Monday, March 21, 2011

বর্ণপরিচয় (শেষাংশ)

(আসল লেখার লিঙ্ক)
চট করে আরেকটা জনপ্রিয় পরীক্ষা দেখে নিন, পাঠক, নিচের ছবিটার দিকে তাকিয়ে। কোনটা ছেলের আর কোনটা মেয়ের মুখের ছবি?



সবাই বলবেন, বাঁ দিকেরটা মেয়ের আর ডান দিকেরটা ছেলের। কিন্তু কেন? যে গবেষকরা এই ছবিদুটো বানিয়েছেন, তাঁরা একটাই ছবি নিয়ে সামান্য হেরফের করে দুটো ভার্শন বানিয়েছেন, অতএব স্পেশাল কোনো পুরুষসুলভ দৃঢ় চোয়াল ইত্যাদি ক্লু নেই আমাদের জন্য। তাহলে কী দেখে আমরা সবাই একই উত্তর দিচ্ছি? 

আরেকবার ভালো করে দেখলে আপনারা নিজেই ধরতে পারবেন, বাঁ দিকের ছবিটায় কেবল ডানদিকের চেয়ে একটু ব্রাইটনেস বাড়ানো, মানে হালকা রঙের। কিন্তু সেটাই সব নয় – আরেকটা মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্লু, যেটা আপনার অবচেতন মন ধরতে পারলেও সচেতন মন হয়ত বলতে পারছে না, সেটা হল – ‘মেয়ে’টির ছবিতে মুখের বাকি অংশের সঙ্গে চোখ ও ঠোঁটের কনট্রাস্ট বাড়ানো। অর্থাৎ, তার মুখের বাকি অংশ ‘ছেলে’টির ছবির তুলনায় হালকা রঙের হলেও, চোখের চারপাশ ও ঠোঁট বেশি গাঢ় রঙের। দুটো ছবির ব্রাইটনেসের বিয়োগফল দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার, কারণ যদি এই ‘ফেশিয়াল কনট্রাস্ট’ ব্যাপারটা যোগ না করা হয়, তাহলে কিন্তু স্রেফ হালকা-গাঢ় রঙের তারতম্য করলে লোকে ছবি দুটোয় ছেলে-মেয়ের তফাত করে না।

এইবার ভেবে দেখুন, মহিলাদের প্রসাধনীদ্রব্য ঠিক এই কাজটাই করে না কি? চোখের চারিপাশে কাজল টেনে চোখটাকে হাইলাইট করা হয়, ঠোঁটে লাল রঙের লিপিস্টিক দিয়ে ঠোঁটের সঙ্গে গালের কনট্রাস্ট বাড়ানো হয়, এবং একই সঙ্গে আরেকটা দিকও ম্যানেজ করা হয় – নিওটেনি – কারণ চকচকে, গোলাপি-লাল ঠোঁট হচ্ছে, ‘কচি ঠোঁট’ যাকে আপনি সারারাত চুম্বন করে করে লালা-চা পান করতে লোলুপ থাকেন, তারই ইঙ্গিত। আর গালে স্নো (ট্যালকম পাউডার) বা ব্লাশ দিয়ে যে হালকা রঙের rosy cheeks আনতে চান, সেটাও কিন্তু এই ব্যাপার – গালের ব্রাইটনেস বাড়ানো আর একই সাথে শিশুসুলভ টোপাটোপা নরম লাল গাল আনার চেষ্টা।

অর্থাৎ মেক-আপ আর কিছুই নয়, এই ‘নারীসুলভ’ ফিচারগুলো হাইলাইট করে যৌবনবতী সাজার চেষ্টা। আর এগুলো বেশি করে চোখে পড়ে মানে দৃষ্টিকটু হয় যখন বৃদ্ধারা তেড়েফুঁড়ে মেকাপ করেন – নিচের সোফিয়া লোরেনের ছবিটা দেখলেই প্রতিটা ফিচার খুব স্পষ্ট নজরে পড়বে। অনেকে তো এত টকটকে লাল ঠোঁট বানান যে পরশুরামের ভাষায় যেন ‘তাড়কা রাক্ষসী সদ্য ঋষি খেয়েছে’।



 তাহলে, গায়ের রঙের ইতিহাস খুব সংক্ষেপে:



মধ্য (সাব-সাহারান) আফ্রিকায় নানা কারণে আদিম মানুষ ও গ্রেট এপ-দের মধ্যে ন্যাচারাল সিলেকশনের জন্য কালো রঙ এক্কেবারে ফিক্সড। কিন্তু তারা যখন উত্তরদিকে মানে এশিয়া মাইনর/আরবে এবং তা থেকে আরো উত্তর-পশ্চিমে ইউরোপ এবং উত্তর-পূর্বে মধ্য/পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, তখন সেই ফ্যাক্টরগুলোর চাপ কমে যাওয়ায়, পুরুষদের হালকা রঙের প্রতি আকর্ষণ জনিত কারণে পপুলেশনে হালকা চামড়ার অনুপাত বাড়তে লাগল, এবং ক্রমে রানঅ্যাওয়ে সেক্সুয়াল সিলেকশনের ঠেলায় গোটা পপুলেশনেরই চামড়ার রঙ বদলে যেতে লাগল। এরই মাঝপথে, মধ্য/পূর্ব এশিয়া থেকে হালকা বাদামি চামড়ার লোকজন পলিনেশিয়া/অস্ট্রেলিয়া ও বেরিং প্রণালী হয়ে আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এবং সেক্সুয়াল সিলেকশন একটা প্রবল শক্তি বলেই, তারা আবার ক্রান্তীয় অঞ্চলের কাছাকাছি ফিরে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের গায়ের রঙ আবার ঘন কালো হয়ে যায় নি। শুরুর ওই ছবিটায় ব্রাজিল ইত্যাদি অঞ্চলে তাকিয়েই দেখুন না। 

এবং পুরুষেরা একাধিক কারণে হালকা রঙের প্রতি আকৃষ্ট। তার একটা হল বৈচিত্র্য কামনা, তা আগেই বলেছি। তাই আজকালকার সায়েব সমাজে আবার গমরঙা ভারতীয়/ল্যাটিনা নায়িকাদের ভারি কদর। আরেকটা হল, যথারীতি, নিওটেনি – বাচ্চারা যখন জন্মায়, তখন তাদের গায়ের রঙ কেমন ফুটফুটে গোলাপি থাকে, কিন্তু বয়সের সাথে সাথে গায়ের রঙ কালোতর হতে থাকে। তাই হালকা রঙও কচিত্বের লক্ষণ – বস্তুত, সিলেকশনের ঠেলা এমনই, মেয়েরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে নারী-হরমোনগুলোর প্রভাবে তাদের রঙও সামান্য হালকা হয়, চামড়ায় ফ্যাট বাড়ার কারণে। আবার অবস্থাগতিকে মেয়েদের মাঠেঘাটে কাজ করা কমল আর বাসায় থাকার দায় বাড়ল, তাই তাদের রোদেজলে খাটার অর্থাৎ মেলানিনের সুরক্ষার প্রয়োজনও কমল (যারা মাঠেঘাটে খাটে, তাদের চামড়া ট্যান হয়ে যায়, দেখেননি?)। সব মিলিয়ে, প্রতিটি জনগোষ্ঠীতেই মেয়েদের গড় মেলানিনের পরিমাণ পুরুষদের চেয়ে বেশ খানিকটা কম, মানে তারা বেশি ফর্সা। 


পার্ট – ৩
লেখাটা ইতিমধ্যেই অনেক লম্বা হয়ে গেছে, কিন্তু রঙের প্রসঙ্গে এসে চুলের/চোখের রঙের কথাটা না বলা অন্যায়ই হবে। তাই অল্প করে আলোচনা করি।


কটা চোখ বা ‘বেড়ালচোখ’ এর সঙ্গে আমরা সবাইই অল্পবিস্তর পরিচিত আমাদের দেশে, না হলেও বিদিশি নায়ক-নায়িকা যেমন এলিজাবেথ টেলরের ঘন নীল চোখ বা কেট উইন্সলেটের সবুজ চোখ সকলেই চেনেন। 
একাধিক জিন এর পেছনে দায়ী, তবে সংক্ষেপে বলা যায়, আমাদের চোখের মণির যে ঘন খয়েরি, প্রায়-কালো রঙ, তাও আসে সেখানে জমা মেলানিন থেকেই। কারো চোখে মেলানিন কম উৎপাদিত হলে হালকা বাদামী (honey/olive বলে ইঞ্জিরিতে), আর একদমই না হলে ধূসর/নীল/সবুজ, অন্য কিছু পদার্থের হেরফেরে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, কেন আমাদের এদিকে প্রায় সবারই চোখ কেবল কালো, আর রঙিন চোখ কেবল উত্তর ইউরোপের ফর্সা সায়েবদের মধ্যেই দেখা যায়। ইউরোপে ওই জিনগুলোয় মিউটেশন শুরু হবার পর, পুরুষদের বৈচিত্র্যের লোভের টানে পপুলেশনে ছড়িয়ে পড়ে ভালোরকম, সেই পুরনো গল্প।

(আর ইয়ে, চোখের রঙ তাই মোটাদাগে মেন্ডেলের সূত্র মেনে চলে, যেখানে নীল রঙ হল রিসেসিভ। বুঝতেই পারছেন, আপনার দু কপি জিনের প্রতিটাই যদি চোখকে মেলানিন দিতে গররাজি হয় তবেই চোখের নীল রঙ আসবে।)


রঙিন চোখের ক্ষেত্রে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ফিচার খুব সহজে ধরা পড়ে। মণির চারপাশে একটা কালো বর্ডার দেখতে পাচ্ছেন? ওইটাকে বলে লিম্বল রিং। বাচ্চা বয়সে বেশি থাকে, বয়স বাড়লে সেটার ঘনত্ব কমে যেতে থাকে। এইটাও নিওটেনির ইঙ্গিত, এবং তাই আমরা বিবর্তিত হয়েছি লিম্বল রিংকে পছন্দ করতে করতে। এতটাই, যে নকল রিং-ওয়ালা কনট্যাক্টও বিক্রি হয়, চোখের সৌন্দর্য বাড়াতে!
 ************************* 


চুলোচুলি করে শেষ করি। চুলের রঙও আসে মেলানিন থেকেই, তাই চোখেরই মত, মূলত উত্তর ইউরোপিয়ান মেলানিন-অভাবী সায়েবদের মধ্যেই ব্লন্ড-প্ল্যাটিনামব্লন্ড- ব্রুনেট এইসব দেখা যায়। (ব্রুনেট বলতে এরা কখনও খয়েরি, কখনও গাঢ় খয়েরি, প্রায়-কালো বোঝায়, পাঠক একটু সাবধান থাকবেন।)
মোটামুটি, চোখের মতই, স্ক্যান্ডিনেভিয়া/উত্তর ইউরোপের বাইরে চুলের রঙের বৈচিত্র্য দেখা যায় না। কারণ, যদি শুরুতে কোনো ওইরকম মিউটেশনের উদ্ভব না-ই হয়, সিলেকশন কাজ করবে কী করে? তবে, চুলের ক্ষেত্রে ওরকম নতুন মিউটেশনের উদ্ভব অন্তত দুবার দেখা গেছে, যেখানে সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল, অবশ্যই লুল্পুরুষদের ঠেলায়। এক হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে পলিনেশিয়া বিশেষত পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ব্লন্ড চুলের একটি ধারা, যা ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আর দ্বিতীয়, ব্রিটেনের উত্তর অংশে লাল চুলের উদ্ভব (শার্লক হোমসের বিখ্যাত গল্পটা মনে আছে নিশ্চয়ই?)।


 ************************* 
পাদটীকা:
(১) এবারও যা দেখা গেল, রং-সংক্রান্ত সিলেকশনেও মূলত পুরুষদেরই দাপাদাপি। সেক্সুয়াল সিলেকশনের মধ্যে নারীরা কীভাবে প্রভাব ফেলে, তার ঠেলায় ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’ থেকে ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি’ এতসব প্রবাদের উদ্ভব কেন, পরের পর্বে দেখব নাহয়।(২) Social stereotypes create their own reality – কথাটা বড় খাঁটি!(৩) এবারে মোট ১৯টা ছবি আছে, সব দেখা যাচ্ছে কিনা বলুন...

এই লেখা আগে সচলায়তনে লেখকের নিজের ব্লগে প্রকাশিত। এখানে আবার লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হলো।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই