Monday, March 12, 2012

হাতি, গন্ডার, পাহাড় আর আমরা কয়েকজন -৩ -- অরুণাভ

<<আগের ঘটনা


-‘আমি আর এগবো না’
-‘আরে আর একটু চল, দেখিনা সামনে কি আছে’
-‘এখানে চারিদিকে জোঁক... আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগছে’
-‘কিছু হবে না, মাঝে মাঝে একটু পা থেকে ঝেড়ে ফেল... ওই সামনের কাঠের ব্রিজ অবধি গিয়েই ফিরে আসব’।
জোঁক আর অভির সাথে লড়াই করতে করতে এগিয়ে চলেছি। পাহাড়ের ঢালে গভীর জঙ্গল। বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড়ি গাছ আর কাঠগুলো থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে। চারিদিকে নরম কাঠ আর পচা পাতা পড়ে রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের গল্পে পড়েছিলাম এই পরিবেশ হল জোঁকেদের আদর্শ আস্তানা। সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। চারিদিকে কিলবিল করছে জোঁক। ছোট-বড়-মোটা-রোগা বিভিন্ন আকারের। আর একটু অসাবধান হলেই পায়ে উঠে পড়ছে। আমার পায়ে মোটা চামড়ার জুতো, তবু ভয় হচ্ছে যদি ভেতরে ঢুকে যায়। শুনেছিলাম জোঁকে ধরলে ছাড়ে না, ওদের কামড় নাকি বোঝাও যায় না। প্রচুর রক্ত টেনে নিজেই একসময় ছেড়ে দেয়। এসব ভাবলেই মনে হচ্ছে বুঝি জোঁকে ভেতরে চুপি চুপি বসে রক্তভোজ সারছে আর আমি কিসুই বুঝতে পারছি না। এরা psychological pressure তৈরিতেও ওস্তাদ, অত্যন্ত বাজে জীব। মনে মনে জোঁক আর অভি উভয়কেই খিস্তি করছি। এখানে নামার সময়ই দেখছিলাম এক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে ওপরে উঠে আসছেন, আমাদের নামতে দেখে বললেন- ‘নিচে যাবেন না... অসম্ভব জোঁক’। সেই শুনে পবিত্র তৎক্ষণাৎ পেছন ফিরে ন্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছিল। আমিও পালালে ভাল করতাম। বীরত্ব দেখিয়ে নিচে নেমে এখন কেস খাচ্ছি। যাইহোক অবশেষে সেই ঝুলন্ত সাঁকোটার কাছে এসে পড়লাম। পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের ওপর দিয়ে অনেক লম্বা, একে ধাওয়া করতে করতেই আমরা এতদূর এসে পড়েছি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই সাঁকোটা শুরু হয়েছে। কোন এককালে হয়ত এর ওপর দিয়ে লোকজন যাতায়াত করত, এখন তার অতি জীর্ণ দশা, পা দিলেই ভেঙ্গে পড়বে। সামনে বড় বড় করে ওঠার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। এত কষ্টে এতদূর আসাটাই বৃথা হল। অভি কে আরেক প্রস্থ খিস্তি করে আর এক দণ্ড অপেক্ষা না করে পেছন ফিরে রওনা দিলাম। পড়ন্ত বিকেলে এই গহিন নিস্তব্ধ জঙ্গলে আমার একটু একটু ভয়ও করছিল। কি জানি যদি সাপ-খোপও বেরিয়ে পড়ে! অবশ্য এই ঠাণ্ডা এলাকায় সাপ সহজে বাইরে বেরোবে না, এই ভেবে মনে মনে একটু সাহস সঞ্চয় করলাম। শেষ কিছুটা পথ প্রায় দৌড়ে পার হয়ে ওপরে উঠে অবশেষে ধড়ে প্রাণ এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে দেখি টুবাই আর রুকমা সেজে গুজে ওই পথেই নিচে নামার উদ্যোগ নিচ্ছে। জোঁকের কথা বলায় দু’জনেই বেশ ভয় পেয়ে সেই যাত্রা বাতিল করল। ইতিমধ্যে বাকিরাও সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। জঙ্গলে নামার অভিজ্ঞতা আর বিপুল পরিমাণ জোঁকের বিভীষিকা নস্যাৎ করে আমার বীর যাত্রা কাহিনী তাদের বেশ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রং চড়িয়ে বলছি এমন সময় হঠাৎ নিজের হাতের দিকে নজর পড়তে দেখি বাঁ হাতের মধ্যমা আর অনামিকার মাঝে গাঢ় বাদামী রঙের প্রমাণ সাইজের একটি জোঁক এঁটে বসে রয়েছে। রক্ত খেয়ে খেয়ে সেটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। সারাক্ষণ পায়ের দিকে নজর দিতে গিয়ে খেয়াল করিনি কখন ব্যাটা হাতে চড়ে বসেছে। চূড়ান্ত আতঙ্কে লাফিয়ে উঠে সেটাকে হাত থেকে ঝেড়ে ফেলতেই গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল।
  এইসব ঘটনার পরেও বেশ কিছুক্ষণ পাহাড়ে ঘোরাফেরা করে আমরা অবশেষে হোটেলের ঘরে ফিরে আসি। অনেক রাত অবধি হোটেলের ঘরেই সবাই মিলে আনন্দ-ফুর্তি হয়। হোটেলের বারান্দা থেকে পেছনে কালিম্পং শহরকে ঠিক মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ের গায়ে একটা দামি হিরের নেকলেস ঝলমল করছে। পরের দিন সকালে গাড়ি চড়ে লোলেগাঁও থেকে লাভার পথে ফিরে আসছি। গতকাল আসার সময় প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। অথচ আজ ঝলমলে রোদ। সেই একই রাস্তা, কিন্তু আজ চারিদিক যেন একদম পাল্টে গেছে, যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে সম্পূর্ণ সতেজ, জীবন্ত, রঙিন। শুধু দু’দিনেই পাহাড়ের এই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো রূপ দেখতে পেয়ে যেমন অবাক লাগছিল তেমনই নিজেদের ভাগ্যবানও মনে হচ্ছিল। আজ সকালে আবির সকলকে ভোরবেলা ঘুম থেকে টেনে তোলে সানরাইজ দেখার জন্য। প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলকে হোটেলের ছাতে যেতে হয়। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখার পর আবিরকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় ছিল না। সূর্যের প্রথম আলো যখন আধো অন্ধকারে মিশে থাকা শুভ্র পর্বতশৃঙ্গকে সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিলো তখন তার সেই অপরূপ সৌন্দর্য না দেখলে ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। কোন বিশেষণই সেই দৃশ্যকে বর্ণনা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। শুধু লালমোহনবাবুর মতো বলতে ইচ্ছে করছিলো ‘অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘে, দেখেছি তোমার রূপ উত্তরবঙ্গে’।

 তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা লোলেগাঁও থেকে বেরিয়ে পড়ি। লাভা পৌঁছনোর পর গাড়ির ড্রাইভার জানাল আমাদের হাতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় আছে, ফলে চাইলে আশেপাশে কোথাও ঘুরে আসতে পারি। কাছেই একটা বৌদ্ধ মনেষ্ট্রি দেখা যাচ্ছিল, তাই সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। পাহাড়ের একধার ঘেঁষে বিশাল বৌদ্ধ ধর্মশালা। তার অবস্থান তার সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করে তুলেছে। প্রায় সব পাহাড়ি এলাকাতেই এই ধরনের মনেষ্ট্রি দেখা যায়। আমি সিমলাতে গিয়েও দেখেছিলাম। তবে হলফ করে বলতে পারি সৌন্দর্যে সেটা এই মনেষ্ট্রির ধারেকাছেও আসতে পারবে না। আমরা ঘুরে ঘুরে পুরোটা দেখলাম। অনেকটা বড় আর অদ্ভুতরকম শান্ত। একটা বাচ্চা ছেলে গাইডের মতো আমাদের পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাল, জিজ্ঞেস করায় বলল সে নাকি ওই মঠেই পড়াশুনো করে। ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে এলাম। সকলেরই বেশ খিদে পেয়েছিল, তাই একটা হোটেলে গিয়ে গরম ভাত, আলুভাজা, মুরগির ঝোল দিয়ে জব্বর করে দুপুরের খাওয়াটা সেরে ফেললাম। এবার ফেরার পালা। যাওয়ার আগে সকলেই দোকান থেকে কিছু না কিছু জিনিস কিনল। অনেকেই টুপি নিল, আমি নিলাম একটা চকচকে হাতলওয়ালা ছুরি।
আমাদের ফেরার ট্রেন শিলিগুড়ি থেকে। লাভা থেকে শিলিগুড়ি আসার পথে অতিকায় তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে এলাম। রাতে শিলিগুড়ি থেকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে আবার কলকাতার পথে। অনেক কষ্টে সকলের সুবিধেমত চারদিনের ছুটি বের করে যে যাত্রার প্ল্যানিং আজ থেকে তিন মাস আগে শুরু হয়েছিলো তার পরিসমাপ্তি হল। কলকাতা ফিরে আবার সেই গতে বাঁধা জীবন, আবার সেই দশটা-পাঁচটার সাতকাহন শুরু হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের এই ছোট্ট ভ্রমণ সকলের স্মৃতিতে জায়গা করে নিল একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়ে। আর দিয়ে গেল একটা উৎসাহ, আবার কখনো এভাবেই সবাইমিলে হইহই করে বেরিয়ে পড়ার।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই