Thursday, June 28, 2012

সত্যি হলেও গপ্পো -- সুমিত


লিঙ্ক
কথা হচ্ছিল যাদবপুরের গল্প নিয়ে। বলতে গেলে তা এতকিছুর কোলাজ যে এখনও খাওয়ার সময় একবার শুরু হলে,
থালায় নিজের মুখ ভেসে ওঠার পরও সেসব শেষ হয়ে ওঠে না। আজ এমন একটা ঘটনা মনে পড়ল যার মজাটা তখন নিতে পারি নি, কিন্তু এখন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি।
তখন সেকেন্ড ইয়ার, একবছর হয়ে গেছে ইউনিভার্সিটিতে। পাঁচজন মিলে নতুন একটা মেস তৈরি করেছি। একতলায় আমাদের মেস, বাড়িওয়ালা জেঠু দোতলায় থাকেন। উনি খুব কম কথার লোক। প্রথমদিনই কড়া জবানিতে কেটে কেটে বলে দিলেন, “জানি মেসের ছেলেরা অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করে (??!!)। সে সব ঠিক আছে, কিন্তু গভীর রাতে যেন কোন চেঁচামেচি হট্টগোল না হয় (ইঙ্গিতটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন)।” জেঠুর কথা শুনেই আমরা বুঝলাম, বাড়ি ভাড়া দেওয়ার দিন ছাড়া নাকে এড়িয়ে চলতে হবে।
কিন্তু ছড়িয়ে গেল দ্বিতীয়দিনই। সন্ধ্যেবেলা সেদিন লোডশেডিং, গরমের মধ্যে মেসের সামনের উঠোনে সবাই মিলে একটু হাওয়া খুঁজছি। ওখানেই দোতলায় যাওয়ার গেট। বদভ্যাস বশত কলিং বেলটা একবার চেপে দিয়েছি। মানে কারেন্ট নেই, কি আর হবে।
একটু পরে উপর থেকে গলা এলো, “কে?”
আমি বললাম, “এই আমরা।”
জেঠু জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু বলবে?”
যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে উত্তর দিলাম, “কই, কিছু না তো!
“তাহলে কলিং বেল বাজালে কেন?”
আমি তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। এর মধ্যে বাকিরা সব কেটে পড়েছে। আমতা আমতা করে বললাম, “বেল...... মানে কারেন্ট তো নেই...”।
“ওটা ব্যাটারিতে বাজে। ঠিক আছে, জানতে না, কিন্তু এবার তো জেনে গেলে... আর বাজিয়ো না।” জেঠু ভিতরে চলে গেলেন। লজ্জায় কাটা মাথা নিয়ে ঘরে ঢুকে বাকিদের কাছে কি পরিমাণ চাট খেতে হল বুঝতেই পারছেন।
এরপর আমরা শান্ত সুবোধ বালকের মতই আছি। একসঙ্গে সবাই মিলে মেস গোছালাম (যেটা স্বাভাবিকভাবেই দু’দিন পরে এলোমেলো হয়ে গেল), রান্নার ব্যবস্থা করলাম, মেসের একটা সংবিধানও তৈরি হল (তারপর সেটা কোথায় যে গেল, আর খুঁজে পাই নি)। রাতে মেসে যেহেতু কোন বাওয়াল করা যেত না, তাই রাস্তায় চরে বেড়ানোর একটা বদভ্যাস তৈরি হল। এমনি একদিন রাতে লোডশেডিং, কয়েকজন মিলে রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছি। অলি-গলি-সুকান্ত সেতু হয়ে মেসে ফিরে আবার সেই উঠোনে। চারিদিক নিঃশব্দ, জেঠুর ভয়ে ফিসফিস করে চলছে রাত্রিকালীন ভাট। হঠাৎ রিংটোনের মতো বেজে উঠল... ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা...’। না, মোবাইল নয়, জেঠুর কলিংবেল!
ব্যস, বিশু ছড়িয়ে ফেলেছে, আমার মতো একই কেস। শালা আর সময় পেলো না? আমরা আর বুঝতে পারছি না, কি করবো, কোথায় যাবো। মাথার উপর বাজ যেন পড়ে গেছে। পড়িমরি ছুট লাগালাম তিনজন মেসের ভিতরে, গেট খোলা রেখেই। আমি তো প্রায় খাটের নিচেই লুকিয়ে পড়েছি, আর একজনও তাই। এদিকে বিশু ভয়ে কেঁদেই ফেলেছে। যে দু’জন ভিতরে ঘুমোচ্ছিল, তারা উঠে পড়েছে। এখন তাদের কেলোর কীর্তি ভেঙে বোঝাব, নাকি বিশুকে সামলাবো...... মাথা একদম কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আর তারপরেই কানে এল জেঠুর গম্ভীর গলা, “কে? কে ওখানে?” সঙ্গে একটা টর্চের আলো বাইরের গেট থেকে শুরু করে উঠোনের আনাচ-কানাচ নড়াচড়া করে বন্ধ হয়ে গেল।
সব শেষ, কাল থেকে অন্য মেস দেখতে হবে...... বিশুকে শান্ত করার কোন ভাষা ছিল না কারও কাছে......
তারপর কিছুক্ষণ এভাবে পার হল। বাকি দু’জনকে, যারা ভিতরেই ছিল, সবটা খুলে বলা হল। সকলেই একেবারে থমকে বসে আছি, সে এক গভীর শোকপালন। মাঝে মাঝে পালা করে দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। বুঝলাম আর ভেবে লাভ নেই, কাল সকালে সবাই মিলে জেঠুর পায়ে পড়ে যাব (বিশ্বাস করুন, তখন আমরা এতটাই ভয় পেতাম বাড়ির মালিককে)।
এরই মধ্যে বাদ সাধলো সৌরভ। গলার জোর শুনে মনে হল ইতিমধ্যে একটা দারুণ ফন্দি এঁটে ফেলেছে। গভীর বিশ্বাস নিয়ে সবাই মন দিলাম ওর কথায়। “না, ওসবে কোন লাভ হবে না। জেঠুর কাছে এটা চোরের কাজ বলে দেখাতে হবে, তাই আমাদের একটা চুরির গল্পসাজাতে হবে।
এক চিলতে আশার আলোয় ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। কিন্তু একটাই খটকা, চোরে কলিং বেল বাজাবে কেন? সকলেই বুঝতে পারছি, এত সহজে আমাদের গপ্পো ধোপে টিকবে না। তবুও মেসে টিকতে হলে গুপিটা জেঠুকে খাওয়াতেই হবে, তা সে যেমন করেই হোক। এবার আস্তে আস্তে সকলের মাথা কাজ করতে শুরু করেছে। লেগে পড়লাম চুরির গপ্পের স্টেজ সাজাতে। না, তার আগে জীবনে কোদিন নাটক করি নি। সেই প্রথম, তাও আবার চ্যালেঞ্জ এতটাই যে দর্শককে বুঝতে দেওয়া যাবে না সে নাটক দেখছে !
প্রথমে গ্রিলের ফাঁকে একটা গামছা অর্ধেকটা বাইরে ঝুলিয়ে লটকে রাখা হলো, আর একটাকে একদম বাইরে উঠোনের উপর। একই ভাবে দু’টো টি-শার্টকে সাজালাম। এবার দোতলায় যাওয়ার গেটের সামনে (যার একপাশেআছে সেই সর্বনাশা কলিং বেলটা) সৌরভের সেভিং সেটের বাক্স আর কিছু টুকিটাকি অগোছালো করে ছড়িয়ে রাখলাম। সব ঠিক থাকলে, ওখানেই সাজানো নাটকের ক্লাইম্যাক্স হতে হবে। চোর হয়তো গেট খোলার চেষ্টা করছিলো, এদিকে অন্ধকারে বুঝতে না পেরে ভুল করে হাত পড়ে যায় কলিং-বেলে। বেলের শব্দে সে ভড়কে যায়, আর তক্ষুনি সবকিছু সেখানেই ফেলে সে পালায়। কিন্তু শুধু এতেই তো হবে না, চোর সম্ভাব্য যে রাস্তা দিয়ে পালাতে পারে, সেদিকেও দু-একটা জামা-কাপড় ফেলে রাখা হলো। এইভাবে শেষ হল আমাদের স্টেজ সজ্জা। বাকিটা আমাদের অভিনয়, যেটা কাল সকালে শুরু হবে। ভাগ্যও সেদিন আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলো। এজন্য বলছি, যে, কারেন্ট তখনও আসে নি। এতটা পড়ে আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনি কেন- আমিও ভাবছি, এই আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদার কোন মানে হয়! কিন্তু মাথা বাঁচাতে সেদিন আমাদের ওইটুকুই ভরসা ছিলো।
তারপর ওই গরমের মধ্যেও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙলো, তখন মেস সরগরম। কালকে নাকি মেসে চোর এসেছিলো। রান্নার মাসি এসে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, সঙ্গে আমরাও। জেঠু তখন বাগানে জল দিচ্ছিলেন, তিনিও আতঙ্কিত। আশেপাশের বাড়ি থেকে কিছু লোক জড়ো হয়েছে। এদিকে মনে মনে আর আনন্দ ধরে না। জীবনের প্রথম নাটকই সুপারহিট। আমরা কেমন একটা ভয়-ভয় মুখে বাইরে যাচ্ছি পালা করে, আর ভিতরে ঢুকে আনন্দে একটু করে লাফালাফি করে নিচ্ছি। এতো খুশির মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলা জিনিসগুলোর কথা ভুলেই গেছিলাম।
আর সেসব খুঁজতে গিয়ে তো অবাক ! গ্রিলে ঝোলানো গামছাটা ছিলো, কিন্তু বাইরে ফেলে রাখাটা তো নেইদোতলার গেটের সামনে থেকে সৌরভের সেভিং সেট উধাও, আর জামা-কাপড়গুলোও হাওয়া। তাহলে এসব কার কাণ্ড? আমাদের অভিনয়-টয় সব ছুটে গেছে ব্যাপার দেখে। তন্ন তন্ন করে মেসের আশপাশ সব খুঁজেও কিছুই পাওয়া গেলো না।
বুঝলাম, আমাদের সাজানো নাটকে চোর ছিলো, কিন্তু বাটপারের অভাবটা এক সত্যিকারের চোর এসে পুষিয়ে দিয়েছেন শেষরাতে। যা গেছে তার জন্য কারও বিশেষ আফসোস হয়নি, শুধু সৌরভের ছাড়া। প্ল্যানটা ওরই সাজানো, তবু বেচারির সখের জিনিসটা খোয়া গেলো।
তারপর জেঠুর জুজু অবশ্য বেশি দিন টেকে নি, লোকটাকে বুঝতে আমাদের ভুলই হয়েছিলো। ওই মেসে চার বছর ছিলাম। খেলা থাকলে জেঠুর টিভিতেই দেখতে যেতাম। জেঠিমা আমাদের খুব ভালোবাসতেন, নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। মেসে সরস্বতী পুজোও করেছি, এমনকি ক্রিকেট পর্যন্ত খেলতাম...... কে কখনো মানা করেন নি। তবু সাহস করে সেদিনের সত্যি ঘটনাটা এখনও বলে উঠতে পারিনি জেঠুকে। ঠিক করেছিলাম, বলতে না পারি, লিখে জানিয়ে যাব। তাই সুযোগটা আজ আর হাতছাড়া করলাম না।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই