা দিলাম। আমাদের যে কোনো আনন্দানুষ্ঠানে যে মানুষটার উপস্থিতি অপরিহার্য, বিশ্ববাসী যাঁর সানাই এতদিন যাবৎ চেটেপুটে খেয়ে এসেছে আমরা তাঁর বাড়িতে বসে আছি, ভেবেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল! সেই ছয় বছর বয়স থেকে এই বারাণসীতেই তাঁর সঙ্গীত জীবনে প্রবেশ কাকার হাত ধরে। তারপর তো ইতিহাস! আমৃত্যু তিনি এই ভিটে ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি এমনকি মৃত্যুশয্যায় ভারত সরকারের তরফ থেকে দিল্লিতে চিকিৎসা করার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন, বারাণসীতেই নিজের দেহ রাখবার উদগ্র বাসনায়। বিসমিল্লা খাঁর বড় ছেলে নায়ের হোসেন খাঁর মুখ থেকে আমরা শুনছিলাম ওঁর বেনারসের প্রতি ভালোবাসার কথা। নায়ের সাহেবকে আপনারা চেনেন, অনেকদিন ধরেই বাবার সহশিল্পী হিসেবে স্টেজে বাজিয়েছেন। 
বলছিলেন, আমরা যে বিছানার পাশে বসে আছি তার উপর বসেই নাকি উনি রেওয়াজ করতেন, বাজাতেন। শুনে কেমন একটা অনুভূতি হল বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের খুব সমাদর করলেন নায়েরজি। আর যে কিশোর আমাদের দরজা খুলে দিয়েছিল সে আর কেউ নয় নায়ের হোসেনের পুত্র। যাবার আগে অনুরোধ করলাম ওঁর বাবার সৃষ্টি করা কিছু একটা শোনাতে। নিরাশ করেননি। আমরা রেকর্ড করে নিয়েছিলাম তার গাওয়া ললিতের মুখড়া (ভিডিও)। বিদায়লগ্নে মনে হচ্ছিল যে উনি হয়তো সশরীরে আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তাঁর সানাই এর সুর তো আমাদের কানে বেজেই চলেছে! ভাবছিলাম উস্তাদজি যথার্থই বলে গেছেন
'সেহনাই গুঞ্জতি রহেগি      সুর সজতা রহেগা
উস্তাদ জিন্দা রহেগা।'

(১ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ভিডিও)

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই