Monday, July 23, 2012

বর্ষায় বসন্ত বিলাপ -- লিল্টু



“সে ছিল তখন উনিশ আমি তখন ছত্তিরিশ
প্রেমে পড়তে লাগে না বয়স মনে থাকেনা উনিশ বিশ” - নচিকেতা

সক্কাল থেকে শুধু
এই গানটাই মনে পড়ছে আর গুন গুন করে যাচ্ছি... কে জানে বাবা আজ আমার কি হয়েছিল? শেষ মেশ থাকতে না পেরে আমার হেল্পার একটু স্বভাব বিরুদ্ধ চড়া গলায় আমাকে বকে দিয়ে বললো- ‘কি হয়েছে দিদি তোমার? ওই দুটো লাইন-ই গেয়ে চলেছো? আর যে ভালো লাগছে না!' আমি পুরো
অ্যাঁ হয়ে গেলাম। তার আগে বুঝিওনি এ জিনিস কতক্ষণ ধরে করে চলেছি ও কি ভেবে বসেছে আমি কোনো অসমবয়সী প্রেমে পড়েছি? সে কি? আপনার ভুরুর ভাঁজটাও তো একই প্রশ্ন করছে দেখছি! এ মা! না, না, আমি এখন পুরোদস্তুর ‘single’! তবে, ওসব ‘mingle- টিঙ্গল কিনা? 
হুম... জানিনা। তবে ছোটো থেকেই ধপাধপ প্রেমে পড়ার স্বভাবটা কিন্তু আজও অক্ষত আছে। এই সিরিজের শুরুটা হয়ে ছিল প্রায় বছর বিশেক আগে সাউথ ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়ে। তখন আট-নয় বছর বয়স হবে হয়তো (ব্যস্‌, অমনি আমার বয়সটা হিসেব করা হয়ে গেল, তাই না?), আমাদের হোটেলের রুমে একটা ছেলে, বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়, প্রতিদিন সকালে হাজিরা দিত আমার জন্য এক গেলাস দুধ হাতে নিয়ে। ও ওই হোটেলেই কাজ করত। অতদিন আগে সমাজে শিশুশ্রম নিয়ে বোধহয় সতর্কতাও চালু হয়নি। কে জানে? সে সব জানা বা ভাবার তো সেটা বয়স ছিল না। মা বাবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সৌন্দর্যে বিভোর থাকতেন আর আমি ওই নাম না জানা ছেলেটার সাথে সকালের অনেকটা সময় বক বক করে আর খেলে কাটাতাম। একদিন তো আমার জন্যে কাজের দেরী হয়ে যাওয়ায় বেচারা বকাও খেল মালিকের কাছে। ইস্‌!, খুব বাজে কাজ হয়েছিলো। ওই অল্প ক’দিনেই ওর সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আর ছেলেটাও বোধহয় নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রায়ই চলে আসত আমার সাথে সময় কাটাতে। হোটেলে কাজ করার দরুন ভাঙা-চোরা ইংরিজিও বলতে পারত। যে ভাষায় আমরা বাক্যালাপ করতাম তার একটা রেকর্ডিং থাকলে আজ ভালো হাসির খোরাক পাওয়া যেত। ঘটনাগুলো হয়তো আদৌ মনে থাকতো না, কিন্তু আমরা ফিরে আসার আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় মা ঘরে গার্গলের গরম জল চেয়ে পাঠালেন। অমনি মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বান্দা হাজির। মা বাথরুমে সেই জল নিয়ে ‘গা...গা...’ করে সুর তুলেছেন, বাবা ব্যালকনিতে সিগারেট আর বইয়ে মগ্ন। সে ব্যাটা ঘরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম- ‘কি হয়েছে তোমার? খেলবে?’ বলতে না বলতেই মুখ তুলে চট করে বা চোখটা একটু ছোট করে (চোখ মারার একটা ব্যর্থ চেষ্টা) আমার উদ্দেশ্যে একটা ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিয়ে পালালো। সেদিন প্রথম উপলব্ধি করলাম মানুষের হৃদযন্ত্রটি বুকের ‘বাম’ দিকে থাকে... J ফিরে আসার আগে আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের পাজ্‌ল-গেম টা ওকে gift করে এসেছিলাম। জানিনা সে ধাঁধা ও কোনদিন সমাধান করতে পেরেছে কিনা, তবে আমি ট্রেনের কামরাতেই শেষ চোখের জল মুছে স্মৃতিগুলোকে সব গিলে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। জীবনে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা তো, তাই না বলে পারলাম না।
ছাত্রছাত্রীদের নাকি টিচারের প্রেমে পড়াটা একটা অতি 'কমন' অভ্যেস তখন সে সব কথা না জানা থাকলেও আমার প্রেমপর্বের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষকেরা। বিভিন্ন বয়সী কেন? বোর্ড এক্সামের আগ দিয়ে আমার বাবার মনে হয়েছিল মেয়ে ভৌত বিজ্ঞান নামক বিষয়টিতে ভয়ানক কাঁচা। কারণ আছে। তার আগের পরীক্ষায় ওই দুর্বোধ্য বিষয়টিতে টেনে টুনে পাশ নম্বরটা তুলে মান বাঁচিয়েছিলাম। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে বাড়িতে ভালো মতো তালিম দিতে আমার জন্য জোগাড় করা হল M.Sc. ফিজিক্স পাঠরত এক ছাত্রকে। আমার ধারণা ছিল সায়েন্সের ছেলেদের মধ্যে কেমন একটা সবজান্তা মতো ভাব থাকে- তারপর যদি ফিজিক্স হয়, তাহলে তো কথাই নেই। কাজেই এর প্রতি শুরু থেকেই একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন তো ওর পাড়াতে আসার সময় হলে বাথরুমে ঢুকে বসে থাকতাম। এমনকি আমার কুকুরটাকে দু’-এক বার ওর দিকে লেলিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছি। সফল হইনি যদিও। মনে হয় ওই বোবা প্রাণীটাও বুঝেছিল- একে চটালে আসন্ন পরীক্ষায় আমার ভয়ানক দুর্গতি হতে পারে। প্রথম কিছুদিন চললো এই মন কষাকষির পর্ব। ওরও নিশ্চয় আমার প্রতি সমপরিমাণ বিরক্তি হয়েছিল কি ভাবছেন? এই গোলমাল মিটলো কীভাবে? ওই যে সেই একই পুরনো ফর্মূলা, যারে ইংরিজি তে বলে- ‘common interest’; সেদিনের সিলেবাস ছিল ‘শব্দ’। সেদিনের পড়ার পাঠ চুকিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো – ‘আচ্ছা, পুষ্পক সিনেমাটা দেখেছো? কোথায় যেন নৈঃশব্দই সব কিছু ব্যাখ্যা করে দেয়’। আমি নির্বাক। সেকি! এও সিনেমা দেখে? তাও আবার ‘পুষ্পক’! আমি তার কিছুদিন আগেই এই সিনেমাখান দেখে আপ্লুত। আমার বন্ধুরা তখনো সিনেমাটা দেখে ওঠেনি, কাজেই আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম – কি বলেছি না বলেছি আজ তার কানাকড়িও মনে নেই, তবে খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম। তারপর থেকে মানুষটাকে গুরুত্ব দিয়েছি – ওর নিজের বিষয়ে দখলের পাশাপাশি আরো অনেক গুণ আমার ভাল লেগেছে। হয়তো বয়স অল্প হওয়ার জন্যেই। খাতাটা আজ-ও আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। ছুটিতে বাড়ি গেলে অন্তত একবার সেটা উল্টে দেখি। সেই পাঁচ-ছমাস আমার outsourcing বেশ ভালোই হয়েছিল বলা চলে। শেষ যেদিন আমাদের দেখা হয়, মানে আমার রেজাল্টের দিন, ও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল- ‘তোমার হাতের চুড়িটা কি বিশেষ কারুর দেওয়া? ’ ফ্যালফেলিয়ে আমি বলেছিলাম, ‘কই না তো!’ প্রতিক্রিয়াটা বর্ণনা করার মতো ভাষার জোর আমার নেই। কাজেই সেই মুহূর্তটা না হয় আমার-ই থাক। সব কি আর ভাগ করে নেওয়া যায়? সে সব ফেসবুক এর জমানা ছিল না। ও চলে গেল বাইরে পড়াশুনো করতে। আমি জীবনের পরবর্তী সিঁড়িতে পা দিলাম। কাজেই আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। ও হ্যাঁ, ভৌতবিজ্ঞানে নম্বরটা কিন্তু ভালোই পেয়েছিলাম। আর এরপর থেকে কাউকে পুরোটা না চিনে বিচার করাটাও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। 
এই একই পথে আরো একবার মাস্টার মশাইয়ের ওপর হুলাবিলা ফ্রাস্টু খেয়েছি। সেটা অবশ্যি একটু বড় বয়েসে। আর সেটাকে প্রেমও বলা চলেনা। বড়জোর একটা মজার অভিজ্ঞতা। এটাকে ‘Harry Potter Effect’ নাম দেওয়া যেতে পারে। স্যার আমাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতেন। যেমন পড়াতেন তেমনি সুন্দর আড্ডাও দিতেন। যেকোনো ছোট খাটো সমস্যা নিয়ে আমরা ওঁর কাছে হাজির হতাম। সব-ই ঠিক ছিল গোল বাধলো ওঁর ওই হোমরা-চোমরা চেহারার জন্য। এমনিতেই কমার্সের ক্লাস-মেয়ের সংখ্যা কম, তাতে আমি আবার... মানে গাঁতটাও মন্দ দিতাম না। কাজেই একটু আধটু নজরেও পড়তাম। Harry Potter-ভক্তরা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন আমার গল্প কোন দিকে এগোচ্ছে- আরে হ্যাঁ, আর পাঁচটা মেয়ের মতো নিজেকে Hermione ভাবার বিলাসিতা, আবার কি? আর স্যার Hagrid। মনের মতো করে Harry Potter series টা ছকে ফেলেছিলাম। সে এক দারুণ অনুভূতি। আর সেটা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র স্যারের জন্য-ই। বলাবাহুল্য ক্লাসে Harry কে খুঁজে পেলেও Ron-এর দেখা এবারও পাইনি।
এরম কিস্‌সা আরো আছে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এতদূর পড়েই আপনারা আমাকে বেজায় গাল দিচ্ছেন। যদি তা না হয় তাহলে জানাবেন, আমি কিন্তু আরও গপ্পো বলতে প্রস্তুত। আর পাঠকেরা- এসব পড়ে যদি আপনার আমাকে আঁতেল, পেছন পাকা বা কুৎসিত কোনোটা মনে হয় তাহলে বলে রাখি আজ্ঞে না এর কোনোটাই আমি নই। এই বয়সেও একটা আস্ত প্রেম করতে না পারার যতটা দুঃখ আপনার আছে ততোটাই আমারও আছে। বিশেষ করে বন্ধুরা যখন couples day/night out করে –সেদিনের ভাটটা মিস্‌ হয়। তখন নিজের অক্ষমতাকে গালি দিই। যখন সব বন্ধুদের ফোন ব্যস্ত পাই আর কাউকে বিরক্ত করতে চাইলেও পারিনা তখন বড্ড একা লাগে- নাহ্‌, আর প্যান প্যান করবো না। আপনারা যদি আমার প্রতি যথেষ্ট সদয় হন তো প্লিজ কমেন্ট করে জানান। আমার detail? সে তো FB ফ্রেন্ড হলেই জেনে যাবেন।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই