Monday, July 2, 2012

অনুপম রায় ও একটি ক্যাসেট -- অনির্বাণ

"অ্যাই অনুপম, গীটারটা নিয়ে রিহার্সাল দে না। এটাকেই স্টেজ রিহার্সাল ভেবে নে, রি-ইউনিয়নের দিন হয়তো আর চান্সই পাওয়া যাবে না।" মৃদু ধমকে উঠলো, স্বাগতমদাT-3-7 এর বিশাল বড়ো স্টেজটার পাশে শোয়ানো ম্যাড়ম্যাড়ে গীটারটা নিয়ে অনুপমদাতৎকালীন
পানুদা, উঠে দাঁড়ালো। বাইরে তখন নিভু নিভু আলো। পড়ন্ত বিকেলের সেই কনে-দেখা লাল-হলুদ আলোটা, ঘেমো ইস্টবেঙ্গল জার্সির মতো, হলুদ-সবুজ-বাদামী পাতার ফাঁক দিয়ে, রাস্তার লম্বা বেরসিক উজ্জ্বল হ্যালোজেন আলোগুলোকে চোখের পলকে, ছোট্টো ডজে বোকা বানিয়েই, আবার হঠাৎ থেমে গিয়ে, জিন্‌স ছেড়ে অনভ্যস্ত শাড়ির শান্ত একুশের মতো, চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে, যাদবপুরের প্রায়ান্ধকার বিশাল ক্লাসরুমটায়। চার ফুট বাই চার ফুট কিউবিক্‌ল আর দশ ফুট বাই আট ফুট বেডরুম থেকে সে বিশালতার থই পেতে গেলে মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে যায়
সালটা ২০০২ কি ২০০৩, সবে হুই দূর-দেশে ২ টো ল-ম্বা বাড়ি ভেঙ্গেছেআর গুঁড়ো হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রদের বিদেশ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন এমনকি সামান্য একটা চাকরী জোটানোও মুশকিল হয়ে পড়েছে। রিহার্সালের মাঝেই খবর এসেছে, সেদিনের ক্যাম্পাসিং এ সিলেক্টেড স্টুডেন্টদের লিস্ট টাঙ্গানো হয়েছে, কিন্তু ইলেক্ট্রনিক্স ডিপার্টমেন্টের কারুর ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে নি। তো ফাইনাল ইয়ারের জনতা তাই একটু মনমরা। যাগ্‌গে, আসল গপ্পে ফেরা যাক, স্টেজের ডান দিক দিয়ে পানুদা ঢুকবে, মাঝে ‘গত্তো’ কিউ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে, বাঁদিকে ‘হেজু’।  দৃশ্যটা হল এরকম – একটি হাড়কিপটে এবং পয়সা-ওলা গেরস্ত বাড়িতে পাড়ার ছেলেরা চাঁদা নিতে এসেছে। ছেলেরা বলতে ওই হেজু, পানু, গত্তো আর চিন্টু। হেজু তাদের কাপ্তান, সে পোচ্চুর বলে কয়ে মানুষকে বশ করতে ওস্তাদ। কিন্তু, দুঁদে বাড়িওয়ালাকে সে শেষমেশ বোঝাতে পারলো না। অনেক কায়দা-কসরত, অনুনয়-বিনয় করেও কিস্যু লাভ হলো না। স্বাগতমদা, নাটকের ডিরেক্টর সিনটা বুঝিয়ে দিয়ে বল্লো, “শোন্‌ অনুপম, এই সময় স্টেজের আলোটা আস্তে আস্তে ডিম হয়ে যাবে, আর তুই গানটা ধরবি।“
গানের লিরিক্‌সের আগে সুরটা শোনা জরুরী। সুরটা কিশোর কুমারের জনপ্রিয় গানের থেকে নেওয়া।
“সেতো এলো না/
এলো না/
ক্যানো এলো না/
জানি না”।
তো চাঁদাভিলাষী প্রত্যাখ্যাত ছেলেপুলেগুলোর মাঝ থেকে পানুদা গান ধরলো,
“(ছাদের দিকে তাকিয়ে) টাকা দিলো না/
(প্রবল মাথা নেড়ে) দিলো না/
(গীটারটা প্রায় জাপটে ধরে) ক্যানো দিলো না/
(কাঁধ ঝুলিয়ে, মাথা নিচু করে) জানি না”।
যথা সময়ে রি-ইউনিয়নের দিন চলে এলো। চব্বিশ থেকে চৌষট্টি সবাই হাজির। একেবি, আমাদের সাদাচুল হেডু, সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি-ধুতি পরে, একটু ঝুঁকে গেটের কাছে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। পকেট থেকে মাঝে মাঝে সোনালি চেন-বাঁধা গোল পকেট-ঘড়ি বার করে বরযাত্রী-কখন-আসবে-টেনশনে সময় দেখছেন। হঠাৎই একজন বয়স্ক কিন্তু বেশ তেল-চুকচুকে মানুষ এসেই প্রবল হাঁক-ডাক শুরু করে দিলেন। একেবি’কে ডেকে, “এই তোর কোন ব্যাচ রে?” আমরা থতমত এবং হতভম্ব ১৯৪৭ এ জন্ম, ১৯৭২ থেকে একেবি ডিপার্টমেন্টে পড়ান। তাঁকে যে অচেনা কেউ তুই-তোকারী করে ডাকতে পারে, স্রেফ ধারণার বাইরে। একেবি স্বভাবসিদ্ধ নম্র ভঙ্গিতে উত্তর দেওয়া মাত্র ভদ্রলোক ছিটকে উঠলেন, “এ হেঁ হেঁ, আমার থেকে ৫ বছরের জুনিয়র, আর এই চেহারা!! একটু ওয়ার্ক আউট কর্‌।” তারপর সমবেত জনতাকে ধন্য করে ঘোষণা করলেন, তিনি ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ব্যাচ, তাঁর প্রফেসররা আজ আর কেউ ধরাধামে নেই, সুতরাং আজকের অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকেই নাম ধরে এবং তুই বলেই ডাকবেন।
আমার কিরকম জানি মনে হয়েছিল, নাটক শুরু হওয়ার আগে, একটা টেপ-রেকর্ডার ধার করে রেকর্ডিং শুরু করে দিলাম। পানুদা চেঁচিয়ে বল্লো, “আচ্ছা, এই রেকর্ডিংটার একটা কপি আমায় দিস তো, এটা তো একটা প্রোডাক্ট। জনে জনে বিক্রি করলেও তো বেশ কিছু টাকা রি-ইউনিয়ন ফান্ডে আসতে পারে।” সে আর করা হয় নি। নাটকটা অবশ্য দিব্বি জমেছিলো। সেটা প্রাক ইউটিউব যুগ, টিউশনি পড়ানোর টাকায় তখনো ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরা হতো না চল্লিশ টাকার ফিতে-ওলা অডিও ক্যাসেট কিনতেই নাভিশ্বাসরেকর্ডিং হলো, বেঁচে যাওয়া পয়সায় স্বাগতমদা মদ খাওয়ালো। আহা, আধো-অন্ধকারে, উন্মুক্ত ঝিলের ধারে ঝিরঝিরে বাতাস, স্মার্নভ আর নাটক ভালো নেমে যাওয়ার আনন্দ। ক্যাসেটটা পরে দু’একবার শোনা হলো বটে, কিন্তু শেষ অব্দি (আমার অতি প্রিয় বাংলা ইস্কুলের ঘষা-চশমা বাংলা স্যারের ভাষায়) মহাকালের অমোঘ সম্মার্জনীর আঘাতে, (এবার আমার ভাষা) ওটা পাতি হারিয়ে গেলো
যে url টা দেখে অ্যাত্তো বকবকানির শুরু – সেইটে হলো http://music.ovi.com/in/en/pc/Product/Anupam-Roy/Hemlock-Society/30399221 সেদিনের সেই পানুদা আজকে দারুণ সফল একটা প্রোডাক্ট ঝুঁকি নিয়ে, মোটা মাইনের প্রতিশ্রুত এবং পরীক্ষিত সুখের চাকরী ছেড়ে দিয়ে, আজ সে তার সেই গানের খাতাটা সবার কাছে খুলে বসেছে
মনে পড়ে, ভোটের সময় ইউনিভার্সিটিতে ফিকে-লাল দলের লোকজন গাঢ়-লালদের উস্কে দিয়ে পোস্টার মারতো, “অমলকান্তি নকশাল হতে চেয়েছিলো/ এন আর আই হয়ে গেলো” অনুপম রায়ও হয়তো শুধুই গান শোনাতে চেয়েছিলো, প্রোডাক্ট হয়ে গেলো। পাঠক/পাঠিকা, এটা কোনো বক্রোক্তি নয়, শুধুমাত্র ছিন্ন একটি অনুভূতি মাত্র তাতে আপনার ছেঁড়া যেতেই পারে, কিন্তু আমার অনুভূতিটা তো তাই বলে আপনি ছিনিয়ে নিতে পারবেন না। শ্যামল মিত্তির পারবেন, “ওখানে আমার মাতাল হৃদয় সেদিন গেছে যে হারিয়ে/ যাক্‌, যা গেছে তা যাক/ যাক্‌, যা গেছে তা যাক”।
আশা ছাড়ি নি, ওই ক্যাসেটটা আজও আমি বাড়ির চিলেকোঠায় খুঁজে বেড়াইপাই না, কিন্তু, সব পেলে তো নষ্ট জীবন।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই