Monday, January 2, 2012

ফালতু সাক্ষাৎকার -- কূপমণ্ডূক

মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, অমলদা, তুমি যেখানেই থাকো, এক্ষুনি সেকেন্ড ফ্লোরে দেখা কর......”।

শেষ না হওয়া চায়ের কাপটা ছুঁড়ে ফেলেই অমলদা ছোটে, সঙ্গে ফোল্ডিং হুইলচেয়ার। এখন ঠিক কি করতে হবে সে জানে না, আবার জানেও। হয়তো কোন পেশেন্টের ছুটি হয়েছে, তাকে চেয়ারে বসিয়ে ট্যাক্সি পর্যন্ত ছেড়ে আসতে হবে, অথবা পেশেন্ট কে অন্য কোন বেড-এ shift  করাতে হবে, বা হয়তো...... চেয়ারটা কোন কাজেই আসবে না, স্ট্রেচারে দু’হাত লাগিয়ে সোজা মহাপ্রস্থান।
খুব রোগা-মাঝারি হাইট, বয়স প্রায় ৪৫, পরনে সবসময় ফিকে নীল রঙের uniform। বাড়ি তার কলকাতায় নয়, সে অনেক দূর। পারিবারিক পেশায় সে নাপিত। বারো বছর হল বাড়ি ছেড়েছে। এখন নার্সিংহোমের অন্য সব স্টাফেদের সঙ্গে পাশেই একটা মেসে থাকে। রোজ সকাল আটটা থেকে তার দম ফেলার উপায় নেই। হাসপাতালের বুড়ো-বাচ্চা নির্বিশেষে সকলেই তাকে অমলদা বলেই ডাকে, এমনকি ডিরেক্টর পর্যন্ত। ইউনিটের কোনো কাজই যেন তাকে ছাড়া হয় না। অথচ লোকটাকে কখনো বিরক্ত হতে দেখছি না। কথায় কথায় জানতে পারলাম, সিনেমার মত চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে তার এই মহানগরীতে আসা, আর কয়েকদিনের মধ্যেই সব স্বপ্নভঙ্গ। বহু রাত কেটেছে হাওড়া স্টেশনে। না বিনিদ্র নয়, একটা কাজের জন্য ঘুরতে ঘুরতে রাত্রিবেলা চোখ জুড়িয়ে আসত নিমেষেই। তারপর......তারপর সবটা আমাকে বলেনি। এখন সে কলকাতার এক নার্সিংহোমের কর্মী। ঠাট্টা করে বললাম, বেশ তো বাড়িতে ছিলে, বউ-বাচ্চা নিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নিচ্ছিলে। কি দরকার ছিল এতো চাপ নেওয়ার। অমলদা আমাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ধুৎ, আমার ভাগ্য তাও অনেক ভালো... একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছি। এখনো কত লোক স্টেশনে রাত কাটায় জানো? আচ্ছা তা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু কাজ যখন পাচ্ছিলে না তখন স্টেশনে না থেকে বাড়ি চলে গেলেই তো পারতে। বাড়িতে ঝামেলা-টামেলা করে পালিয়ে আসো নি তো? অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, সে আর কোন উত্তর দিল না। শুধু মুচকি হেসে বলল, চলি। কাল আসছ তো? ফেরার পথে অমলদার মতো করে একবার ভাবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারিনি।
পরদিন নার্সিংহোমে আবার গেলাম......আমার এক নিকটআত্মীয় সেখানে ভর্তি ছিল। সবকাজ সেরে ক্যান্টিনে যাচ্ছি, তখন দেখি অমলদা ছুটতে ছুটতে নিচে নামছে। কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করায় শুধু বলল, 412। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাড়া দেখে সরে গেলাম সিঁড়ির পাশে। লাঞ্চ সেরে একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আমার এখন আর কোনো কাজ নেই। ডাক্তারের সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে, কিন্তু সেটাও রাত আটটার আগে হবে না।
এখানে স্বাভাবিক ভাবেই কাউকে চিনি না। শুধু অমলদার সঙ্গে একদিনেই বেশ খানিকটা আলাপ হয়ে গেছে, ওই চা-সিগারেট পর্যন্ত। তখন প্রায় দুপুর দু'টো হবে। চত্বরে লোকজন প্রায় নেই, চারিদিক নিশ্চুপ। চেয়ারের পিছনের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছি, তখনই দেখি কয়েকজন লোক চেঁচামেচি করতে করতে বেরিয়ে আসছে। পিছনে নির্বিকার মুখে অমলদা, হুইলচেয়ারে সদ্য ছুটি পাওয়া পেশেন্ট। সে কোথাও না থেমে সোজা চলে গেল এম্বুলেন্সের গ্যারাজের দিকে। ফেরার সময় একবার ডাকলাম। হাত তুলে ইশারায় বলল, একটু দাঁড়াও। এদিকে ছুটি পাওয়া রোগীর বাড়ির লোকেদের হাসিঠাট্টায় চত্বরটা বেশ গমগম করছিল। সবার মুখেই একটা খুশির রেশ। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার যে কি আনন্দ, তা আমি জানি। এদের দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আরও একটা জটলা বেরিয়ে এলো লিফট থেকে। হয়তো আরও একজনের ছুটি হল। তাকিয়ে দেখি, অমলদা আর একজন স্ট্রেচারে করে একটা মুখঢাকা দেহ নিয়ে নিঃশব্দে গ্যারাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, পিছনে মৃতর আত্মীয়স্বজন। এরা অত্যন্ত সভ্য লোক, জনসমক্ষে শব্দ করে কাঁদে না। শুধু একটু চাপা গলায় কান্নার শব্দ কানে এলো।
  গত দু’মিনিটের অভিজ্ঞতা......আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না...... জীবন-মৃত্যু পাশাপাশি দুটো এম্বুলেন্সে ......!!! উত্তেজনা-ভয়-অস্বস্তি...... সবকিছু মিলিয়ে আমার পা সরছিল না। সম্বিৎ ফিরতেই আবার চেয়ারে গিয়ে বসলাম। খানিকপরে অমলদা পাশে এসে বসল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা এই কাজ করতে তোমার কেমন লাগে? বলল, পেশেন্ট মারা গেল তাই প্রশ্ন করছ? দেখো, কত লোকই তো দিব্যি বেঁচে ফিরে যায়, দু-একজন তো মারা যেতেই পারে। এই সহজ সত্যিটা ওর মুখে শুনে দারুণ লাগল। কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, যে সব পেশেন্ট সুস্থ হয়ে ফিরে যায় তাদের বাড়ির লোক নিশ্চয় তোমাকে কিছু বখশিশ দিয়ে যায়? উত্তরে বলল, তা দেয়, তবে আমি নিই না। কেন? আমি তো আমার কাজ করি, তার জন্য বখশিশ নেব কেন। আর আমার অত টাকার দরকার নেই।
পরদিন আমার আত্মীয়র ছুটি হওয়ার কথা। সকালে তাড়াতাড়ি চলে গেলাম। পেশেন্টকে নিচে নিয়ে এলো সেই অমলদা। আমি ক্যাশ সেকশনে ছিলাম, তাই ট্যাক্সিটাও সেই ডেকে আনল। কি আর করি, এই লোকটা আমাদের বারবার লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। ভদ্রতা করতে বললাম, চলো এককাপ চা খাই, সঙ্গে শেষ সিগারেটটাও। তো আমলদা, তোমার এখানে হেব্বি রেলা, সবাই মাথায় করে রাখে, সময় পেলেই আবার গাড়ি করে হাওয়া খেয়ে বেড়াও......এসব ছেড়ে কি আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে? সে হাসতে হাসতে বলল, নাঃ। আচ্ছা, শেষ কবে বাড়ি গিয়েছিলে? ২০০০ সালের ১৩ই জুন, এখানকার গাড়িতে করেই। তবে, বাড়ি নয়, তারাপীঠ শ্মশান পর্যন্ত। না থেমে বলল, আমার বউ......থ্যালাসেমিয়া। ছেলে-মেয়ে নেই। বুঝলাম, উত্তরটা বহুবার দিতে হয়েছে। লোকটা আমাকে একেবারে চুপ করিয়ে দিল।
ট্যাক্সি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে অমলদার মোবাইল নম্বরটা চাইলাম। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমার নম্বর? কেন?

...... কোনদিন ডিলিট করব না বলে।


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই