Thursday, January 12, 2012

জেম্মার ডায়রি ৫ -- স্নেহলতা



টোটার কথা
আমি পার্টি করিনা। পশ্চিম বাংলায় আমার পক্ষে পার্টিকরা সম্ভব নয়। কিন্তু সে কথা মাকে কে বোঝাবে? আমাদের
দেশ, আমার রাজ্য, আমার শহর- ধর্মনিরপেক্ষ। তাই আমার পক্ষে এখানে পার্টি করা স্বপ্ন দেখার সমান। আমার কোন পার্টি নেই, অন্তত এই রাজ্যে। হাতে গোনা কিছু সমমতের বন্ধু থাকলে কি তাকে পার্টি বলে? তেমন হলে আমি এই পার্টির একজন বড় মাপের নেতা। আমি হিন্দু। না, ওই গেরুয়া পদ্মের দলটার সঙ্গে আমার- আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমার ধর্ম হিন্দু যে ধর্মের গ্রন্থ বেদ, সংহিতা আর উপনিষদ। প্রচারক শঙ্করাচার্য, বিবেকানন্দ। আমার প্রথম পরিচয়- অন্য অসংখ্য বাঙালির মতো বিশ্বায়নের পাল্লায় পড়ে ভেড়ুয়া বনে যাইনি। আমি জঙ্গি হিন্দু। থামুন! আমি RSS নই!
জানি, এতটা পড়ার পরে আপনার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কি কুক্ষণে এই লেখাটা পড়তে বসেছিলেন, তাই তো? ঘাবড়াবেন না। এখানে তত্ত্বকথা বলে নিজের ও আপনার সময় আমি নষ্ট করবো না। দামি রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে একধরনের লঙ্কা আর পেঁয়াজ দেয়- আলাদা প্লেটে খেতে। তাতে ঝাঁঝ থাকেনা। সকাল বেলা সবজির দোকানে অমন লঙ্কা আপনাকে কেউ গছাতে গেলে কিনবেন? কিনবেন না তো? আপনি- আপনারা হলেন ওই রকম লঙ্কা। জন্ম থেকে সহনশীলতার ভিনিগারে ডুবে থেকে সত্যের ঝাঁঝটা চিরতরে মুছে গেছে। এখন কেউ সত্যি বললেও এত ভয় হয়, যে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান। লোকে কি বলবে? বউ/গার্লফ্রেন্ড কি বলবে? অফিস কলিগ/ক্লাসমেটরা কি বলবে- এই সব ভেবেই আপনাদের দিন যায়। ঠিক, ভুল কে আর ভাবতে বসে নিজের সময় নষ্ট করে, তাই না? কে বললো আমি সহনশীল নই? এই পৃথিবীতে এখনো সব ধর্ম-মতের মানুষের থাকার জায়গা আছে। আপনি সাচ্চা মুসলিম, খ্রিষ্টান? আপনার সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই- যতক্ষণ না আমার পাকা ধানে মই দিতে আপনার ইচ্ছে যায়। কিন্তু যদি চাকরির দরখাস্তে কখনো Religion এর নিচে Hindu বসিয়ে থাকেন, আর এই মুহূর্তে আমার লেখা পড়ে আপনার চোখ কুঁচকোয়, তবে আপনার সঙ্গে আমার অনেক লেনদেন বাকি আছে।
খোলসা করে বলি, আমাদের একটা দল আছে (যাকে পার্টি বলে ওই নাস্তিক দলটার সঙ্গে একাসনে বসানোতে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে), যার প্রথম এবং প্রধান এজেন্ডা- বাঙালি হিন্দুর পুনর্জাগরণ। বেদ উপনিষদ বাদ দিন- ছোট্ট গীতা বইটার পাতা উলটে দেখেছেন কখনো? রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রগুলোকে একধরনের রুগির পথ্য- টাইপ সংস্করণ পড়তে দেওয়া হয়- তেমন নয়। আসল গীতা? না, পড়েন নি। কে যেন বলেছিল- বাঙালির মতো এমন আত্মবিস্মৃত জাতি আর নেই। বোমার মতো সত্যি। নিজেকে অহোরাত্র হিন্দু বলে চলেছেন আর যেই সেই ধর্মের আসল কথাগুলো কেউ বলে বসছে- অমনি পালাবার পথ পাচ্ছেন না তো? কেন? সেটা আপনার বিলিতি কোম্পানির এজেন্ডার সঙ্গে খাপ খায় না বলে, নাকি হলিউডি সিনেমাকে জীবনদর্শন বানিয়েছেন বলে? আমার মতের সঙ্গে ওই দাঙ্গাবাজ, পিচ খোঁড়া, অকেজো প্রেম-ক্যালানো দলের কোন মিল নেই। আমি সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী। তবে আত্ম-প্রবঞ্চনায় নই।
থাক, এ সব নিয়ে পরে অনেক কথা হবে- এখন থাক। নিজের কথা বলি। আমার মা, যাকে আমার খুড়তুতো ন্যাকা বোনটা অতি মধুর স্বরে জেম্মাবলে ডেকেছিল বলে এখন তিনি সকলের জেম্মা হয়ে উঠেছেন, তাঁর ধারণা- আমি বোধহয় নকশাল করি। কিছু জিগ্যেস করতে সাহস পান না, কারণ ভাল করেই জানেন সে অধিকার তাঁর নেই। তবু তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। নিজের জন্মদাত্রীকে যতটা শ্রদ্ধা করা উচিত, ততটা। এক কণাও বেশি নয়। কারণ, তার বেশি তিনি কোনদিনই কিছু ছিলেন না।
আমায় মানুষ করেছে বিশাখাদি। উদ্বাস্তু কলোনির সেই সব ভাগ্যহীনের একজন, যাদের উদ্যম, চরিত্র, শ্রম কোনকিছুই সাহায্য করেনি আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে। মুখে কখনো না বললেও, আমি ওকেই মা বলে মনে করি। আমরাও উদ্বাস্তু। কিন্তু আমার দাদার (ঠাকুরদাকে আমি জন্ম থেকেই দাদা বলি) অসীম বুদ্ধি আর ততোধিক ভাগ্যজোরে এখন আমাদের রীতিমতো বড়লোক বলা চলে। বালিগঞ্জের মতো জায়গায় বাড়ি কেনার ক্ষমতা আর কজন ঘটি-বাটি বিক্রি করা রিফিউজির হয়েছে আমার জানা নেই। আমার বাবা, যিনি সারা জীবন ঘোষিত নাস্তিক, এখন স্বর্গারোহণ করেছেন কিনা জানা নেই। নাস্তিক দের স্বর্গ থাকেনা। তাই তাঁর দেহ, তাঁরই নির্দেশে মেডিকেল কলেজকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষটার আর কোন দোষ ছিল না। নিজের বাপের থেকে কখনো কানা কড়ি নেন নি, উলটে ছোট ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছেন নিজের খরচে। দাদা অনেক করে বুঝিয়ে শুধু রাজি করাতে পেরেছিলেন একই বাড়িতে থেকে যেতে। সেই বাড়িতে এখন জেনানা-রাজ। আমার প্রায় অকর্মণ্য কাকু বাদে সেখানে আছেন আমার অধুনা অবসরপ্রাপ্তা মা, যাঁর সংসারে মতি ফিরেছে অনেক বেশি বয়সে, তাই সময়ের অভাবটা উদ্যম দিয়ে পূর্ণ করছেন; কাকিমা, যিনি প্রায় সেলাই-সাম্রাজ্য স্থাপন করে ফেলেছেন- ওই যাকে বলে Boutique Chain’, ধরাকে সরা না হোক-নন-স্টিক কড়াই মনে করেন; আর আমার একমাত্র বোন, তিতির- দিনকাল অন্য হলে উত্তমের সিনেমায় পাহাড়ি স্যান্যালের আদুরে কন্যা সুচিত্রা বলে ভুল করতাম। আমি? আমায় বোধহয় আদর্শ পার্শ্ব-চরিত্র বলে। বাড়ির কারুর দশে-এগারোয় থাকিনা মানে সকাল দশটা থেকে রাত এগারোটা অবধি ঘরে থাকিনা, তারপর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে পড়াশুনো শুরু করি। একেক দিন আমার কাটে একেক বন্ধুর বাড়িতে। এম.এস.সি.র রেজাল্টের অপেক্ষায় আমি ছাড়া আর কেউই বসে নেই। কেউ চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে, কেউ নেট-গেট-স্লেট- আসলে পেটের জন্য। আমি কোনদিন এর বাড়িতে গিয়ে গিটার বাজাই তো কোনদিন ওর বাড়িতে বিনে পয়সায় ইন্টারনেট। বন্ধুরা খুশি হয়, তবে তাদের বাড়ির লোক নয়। কিছু বলতে পারেন না, কারণ আমি কাউকে বিরক্ত করিনা- নিজের মনে থাকি। দুপুরে বাধ্য হয়ে খেতে বলেন- আমি তাড়া দেখিয়ে বেরিয়ে আসি। হাতখরচার টাকায় ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়। প্রতিদিন। দুপুরের শেষভাগ কাটে সাইবার কাফের ভিতরে। ওই সময়টা হ্যাপি আওয়ার- ঘণ্টায় পাঁচ টাকা। অধিকাংশ দিন কম্পিউটার খোলা হয়না। চেয়ারে বসে বই পড়ি বা লেখালেখি করি। বল্টু কিছু বলেনা- ওকে ক্লাস এইট পর্যন্ত অঙ্ক করিয়েছি। তারপর স্কুল ছেড়ে এই সাইবার ব্যবসা শুরু করেছে। আমায় বেশ মান্য করে। সেটা এই বয়সে দুর্লভ হওয়ায় আমিও আনন্দ পাই। সন্ধ্যেয় টিউশন পড়ানো থাকে, বা গিটারের ক্লাস। এই হলো আমার রোজ-নামচা।
গতকাল এর পরিবর্তন হয়েছিল। এমন কখনো কখনো হয়। বিশেষ উপলক্ষ্যে। কাল ছিল তিতিরের জন্মদিন। সে এমন কিছু নয়। প্রতি বছরই আসে। চেনা আদিখ্যেতা। শুধু আমায় একখানা হাসি দেরাজ থেকে বার করে ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে মুখে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। এবারও হয়েছিল। সন্ধ্যে সাতটা থেকে হা হা হি হি শুরু হলো। ঘরভর্তি ছেলে মেয়ে- সবাই পেখম তুলে রয়েছে। বেশি পরিচিতরা নিজেদের বাবা মা কে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তাঁরা পাশের ঘরে পরনিন্দা আর জগৎ-উদ্ধার শুরু করেছেন। বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবো না বুঝে বারান্দায় চলে এলাম। না, আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করছিল না। যদিও এ সব দিনে অনেকবার কল্পনা করেছি- তবু কোন সুন্দরী মেয়ে একা চুপ করে দাঁড়িয়েও ছিল না। তার বদলে ছিল প্রবীর। তিতিরের বয়ফ্রেন্ড। বাড়ির আর কেউ না জানুক, আমি জানি। ছেলেটি ভদ্রঘরের, পড়াশুনোয় ভাল, দেখতেও। ওর বাবার নাচের বড় দল আছে। মা আগে ওখানে নিয়মিত পারফর্ম করতো। কিন্তু আমি কেন জানি প্রথম থেকেই পছন্দ করে উঠতে পারিনি ছেলেটাকে। হয়তো তিতিরের দাদা বলেই। মুখে আবার সেই হাসিটা ঝুলিয়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম- হাই! কি খবর?’
অন্যমনস্ক থাকলে আজন্ম শহুরে মানুষেরও সৌজন্যের হাসিটা পকেট হাতড়ে খুঁজে পেতে দেরি হয়। প্রবীর চৌকস ছেলে। বেশি সময় নিলো না- এই তো! দিব্যি কেটে যাচ্ছে। তোমার কি খবর?’
-ভাল। থোড় বড়ি খাড়া- যেমন চলে। বাইরে কেন? ঝগড়া হয়েছে?’
এটা আমার স্বভাব। মানুষকে অপ্রস্তুত করে দুম করে প্রশ্ন করতে আমার খুব ভাল লাগে। প্রবীর জানে যে ওদের সম্পর্ক নিয়ে বাড়ির লোকের কোন ধারণা নেই। তিতিরও তাই। কিন্তু ওরা কেউই জানেনা, যে গত সপ্তাহে এক দুপুরে কোন এক ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে ওদের একসাথে বেরোতে দেখেছে ধনা- আমার ক্লাসমেট। ঠিক একসাথে নয়- পনেরো মিনিট আগে পরে- পুরো সময়টাই ধনা উলটো দিকের চা দোকানে বসেছিলো। ওর সঙ্গে যারা আড্ডা মারে, সেই ছেলেগুলোও। ওদের কাছ থেকেই ধনা জানতে পারে- এই প্রথম নয়- এর আগেও বার দুয়েক এরা এসেছে এই বাড়িতে।
-ঝগড়া? মানে?’
-তিতিরের সঙ্গে। আমি জানি তোদের ব্যাপার। লুকোতে হবেনা- ভয়ও পেতে হবেনা। আমার থেকে কোন চাপ নেই। আমি কোন কথাই কাউকে বলিনা। এটাও বলবো না।
অপ্রস্তুত ভাবটা মুখ থেকে যেতে এবার আগের থেকে কিছু বেশি সময় লাগলো- নাহ্‌, ঝগড়া নয়। চা খাবে?’
বুঝলাম রক্ষণ সাজাতে একটু সময় চায় ছেলেটা। ওকে দাঁড় করিয়ে দুজনের চা আনতে ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শক্ত। বুঝলাম, আজ রাত্তিরে সকলকে অনেকক্ষণ জেগে থাকতে হবে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই