Tuesday, May 8, 2012

জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ -- বহুরূপী

প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বঙ্কিম গবেষক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য লিখেছিলেন:
"বাঙালির গর্বিত সংস্কৃতির ইতিহাসে বেঁচে আছে দুটি-তিনটি বাংলা তারিখ১লা বৈশাখ২৫শে বৈশাখ, ২২শে শ্রাবণ এবং ৭ই পৌষ। এর মধ্যে তিনটিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক মহাপুরুষটিকে ঘিরে।" আর  ২৫শে বৈশাখ তো আজ সমারোহের বশে বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত। মনের আড়ম্বরের দীনতাকৃত্রিমতা আর স্বল্পতা থাকলেও বাহ্যিক আড়ম্বরে পঁচিশে বৈশাখের উদ্‌যাপনসে তো এক হৈ হৈ ব্যাপার।
মোটামুটি ভাবে একটা চেনা পরিচিত প্রতিকৃতি, ধূপ-ধুনো, পাড়ার কিছু  'পঁচিশে  বৈশাখ হে নূতন' গান জানা ছেলেমেয়ের দল,পকেটের সামর্থ্য থাকলে কিছু দামী শিল্পী আর রবীন্দ্র-বিষয়ক কিছু বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে পঁচিশে বৈশাখ ভালভাবেই উদ্‌যাপিত হয়ে যায়। অনুত্তম  ভট্টাচার্য  লিখেছিলেন: "বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ রেলের কামরায়, বাদুড়ঝোলা বাসের ইঞ্জিনের কভারে, গঙ্গা বক্ষে নৌকা-লঞ্চের পাটাতনে কি রুদ্র  বৈশাখের খররৌদ্রে পিচগলা রাজপথে ভ্রাম্যমাণ বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে ফেরেন মাল্যে-পুষ্পে ধূপে-গানে-আবৃত্তিতে-অভিনয়ে অভ্যর্থিত হতে হতে।এখন তো আবার 'পরিবর্তন' আর সরকারের কল্যাণে সারাবছর ধরেই রাস্তায় রাস্তায় শোনা যায় হেমন্ত-দেবব্রত-সুচিত্রার গানতা সে প্রখর গ্রীষ্মের দাবদাহের মাঝে ঠাকুরবাড়ি পার হওয়ার সময়আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনেহলেও।
যাই হোক এই জাতীয় উৎসবের দিনে একটা প্রশ্ন মনে জাগে রবি ঠাকুরের জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময়ে কিভাবে পালিত হয়েছিল তাঁর জন্মতিথি।  স্বল্প পরিসরে বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয় (অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করছি সে পাণ্ডিত্য ও সাহিত্যরসে আমি বঞ্চিত) তবুও একটা সারাংশ দেওয়ার চেষ্টা করছি।
নিজের জন্মদিন সম্বন্ধে কবির আত্মসচেতনতা দেখা যায় ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ (৭ই মে ১৮৮৬) , শ্রীশচন্দ্র মজুমদার কে লেখা এক পত্রেঃ "আজ আমার জন্মদিন-পঁচিশে বৈশাখ-পচিঁশ বৎসর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম-জীবনে এখন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের। রবি।" পঁচিশ বছর বয়সে আত্মসচেতনতা এলেও তাঁর সঙ্গে প্রথম উদ্‌যাপিত হয় ১২৯৪ (১৮৮৭)। এই অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন কবির ভাগ্নি সরলা দেবী। নিজের আত্মজীবনী জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে লিখেছেন: " 'রবিমামার প্রথম জন্মদিন' উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ নং পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে উল্টোডিঙির কাশিয়াবাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রিটে নিঃশব্দে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা বাজার থেকে আনানো বেলফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল একজোড়া ধুতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেনপাশেই নতুন মামার ঘর। রবির জন্মদিন বলে সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে পরিজনদের মধ্যে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হল।" এর পরের প্রায় ২২ বছর কবির জন্মদিন মূলতঃ সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর বাড়ির পরিবেশের মধ্যে। ১৯০২ সালে কবি যখন শান্তিনিকেতনে, তখন জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কলকাতা থেকে অনেকে শান্তিনিকেতন যান। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে এসে শুভেচ্ছা জানানোর সেই শুরু। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সাল থেকে কবির জন্মোৎসব প্রবর্তিত হল নববর্ষের দিনে। আশ্রম বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মাবকাশের জন্য এই সময় পরিবর্তন করা হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের যথার্থত প্রথম জন্মোৎসব পালিত হয় শান্তিনিকেতনে ১৩১৭ (১৯১০)। কবি সেবার পা দিয়েছেন ঊনপঞ্চাশ থেকে পঞ্চাশে। পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে আশ্রমের ছাত্র-অধ্যাপকদের উৎসাহে এবং সম্মিলিত উপস্থিতিতে দিনটি পালিত হয়েছিল আত্মীয়দের উৎসব হিসেবে। যে তিনবার কবির জন্মদিন সবচেয়ে বেশি আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে পালিত হয়েছিল তা ছিল ১৩১৮ (১৯১১) সালে ( বছর কবি পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করে একান্নতে পড়েছেন)।  একবার ১৯২১ সালে দীর্ঘ বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফেরার পর। সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালিত হয়েছিল কবির ৭০তম জন্মদিবস ১৯৩১ সালে।
১৯১২ সালে কবি যখন ৫০ পূর্ণ করে ৫১ তে পা দিয়েছেন সেবার জন্মোৎসব পালিত হয়েছিল জাঁকজমক করে। শান্তিনিকেতনে ছাত্র-শিক্ষকের দল দিনরাত পরিশ্রম করে উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব গড়ে তুলেছিলেন। আশ্রমবাসীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে আসা বহু বিখ্যাত মানুষ। প্রশান্ত মহলানবিশ নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। দলে ছিলেন সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, তাঁর দুই বিদুষী কন্যা সীতা দেবী, শান্তা দেবী প্রমুখ। প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে বেদ-উপনিষদ থেকে বিভিন্ন পাঠ এবং পুষ্পমাল্যে বিভূষিত করে কবিকে সংবর্ধিত করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে নেপালচন্দ্র রায় তাঁর ভাষণে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেনঃতোমরা সকলেই গুরুদেবকে ভক্তি কর, কিন্তু তাঁকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিও না”। শান্তিনিকেতনে যেমন অনুষ্ঠান হয়েছিল, দেশবাসীর পক্ষ থেকেও তাঁকে  সংবর্ধিত করার উদ্যোগ চলছিল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ দায়িত্বভার গ্রহণ করে। “সংবর্ধনা-সমিতিতে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিত্বগণ। ২৮শে জানুয়ারি ১৯১২ টাউন হলে এই  অনুষ্ঠান হয়েছিল।
১৯২১ শে ইউরো-আমেরিকা ভ্রমণ শেষে কবি দেশে ফিরলে তাঁর জন্মোৎসবে সংবর্ধনার আয়োজন করে  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ। ১৩২১ সনের ১৯শে ভাদ্র (১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯২১) কবিকে  সংবর্ধিত করা হয়। এই সংবর্ধনার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পরিষদ কর্তৃকরবীন্দ্র মঙ্গলপুস্তিকা প্রকাশ। সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর। স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী (কবি প্রশস্তি),  সত্যেন দত্ত (নমস্কার) আরও অনেকে। মাল্যচন্দনে ভূষণ, গান , কবির অভিভাষণ সমাগত ব্যক্তিদের জলযোগের মধ্যে দিয়ে  অনুষ্ঠান শেষ হয়।
বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৩১ সালে কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তী উদযাপন। রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন অমল হোম। জয়ন্তী উৎসবকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যে কমিটি তৈরি হয় সেখানে ছিলেনঃ জগদীশচন্দ্র বসু (সভাপতি), মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি.ভি.রমণ, বিধান রায়, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ (সহ-সভাপতি)। এছাড়াও সদস্যদের মধ্যে ছিলেনঃ রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী, কালিদাস নাগ, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্ত মহলানবিশ প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিগণ। এক সপ্তাহ (২৫শে ডিসেম্বর-৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৩১) ব্যাপী ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ পালিত হয় কলকাতায়। টাউন হল, কলিকাতা ইউনিভার্সিটি হলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় এই জন্মতিথি। কবির অঙ্কিত চিত্রাবলী, রচনার পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছিল টাউন হলে। কথকতা, যাত্রা, কীর্তন, জারী গান প্রভৃতি লোকসঙ্গীত, রায়বেঁশে প্রভৃতি লোকনৃত্য, দেশীয় খেলাধুলা এসব নিয়ে মেলার আয়োজন হয়েছিল ইডেন গার্ডেন্সে। এ উপলক্ষ্যে নটীর পূজা নাটক অভিনীত হয়েছিল দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের বাড়িতে। প্রকাশিত হয়েছিল দুটি সংবর্ধনা গ্রন্থ-একটি বাংলায় অপরটি ইংরেজিতে। ইংরেজি গ্রন্থ “Golden Book of Tagore” এর নামকরণ করেন রোঁমারোঁলা। এই বইতে কবি  সম্পর্কে লিখেছিলেন ন্যুট হামসুন, হ্যারল্ড ল্যাসকি, আইনস্টাইনের মতো মনীষীগণ।
এছাড়াও ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন পরিবেশে জন্মদিনে  সংবর্ধিত হয়েছেন কবি। কখনো দেশে থাকাকালীন অবস্থায় যেম; শান্তিনিকেতনে বা জোড়াসাঁকোতে অথবা শিলাইদহে (১৮৯৩, ১৯১২) অথবা আলমোড়ায় (১৯০৩)। আলমোড়ায় অবশ্য জন্মদিন পালনের কোনো প্রশ্ন নেই কারণ কয়েক মাস আগেই হারিয়েছেন স্ত্রী মৃণালিনীকে। ১৯১৪ সালের ২৫শে বৈশাখ কবি কলকাতায়। সে বছর সুদূর আমেরিকার আরাবানায়  রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয় ৬ই মে (২৩ শে বৈশাখ)। বিদেশে থাকাকালীন প্রথম জন্মদিন পালিত হয় ১৯১৬ সালে। কবি তখন রেঙ্গুনে। ১৯২৪ সালে চীনের পিকিং- মেডিকেল কলেজের বিরাট হলঘরে কবিকে জন্মদিনের সংবর্ধনা জানানো হয়। কবিকে সম্মান প্রদর্শনের অঙ্গ হিসেবে 'চিত্রা' নাটকের আয়োজন করা হয়েছিল। মি; লিয়াঙ-চি-চাঙ চীনা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের নামকরণ রে- 'চু-চেন-তান' (যার অর্থ ভারতের মেঘমন্দ্রিত প্রভাত)। এখন যেমন বাঙালী ট্রামে-বাসে, নৌকায়,ট্রেনের স্বল্প পরিসরে  রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে উৎসাহী হয়ে পড়েন, তেমনি মেতে উঠেছিলেন নলদেরা জাহাজের কর্মীরা ১৯২৯ সালের ২৫ শে বৈশাখ, কবি তখন জাপান যাত্রায় প্রশান্ত মহাসাগর বক্ষে নলদেরা নামক জাপানী জাহাজে। ১৯৩০ সাল যখন প্যারিসে অথবা ১৯৩- যখন পারস্যে, সেখানেও  জন্মদিনে সংবর্ধিত হয়েছেন কবি।
এই সমস্ত বিভিন্ন  জন্মোৎসবে কবিকে ঘিরে রচিত হয়েছে বিভিন্ন কবিতা, গান। কবির উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে প্রশস্তিপত্র। রবি ঠাকুরও পিছিয়ে থাকেননি। রচনা করেছেন গান, কবিতা, পাঠ করেছেন প্রতিভাষণ। পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সান্ধ্য সভায় (২ ফেব্রুয়ারী১৯১২) সত্যেন দত্ত পাঠ করেছিলেন:
জগৎ-কবি-সভায় মোরা তোমারি করি গর্ব্ব
বাঙালি আজ গানের রাজা , বাঙালি নহে খর্ব্ব...
প্রশ্ন জাগে এই সমস্ত জন্মোৎসবের আড়ম্বর কবি কি উপভোগ করতেন? আশ্রমের ছাত্র-শিক্ষকদের শ্রদ্ধার্ঘ্য তাঁর পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা সহজ ছিল না, কিন্তু বাইরের উদ্যোগ সম্পর্কে তাঁর মত ছিল ভিন্ন রকমের। যদুনাথ সরকারকে লিখেছিলেনঃ “এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন”। কিন্তু মানুষের প্রীতি ভালোবাসাকে প্রশান্ত চিত্তে গ্রহণ করেছেন: “আমার শেষ কথা বলে যাচ্ছি-সম্মানের জন্য আমার মনে ক্ষুধা নেই, আমি অনেক পেয়েছি, যা প্রাপ্য নয় তাও পেয়েছি প্রয়োজন আছে মানুষের সৌহার্দ্দ্য, প্রীতি। সেটা কেউ ত্যাগ করতে পারে না এবং সেটা পেলে খুশি হব না, এমন কথাও বলতে পারি না। এ দুর্মূল্য, এই অকৃত্রিম প্রীতি দুর্লভ-এ জিনিষ জীবনে যে পাইনি তা নয়, কখনও কখনও তা পেয়েছি।”(অভিভাষণ, ৫ই মে, ১৯৩৫)। অভিবাদন তিনি গ্রহণ করেছেন বিশ্বমানবের একজন হয়েঃ: “….এই অভ্যর্থনাকে ভারতের নবযুগে অতিথি সমাগমের প্রথম মঙ্গলাচরণরূপে আমি সকল আগন্তুকের হয়ে গ্রহণ করেছি- আপনাদের সকলের সহযোগে মাতৃভূমির প্রাঙ্গণে বিশ্বচিত্তের একটি মিলনাসন প্রতিষ্ঠিত হোক(অভিভাষণ, ৪ই সেপ্টেম্বর, ১৯২১) প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান যেমন শুভানুধ্যায়ীদের থেকে লাভ করেছেন, সমালোচনাও তাঁর পিছু ছাড়েনি। ১৯১১ সালে পরিষদ যখন জন্মোৎসবের আয়োজন করে, তখন একটি বিরোধী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। তাঁরা একটি বিরুদ্ধ প্রচার পত্র মুদ্রিত করে এবং এক কপি কবিকেও পাঠিয়ে দেয়। ব্যথিতচিত্তে কবি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে মর্মন্তুদ পত্র লেখেন: “আজ আমার পঞ্চাশ বৎসর পূর্ণ হইবার মুখে এই আর একটি নিন্দা আমার জন্মদিনের উপহার রূপে লাভ করিলাম এই যে, আমি আত্মসম্মানের জন্য লোলুপ হইয়াছি …..এই নিন্দাটিকেও নতশিরে গ্রহণ করিয়া আমার একপঞ্চাশত বৎসরের জীবনকে আরম্ভ করিলাম – আপনারা আশীর্বাদ করিবেন সকল অপমান সার্থক হয় যেন” (৪ মে, ১৯১১) প্রসঙ্গত, ১৯৩১ সালে ৭০তম জয়ন্তীতেও শনিবারের চিঠি ও বিচিত্রাতে যথেচ্ছ সমালোচনা প্রকাশিত হয়।
পঁচিশে বৈশাখ ১৩৪৮ ( ৮ই মে, ১৯৪১) কবিজীবনের শেষ জন্মোৎসব অনুষ্ঠান। শান্তিনিকেতনের আঙিনায় অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে পালিত হয় শেষ জন্মতিথি। এই শেষবারের জন্মদিন উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের ‘উদয়নে’ বসে যে কবিতা লিখেছিলেন তাতে ফুটে উঠেছে আসন্ন চরম ক্ষণের এক অনবদ্য অন্তর্দর্শন:
আমার এ জন্মদিন মাঝে আমি হারা
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে
নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।……
এর পর থেকে তো শুধু রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন। আমরা বেঁচে আছি সেই স্মৃতিমেদুরতা নিয়ে। অপেক্ষায়-"ঐ মহামানব আসে"। এই ইতিবৃত্তের ইতি টানি জন্মদিনের প্রাক্কালে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি(১২ই মে১৯১২) দিয়ে যেখানে তাঁর ঝড়-ঝঞ্ঝা-মুখরিত জন্মদিনের তাৎপর্য গভীর ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে:
“....অনেকদিন ধরে বৃষ্টি হব হব করে হয়নি-কেবলি মেঘ করে আর শুকনো বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যায়-আমার জন্মদিনের অপরাহ্ন বাতাস বইতে মেঘ জমতে জমতে অবশেষে প্রচুর বর্ষণ হয়ে দিন শেষ হল। আমার মনে হল সমস্ত দিন অপেক্ষা করে আমি তাঁর কাছ থেকে এই জন্মদিনের আশীর্বাদপত্রে পেলুম-সংবাদ এল শুষ্কতা এবং ব্যর্থতার মধ্যেই দিন অবসান হবে না.-সন্ধ্যা আসবার আগেই বর্ষণ হয়ে যাবে-কেবলি বারবার ঐ মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে না-একদিন আপনাকে নিঃশেষ করে সমর্পণ করে দিয়ে যেতে পারব-তারপর সুগভীর বিরাম। অতএব চললুম-মনটাকে এই পৃথিবীর ঘেঁষাঘেঁষির মধ্যে দিয়ে একবার টেনে নিয়ে যাই-তাকে তীর্থে তীর্থে স্নান করিয়ে নিয়ে আসি। এবার ক্ষয় করবার অভিযানে যাত্রা করি-চলতে চলতে স্থূলতা আমার যাক। যেটুকু আমার বিশুদ্ধ সত্য তাই মুক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ুক। এই জীবনের শেষে গিয়ে যখন থামতে হবে, সামনে তখন যেন পূর্ণতাকে দেখতে পাই, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি।”  
তথ্যসূত্র:
   পঁচিশে বৈশাখ: অনুত্তম ভট্টাচার্য
   . জীবনের ঝরাপাতা: সরলা দেবী চৌধুরাণী
   জন্মদিনের মুখর তিথি: সুনীল দাস
    পুণ্যস্মৃতি: সীতা দেবী

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই