Thursday, June 7, 2012

ঠাণ্ডা লাভা (Lava) - ২ -- সুনন্দ



সৈকত
লাভা-রিশপ-লাভা এই শাট্‌ল্‌কক অভিযানের শেষে আমরা যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন পাহাড়ি সূর্য
মাথার ওপর উঠে গেছে। হাতে অনেক সময়, আমরা রাস্তাতেই ঠিক করে নিয়েছি, যে তড়িঘড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়বো ছাঙ্গে(Changey Falls) জলপ্রপাত দেখতে। যেতে আসতে বলছে ঘণ্টা দেড়েক করে সময় লাগবে, রাস্তা খারাপ, তাই আশা করা যায়, বিকেলের মধ্যে ঘুরে আসতে পারবো। পরিকল্পনা যেমন ছিলো, আশ্চর্যজনক ভাবে দলের সকলে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও, দিব্যি সেই রকমই হলো! মনে হয় বাঙালি বেড়াতে গেলে নিজেকে সায়েব মনে করে। সে যাই হোক, খেয়ে দেয়ে পাঁচমূর্তি তো বেরিয়ে পড়লাম একটা জিপে করে, বেশ স্বাস্থ্যবান এক ড্রাইভারের ভরসায় জীবন দিয়ে (ভাবছেন বাড়াবাড়ি বলছি? একবার ওই রাস্তায় বর্ষাকালে গিয়ে দেখবেন- প্রাণ যদি নিয়মিত সময়ান্তরে গলার কাছে উঠে না আসে- গোলবাড়িতে একদিন মাংস খাওয়াবো), খাওয়ার পরের আর সারা সকালের অনভ্যস্ত খাটনির পরে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিদের প্রবল হাতছানি অগ্রাহ্য করে। আগের দিন যে রাস্তায় আমরা হাঁটতে বেরিয়েছিলামসেই রাস্তা বরাবরই চললো গাড়ি- পার্থক্য শুধু কিছুক্ষণের মধ্যেই রাস্তার চেহারা এমন দাঁড়ালো, আমি কল্পনা করলাম, এখান দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে Westeros এর Giant বাহী বিশালকায় ম্যামথ। সে কি রাস্তা! সরু, এবড়োখেবড়ো, গোদা গোদা পাথর ছড়ানো আছে ইতস্তত, কোথাও বেশ খানিকটা জলের নিচে রাস্তা কোথায় বোঝা যাচ্ছে না- এর সঙ্গে বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো আছে হঠাৎ করে উলটো দিক থেকে এসে পড়া একটা করে বড়সড় গাড়ি, বলাই বাহুল্য সব কটাই আসছে ছাঙ্গে থেকে। কোন একটা গাড়ি তখন থেমে যাচ্ছে, অন্যটাকে যাওয়ার রাস্তা করে দেওয়ার জন্য। এ সবের মধ্যেও আমাদের অফুরন্ত এনার্জি। একজন বিনামূল্যে জ্ঞান বিতরণ করা শুরু করলো- বলতো, এই যে গাড়ি গুলোর নাম জিপ, সেটা কেন হলো?” নিরুত্তর শ্রোতাদের থেকে উত্তরের আশা নেই বুঝে জানিয়ে দিলো- এগুলো আসলে GPV- General purpose vehicle. আচ্ছা, এবার বলতো, এগুলোর সঙ্গে এমনি গাড়িগুলোর পার্থক্য কোথায়...?” বুঝতেই পারছেন, এইরকম অজস্র প্রশ্নের আর কোনটাই আমার মনে নেই। বিশাল দীর্ঘ রাস্তার প্রায় পুরোটা জুড়েই একদিকে খাদ, অন্যদিকে খাড়া, ন্যাড়া পাথর। কখনো তার সাথে জুড়ছে বিশাল সব ঝাউ গাছের সারি, কখনো কুয়াশা-ঢাকা পাহাড়ের পরিচিত অথচ কখনো পুরনো না হওয়া ছবি। সমস্ত পথ ধরেই আমরা নিচে নামছিলাম। এতটাই ঢাল, অধিকাংশ সময় ড্রাইভার ইঞ্জিন বন্ধ করে রেখেছিলেন। হঠাৎ করে একটা বাঁকে গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হলো।
সুনন্দ
কারণ বুঝতে না পেরে আমরা ইতিউতি দেখছি- মনে হচ্ছে এখান থেকেই হয়তো ছাঙ্গে অবধি হেঁটে যেতে হবে, এদিকে ড্রাইভার হাঁটা লাগিয়েছেন সোজা রাস্তার ধারের ঝোপের ভিতরে। মনে মনে ভাবতে শুরু করেছি- ব্যাটা রওনা হওয়ার আগে প্রাতঃকৃত্য সারতে পারলো না?”- তখনই দেখি একগাল হাসি আর হাতে কয়েকটা বুনো লাল-হলুদ ফল নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন ভদ্রলোক। এগুলোই সেই বুনো স্ট্রবেরি, যেগুলোর কথা আগের দিন বলেছিলাম আপনাদের। এই স্ট্রবেরি পর্বের শেষেই আমরা ছাঙ্গে পৌঁছে গেলাম ভাববেন না- রাস্তায় একবার টায়ার পাংচার হলো। চাকা সারানোর ফাঁকে আমরা ক্যামেরাবাহীরা ও এক অত্যুৎসাহী পাশের বুনো ফুলের জঙ্গল ধরে খাড়া কিছুটা উপরে উঠে প্রবল হাওয়ার তোড়ে কিছুক্ষণ আরাম নিলাম, আর দারুণ দেখতে একটা রাস্তার কিছু ছবি তুললাম।
সৈকত
নাহ্‌, ভয় নেই। শেষ অবধি পৌঁছলাম ছাঙ্গের কাছে। ঠিক করে বলতে গেলে, উপরে। অনেকটা বাঁধানো পথ ধরে নেমে যেতে হবে নিচে, জলপ্রপাতের তলায়। হাঁটা শুরু হলো। অদ্ভুত হাঁটা। মনে রাখতে হবে, শহুরে, ভেতো, আর কায়িক পরিশ্রমে অনভ্যস্ত এই ছেলে-মেয়েগুলো সারা সকাল ৮ কিলোমিটার হেঁটেছে দুর্গম চড়াই উৎরাই বেয়ে। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। প্রতিটি পদক্ষেপে হাঁটুর কাছে কড়কড় করছে- শোষিত মালাইচাকির শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ! দুজন ওই রাস্তাতেই মিলখা সিং হয়ে গেলো- দৌড়লে নাকি ব্যথা কম লাগছে! কি জানি বাবা, আমার তো হাঁটতেই দম বেরোচ্ছিলো, দৌড়লে আর দেখতে হতো না! বাঁধানো ঢালু রাস্তায় মাঝেমধ্যেই সিমেন্টের বিশ্রাম-ছাউনি। তখন বুঝিনি, পরে ওঠার সময় তাদের মর্ম হৃদয়ঙ্গম হলো। যাই হোক, নিচের দিকে যেতে যেতেই দেখা যাচ্ছিলো জলপ্রপাত। নিচেবলে কিন্তু ভুলেও মাটির কাছাকাছি ভাববেন না।
সুনন্দ
সুনন্দ
জলপ্রপাতের যেখানে শেষ, সেখানে সিমেন্ট দিয়ে ঘিরে কিছু জায়গা বানানো হয়েছে ভ্রমণবিলাসীদের জন্য। আর পাথর ফেলে এমন ভাবে ঘেরা হয়েছে, যাতে তলার pool টা শান্ত থাকে প্রায়। কিন্তু, এর পরেও জল গড়িয়ে গেছে অনেকটা নিচে, হারিয়ে গেছে একটা অতলগুহায়। তারপরেও পাহাড় নেমে গেছে-যদ্দূর চোখ যায় না, তদ্দূর। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এ জায়গার সৌন্দর্য আপনার চেনা জলপ্রপাতের মতো নয়। বেশি কথা বলতে পারছি না, গিয়ে দেখে নিন। আমরা ওখানে ছিলাম অনেকক্ষণ- প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। প্রথমদিকে যে দুজন পৌঁছেছিলো, তারা নাকি রঙধনুও দেখতে পেয়েছিলো। সে আর কি করা যাবে- ওদের কাছে তো আর ক্যামেরা ছিলো না অনেকক্ষণ বসে থেকে, পিছল পাথরে দাপাদাপি করতে গিয়ে পিছলে জলে পড়ে গিয়ে (যারা দেখেছিলো, তারা কেউ রেকর্ড করেনি... হুঁহ্‌), ছিটে জলে ক্লান্তি ভুলিয়ে, অতল খাদে উঁকি মেরে, এখান থেকে বেস জাম্প করা যায় কিনা- সেই নিয়ে খানিক বাজে বকার মাঝেই অনেক অন্য লোকের ভিড় জমে গেলো। আলোও পড়ে আসছিলো। আমরা উঠে আসা মনস্থ করলাম। ফেরা নিয়ে আমি একটাই কথা বলবো- আর সেটা সব জলপ্রপাতের জন্যেই সত্য- যদি উঠে আসার দম না থাকে, ভুলেও নিচে নামার কথা ভাববেন না। নিচে থেকে গেলে খাবেন কি? আমরা যথেষ্ট তাড়াতাড়িই উঠে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সৌভাগ্য সকলের নয়। আমাদের সঙ্গেই আসছিলেন একটি বাঙালি পরিবার। স্বাস্থ্যবান স্বামী, ইতিমধ্যেই কোমরে বাত ধরে যাওয়া, হাতে লাঠি স্ত্রী আর এক বছর ছয়-সাতের বাচ্চা ছেলে। মাকে সঙ্গ দিতে বাবা পিছিয়ে পড়েছে, মা ক্রমাগত গজগজ করে চলেছে, সে আর কি করে, এগিয়ে গেছে একটু। রেলিঙের ধার থেকে বাবা-মাকে ডেকে বলছে তাড়াতাড়ি আসার কথা। তা, তেনারা এসেই প্রথমে যা করলেন, সেটা হলো বাচ্চাকে ভয়ানক কড়কানি। হাতে দু-একটা চড়-চাপড়ও হলো। আমি দেখেও না দেখার ভান করছি। কিরণমালা অত সাবধান মানে না। জোরে জোরে বলতে শুরু করেছে, (অবশ্যই আমাকে উদ্দেশ্য করে)- , অন্যের ছেলেকে বকলে Child Abuse, আর নিজের হলেই পেটানো যায় ইচ্ছেমত?’ একদিকে খাড়া পাহাড়, অন্যদিকে খাদ- আমি কোথায় লুকোই বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার বুঝছিও না, এই ঝাঁঝের কারণ কি- ইস্কুলে বহুদিন পড়ানোর ফল, নাকি সদ্য কোন এক খানের টিভি শোয়ের এপিসোড। সে যাই হোক, সেই বিশ্রাম ঘরগুলো পুরোদস্তুর ব্যবহার করে উপরে উঠে এলাম আমরা। সেই বাঙালি গিন্নি তখনো বকে চলেছেন- ‘...বাবাহ্‌ আর এট্টুখানি তাহলেই পৌঁছে যাবো কি কুক্ষণে যে এসে পড়েছিলাম এই রাস্তায় কেউ নামে এই বুটুন ওদিকে যাস না বাবা সোনা আমার কি থেকে কি হয়ে যাবে এই তুই আর রাস্তা ঘিরে দাঁড়াস না নিজেই উঠতে পারছি না তোকে কি দেবো (কুকুরের প্রতি। এখানেও একটা কুকুর আমাদের ফলো করে ওঠা-নামা করেছিলো পুরো রাস্তা, বদলে বিস্কিট পেয়েছিলো) ওগো তুমি আবার যাচ্ছো কোথায় আমায় ধরো সাধ করে নামাবে ওঠাবে না ওরে বাবা ক্কি গরম...’ (ভুল লিখিনি, সত্যিই কথাগুলোয় দাঁড়ি-কমা ছিলো না) তার উত্তরে ত্যাঁদড় ছেলে- এহ্‌, ওদিকে মারবে, আর এখন বাবা-সোনা...একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বিশ্বাস করুন!
সৈকত
সেদিন রাতে আমাদের আর শক্তি ছিলো না শরীরে। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি তাড়াতাড়ি। পরদিন সকালে উঠে নিচের ঘরে গিয়ে শুনলাম আরেক ক্যামেরা-উৎসাহী ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে ছাদে ঘুরে সূর্যোদয় দেখেছে, দূরে বরফ-ঢাকা পাহাড় চুড়ো দেখেছে- সব মিলিয়ে বেজায় উত্তেজিত।
সৈকত
আজকেই চলে যেতে হবে, তাই তড়িঘড়ি প্রাতরাশ সেরে আমরা গেলাম লাভার বৌদ্ধ মঠ দেখতে। Kagyu Thekchen Ling Monastery আর ‘The Rigpe Dorje Institute. আগেও এসেছি এখানে। একই রকম সুন্দর। বেশি বর্ণনা করবো না। শুধু একটাই অনুরোধ- দয়া করে অনেকে মিলে দল বেঁধে গেলে সবাই একটুক্ষণ শহুরে অভ্যেস ত্যাগ করে চুপ করে থাকবেন। কথা দিলাম, বেশি ভালো লাগবে। আমাদের এবারের ঘোরাটাই প্রায় মাঠে মারা যাচ্ছিলো একদল কলকণ্ঠ বাঙালির কল্যাণে। শেষে নিজেরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে রেহাই পাওয়া গেলো। কি আর বলবো, ছোট ছোট লামারা পড়তে বসেছে ক্লাসে, তার পাশ দিয়ে হ্যা হ্যা করে ঘোরা, খ্যাচ্‌ খ্যাচ্‌ ছবি তোলা, নিজেকে ট্যুরিস্ট ভেবে খারাপই লাগছিলো।
সৈকত
সেদিনই দুপুরে আরও কিছু অ্যাডভেঞ্চার শেষে আমরা উঠে পড়লাম ফিরতি গাড়িতে, আবারও আসার প্রতিশ্রুতি জপতে জপতে। লাভা এত ঠাণ্ডা হলে না এসে পারা যায়!
***********************
যারা এখনই ব্যাগ গোছাতে শুরু করেছেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, ১৫ জুন থেকে ট্যুরিস্ট সিজন বন্ধ। আবার খোলে সেপ্টেম্বর মাসে। তবু ফোন করে যাওয়াই ভালো। হোটেল অজস্র Orchid হোটেলে ঘরভাড়া ৭০০-৯০০/-, খাওয়ার খরচ পাহাড় বলেই একটু বেশি কিন্তু টাটকা আর খুব ভালো খেতে। ওই হোটেলের নিজস্ব রেস্তোঁরা আর দোকান আছে। প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছুই সেখানে পাওয়া যায়। ওখান থেকে কাছাকাছি ঘোরার জন্য গাড়িভাড়া পাওয়া খুব সোজা। রাস্তার উলটোদিকেই সিন্ডিকেট। সেখান থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা হয়। তাই ঠকার কোন ভয় নেই। আমরা কলকাতা থেকে নন-এসি ট্রেনে করে যাতায়াত করেছি, ফলে এই দুর্মূল্যের বাজারেও সব মিলিয়ে জন-প্রতি খরচ হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের কম (নিজেদের খরচ কমাতে পারলে এর থেকেও কম লাগবে, বলাই বাহুল্য)- মোদ্দা কথা, সপ্তাহান্তে পাহাড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে লাভা আদর্শ। এবার তো আমরা লোলেগাঁও বা অন্য সব কাছাকাছি জায়গায় যাই-ইনি। একটু বড় ট্যুর করতে চাইলে সে আরও ভালো।


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই