Monday, July 16, 2012

ওটা ‘কণা’- ঈশ্বর নয়, হাঁদারাম! ** -- সুনন্দ

**Dr. Dave Goldberg বলেছেন, ‘হাঁদারাম’টা ভাবানুবাদ J

আপনি যদি সদ্য আবিষ্কৃত একটি কণার ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে সম্প্রতি কিঞ্চিৎ বিপাকে পড়ে থাকেন, অথবা বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও এর সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জানায় বাড়ির লোক থেকে শুরু করে প্রতিবেশীদের উদ্ভট সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়ে থাকেন, বা এর
আবিষ্কারের সঙ্গে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের যোগাযোগ সংক্রান্ত মিডিয়ার হাভাতেপনা আর উটকো ফিজিক্স স্কলারদের বক্রোক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসু হলেও, কঠিন আর ভারীভারী সব প্রবন্ধ পড়তে না পেরে থাকেন,
তবে নিশ্চিন্তে আসুন, এই লেখা আপনাদের জন্যেই।

প্রথমেই ঠিক করে নেওয়া যাক, আমরা কি কি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। সেগুলো হলো,
১) হিগ্‌স্‌ বোসন এই কণাটা খায়, মাথায় দেয় নাকি পাশবালিশ হয়ে বগলের তলায় ঢোকে?
২) সত্যেন বোস কি নস্ত্রাদামুস এর মতো Higgs Boson এর ভবিষ্যৎবাণী করে গেছিলেন? তাহলে কি ঐ পিটার হিগ্‌স্‌ নামের লোকটা আবার বাঙালির পো’র পিছনে পড়লো? নাকি এ সব শুধুই গল্পকথা?
৩) এটাকে ঈশ্বর কণা কেন বলে? এই লেখার শিরোনাম সত্যি হলে কোন ইস্টুপিড ওটাকে পরম করুণাময়ের সাথে মিলিয়েছিলো? কেনই বা?
আমরা অতি চালাক। খেটেখুটে যাঁরা অনেক কিছু লিখে ফেলেছেন ইতিমধ্যে বাংলায় এ সব নিয়ে, মূলত তাঁদের লেখাই টুকবো। লেখার সূত্র উল্লেখ করা থাকবে, আসল লেখাগুলো পড়তে বার বার অনুরোধ করছি। অনেক বেশি কিছু জানতে পারবেন, নির্ঘাৎ!

Higgs Boson (হিগ্‌স্‌ বোসন) আসলে কি?

যাঁদের কিচ্ছু জানা নেই বা মনে নেই কণা-পদার্থবিদ্যা নিয়ে, তাঁদের জন্য রইলো নিচের 'কণাদের নিয়ে কানাকানি' অংশটা
('মুক্তমনা'র প্রতিষ্ঠাতা এবং সুলেখক অভিজিৎ রায়ের অদ্ভুত সরল আর স্বচ্ছ লেখা থেকে)। জ্ঞানীরা স্বচ্ছন্দে পেরিয়ে যেতে পারেন। লেখাটা নিচের লাইনে গুটিয়ে রাখা আছে। পড়ার জন্য লাইনে ক্লিক করুন, আবার গুটিয়ে রাখতেও তাই:

কণাদের নিয়ে কানাকানি HG

“...পদার্থ ভেঙ্গে অণু। অণু ভেঙ্গে আবার পরমাণু । পরমাণু ভাঙ্গলে পাচ্ছি ইলেকট্রন আর নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসকে ভাঙলে প্রোটন আর নিউট্রন। আর ইলেকট্রনকে ইলেকট্রনের জায়গায় রেখে প্রোটন আর নিউট্রনকে ফের ভেঙ্গে পাওয়া গেল কোয়ার্ক। তাহলে এখন পর্যন্ত যা পেলাম তাতে করে কোয়ার্ক এবং ইলেকট্রনই হল পদার্থের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সত্ত্বা, যাদেরকে আমরা বলছি প্রাথমিক কণিকা। ভাবছেন এখানেই শেষ? মোটেই তা নয়। বিজ্ঞানীরা দেখলেন কোয়ার্কগুলো একেবারে পাজির পা-ঝাড়া। তাদের আছে হরেক রকমের (আসলে ছয় রকমের) চেহারা – আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ এবং বটম।  এর মধ্যে প্রোটন তৈরি হয় দুটো আপ আর একটা ডাউন কোয়ার্কের সমন্বয়ে, আর অন্যদিকে নিউট্রন তৈরি হয় একটা আপ আর দুটো ডাউন কোয়ার্ক মিলে। তাহলে আমাদের প্রাথমিক কণিকা অনুসন্ধানের ছবিটা কিরকম দাঁড়ালোদাঁড়ালো অনেকটা এরকমের –

এগুলো তো পাওয়া গেলই, কিন্তু পাশাপাশি কিছুদিন পরে আরো পাওয়া গেল দুটো নতুন কণা। এগুলো দেখতে শুনতে ইলেকট্রনের মতো হলেও ওজনে কিঞ্চিৎ ভারী।  এরা ইলেকট্রনের খালাতো দুই ভাই মিউয়ন এবং টাউ।
আর ওদিকে আরেকদল বিজ্ঞানী এর মধ্যে  খুঁজে পেয়েছেন আরো অদ্ভুতুড়ে এক কণা নিউট্রিনো নাম তার... তাহলে... ইলেকট্রন, আর তার দুই খালাতো ভাই (মিউয়ন এবং টাউ), ছয় ধরণের কোয়ার্ক আর তিন ধরণের নিউট্রিনো এরাই হল সেই প্রাথমিক কণা, যা গ্রীক পণ্ডিতেরা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন।

সহজভাবে বললে, এই বারো ধরণের প্রাথমিক কণা দিয়ে আমাদের চেনা জানা দৃশ্যমান সবকিছু তৈরি। এদের বলে ফার্মিয়ন। এই ফার্মিয়নদের কেউ চাইলে সাবগ্রুপে ভাগ করে ফেলতে পারেন। সেই যে ছয় রকমের হতচ্ছাড়া কোয়ার্কের দল- তাদের একটা গ্রুপে রেখে বাদবাকিগুলোকে (মানে ইলেকট্রন, মিউয়ন আর টাউ) অন্য গ্রুপে পাঠিয়ে দিতে পারেন ইচ্ছে হলে।  প্রথম গ্রুপটাকে কোয়ার্কস আর  অন্য গ্রুপটাকে লেপটনস নামে অভিহিত করা হয়। এই ফার্মিয়নগুলোর একটা ছবি দেয়া যাক। অনেকটা আমরা ছেলেবেলায় রসায়নের বইয়ে যে পিরিয়ডিক টেবল বা পর্যায় সারণীর ছবি দেখেছিলাম, তার একটা সরল ভাষ্যের মত মনে হবে। মনে রাখাও তাই সহজ।

এই ফার্মিয়ন কণাদের নিয়ে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার।  উলফগ্যাং পালি  বলে এক নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ছিলেন, স্বভাবে মহা রগচটা। কারো গবেষণা বা তত্ত্ব অপছন্দ হলে মুখের উপর বলে দিতেন – ধারণাটা ‘এতোই বাজে যে, ভুল হবারও যোগ্য নয়’। সেই পাউলি সাহেবের একটা নীতি ছিল, যার মূল কথা হল ইলেকট্রনের ঘূর্ণন ভগ্নাংশ আকারে মান গ্রহণ করতে পারে, যেমন ১/২ । একটি বিষয় মনে থাকলেই চলবে – ফার্মিয়নদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল – এরা সব পাউলির নীতির অন্ধভক্ত।
তবে মহাবিশ্বে সবাই যে অন্ধ অনুগত স্তাবক হবেন, তা তো নয়। কিছু কিছু বিদ্রোহী কণা আছে, যারা …পাউলির বর্জন নীতি মানে না। অর্থাৎ এদের স্পিন বা ঘূর্ণন ভগ্নাংশ নয়, এদের স্পিন হয় পূর্ণ সংখ্যা কিংবা শূন্য। এরাই হচ্ছে বিখ্যাত বোসন কণা – বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামে যাদের নাম।

ফোটন কণার কথা যে আমরা অহরহ শুনি সেটা একধরনের বোসন কণা। এরা কী করে? সোজা কথা আলোক কণিকা বা তরিচ্চুম্বক তরঙ্গ বয়ে নিয়ে যায়। এরা শক্তি বয়ে নেওয়ার কাজ করে বলে একে ‘বার্তাবহ কণিকা’ বা মেসেঞ্জার পার্টিকল বলেও ডাকা হয়। তড়িচ্চুম্বক বলের ক্ষেত্রে বার্তাবহ কণিকা যেমন হচ্ছে  ‘ফোটন কণিকা’, তেমনি সবল নিউক্লিয় বলের ক্ষেত্রে আছে ‘গ্লুয়ন’ (Gluon) আর দুর্বল নিউক্লিয় বলের জন্য রয়েছে  W এবং Z কণা। এরা সবাই মিলে তৈরি করে বোসন পরিবার –গেজ বোসন।  আর খুঁজে পাবার পর হিগ্‌স বোসনকেও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হচ্ছে … এইবার কণা পরিবারের ছবিটা তাহলে এক ঝলক দেখা যাক –

..."

উপরে যা কিছু পড়লেন, সেটা PHD(Piled Higher and Deeper) Comics এর Jorge Cham এর কাছে সহজে কার্টুনে দেখে নিন (তিন মিনিটের ভিডিও):



উপরের গল্প থেকে যা বোঝা গেল, তা হল, অন্য কয়েকখানা বোসনের মতো হিগ্‌স্‌ও বোস-আইন্সটাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। কিন্তু, বাকি বোসনগুলোর থেকে এটা আলাদা কোথায়? উত্তর দিচ্ছেন Henry Reich, বিখ্যাত ইউটিউব ভিডিও চ্যানেল Minute Physics এর নির্মাতা:
ক) প্রথম ব্যাখ্যা- পদার্থ (matter) আসলে কি?


যদি ভিডিওর বক্তব্য মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে থাকে: HG
কল্পনা করুন, সর্বত্র, মানে ত্রিলোক জুড়ে ছড়িয়ে আছে এমন কিছু (ধরে নিন তাকে বলে ‘কোয়ান্টাম ফিল্ড’), যার ফলে মহাবিশ্বের যে কোন জায়গায় সেই ফিল্ডকে উত্তেজিত করলেই সে বদলে ছুঁড়ে দিচ্ছে কিছু কণা, যারা সব দিক দিয়ে একেবারে এক রকম। ঠিক যেমন সর্বত্র ২ আর ১ যোগ করলে ৩ হয়, আর যে কোন একটি ‘৩’, বাকি সব ‘৩’ এর সাথে identical- সেরকম। এই ফিল্ড অনেক কিছুর হতে পারে, যেমন ইলেক্ট্রন(e-), কোয়ার্ক(q) বা নিউট্রিনো(ν)। এরা আবার ফার্মিয়ন বলে নিজেরা নিজেদের এই মিল মোটেই সহ্য করতে পারে না। সেই কারণে একই quantum state এ একের বেশি ফার্মিয়ন থাকতে পারেনা। (মানে, খুব মোটা দাগের কথায়, অল্প জায়গায় বেশি পদার্থ থাকতে পারেনা – সে আর নতুন কথা কি?)
আবার, ৩ এর মতো ‘- ৩’ ও যেমন পাওয়া যেতে পারে মহাবিশ্বের সর্বত্র, তেমনি, ইলেক্ট্রনের উলটো ‘পজিট্রন’(e+)ও পাওয়া যায়। এটাও সব ফার্মিয়নের ক্ষেত্রে সত্যি। শুধু তাই নয়, ৩ আর ‘- ৩’ যোগ করলে যেমন হাতে পড়ে থাকে পেন্সিল, মানে শূন্য, তেমনি e- আর e+ গুঁতো খেলে কিচ্ছু থাকে না, শুধু শক্তি।
মোদ্দা কথা, পদার্থ হলো, যা ‘জায়গা’(space) দখল করে থাকে।


খ) দ্বিতীয় ব্যাখ্যা – বুঝলাম, তবে পদার্থের ভর আসলে কি, আর তার সাথে হিগ্‌স্‌ এর সম্পর্কই বা কি?


যদি ভিডিওর বক্তব্য মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে থাকে: HG

প্রথমেই মনে রাখতে হবে, আলোর গতিবেগ বলে আমরা যাকে চিনি, সেই ৩ লক্ষ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডের দানবীয় গতিবেগটা আসলে আলোর একচেটিয়া নয়। এটা যে কোন ভরহীন কণার গতিবেগ। যেহেতু আমরা প্রথম ভরহীন কণা বলতে চিনেছি ফোটন কে, তাই এই নামটা থেকে গেছে। ভরশূন্য কণারা এদিক-ওদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি, অন্য কণাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি – এ সব করতে পারলেও, ওই গতিবেগের থেকে আস্তে মোটেই চলতে পারে না। তাহলে কি দাঁড়ালো? ভর হলো সেই ধর্ম, যা পদার্থকে আলোর থেকে কম গতিবেগে চলতে, এমনকি স্থির থাকতেও সুযোগ দেয়। যার ভর যত বেশি, তার গতিবেগ পাল্টাতে তত কষ্ট। এবার আসল মজা! যদি আমাদের তত্ত্বে (Standard Model) কোন হিগ্‌স্‌ ফিল্ড (মনে রাখতে হবে, হিগ্‌স্‌ বোসন নয়, ফিল্ডের কথা বলা হচ্ছে, যে ফিল্ডের কথা আমরা এর আগের ভিডিওতে দেখেছি। হিগ্‌স্‌ বোসন হলো এই হিগ্‌স্‌ ফিল্ডকে কোন বিন্দুতে উত্তেজিত করার ফলে তৈরি কণা) না থাকতো, তবে কোন পদার্থেরই ভর থাকতো না!
কিন্তু আমরা তো আর আলোর গতিবেগে ইদিক-সিদিক উড়ে বেড়াচ্ছি না- তবে? দেখা গেলো, যদি ধরে নিই, সর্বত্র হিগ্‌স্‌ ফিল্ড বেশ ভালো মাত্রায় ছড়িয়ে আছে, আর যে সব কণা তার সাথে interact করতে পারে, তারা প্রায় সর্বদা হিগ্‌স্‌ এর সাথে সক্রিয় মেলামেশা চালিয়েই যাচ্ছে, তবে সেই সব ধাক্কা-ধাক্কি, গুঁতো-গুঁতি সব যোগ করলে দেখা যাবে, যেন তারা আলোর থেকে কম গতিতে চলছে, এমনকি, কখনো কখনো স্থির হয়েও আছে। অর্থাৎ, তাদের ভর আছে!
শুধু তা-ই নয়, এই ফিল্ড নিজের উত্তেজিত অবস্থা, অর্থাৎ, হিগ্‌স্‌ বোসন কণার সাথেও এত বেশি interact করে, যে সেই বোসনের ভর অন্য কণাদের থেকে অনেকটা বেশি আর সেই কারণেই তাদের খুঁজে পাওয়া অনেক বেশি শক্ত।

বাঙালির হিগ্‌স্‌ আর সত্যেন বোস – হা ‘ঈশ্বর’!!

এতক্ষণ ধরে যা বলা হলো, তার মধ্যে কোথাও দেব-দানব, ঈশ্বর-শয়তান এ সব দেখতে পেয়েছেন? পাননি তো? এদিকে,
“...সদ্যোজাত এই ঈশ্বর-কণার নামকরণ লইয়া বিশ্বব্যাপী, বিশেষত: বঙ্গদেশে প্রবল বিতর্কের সূত্রপাত হইয়াছে। জৈবিক পিতৃ-মাতৃহীন এই কণার নামকরণের গুরুদায়িত্ব জনসাধারণ স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া আপনাপন অযোগ্য স্কন্ধে উত্তোলন করিয়াছেন। যন্ত্রজাত হইবার কারণে এইরূপ কোনও কণার আবির্ভাব সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বক্তা বিজ্ঞানীপ্রবর স্বনামধন্য শ্রী পিটার হিগস মহাশয় এবং উক্ত ঈশ্বর-কণা কর্তৃক অনুসৃত পরিসংখ্যান বর্ণনাকারী প্রখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের নামানুসারে শিশুর নাম হিগস বোসন স্থির হইলেও তাহা লইয়া গোল বাধিয়াছে। শ্রী পিটার হিগস ব্যতীত এই কণার আবির্ভাবের সম্ভাবনা ব্যক্তকারী অন্যান্য বিদেশী বৈজ্ঞানিকগণের নাম যেমন শিশুর নামে অন্তর্ভুক্ত করিবার দাবি উত্তোলিত হইয়াছে, তেমনই একশ্রেণীর আত্মাভিমানী বঙ্গবাসী বাঙালি-ভাবপ্রবণতার এবং জাত্যভিমানের  চিরাচরিত ধারা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া বোসন শব্দের ম্লেচ্ছ রূপে 'B' বৃহৎ হস্তাক্ষরে লিখিবার দাবি জানাইয়াছেন। রাতারাতি বাংলার বিজ্ঞানীকুলোশিরোমণি বসু-মহাশয় বাঙালিমহলে সৌরভোচিত জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছেন, জীবিত থাকিলে ব্যাপার দেখিয়া ভদ্রমহোদয়ের চক্ষু যে চড়ক-বৃক্ষে গিয়া উঠিত তাহা নিশ্চিত।

আড্ডা-প্রহারে সিদ্ধহস্ত বাঙালি যথারীতি স্থানীয় রেলযানে ভ্রমণকালে, বাসে ঝুলন্ত অবস্থায়, অথবা দৈনিক কর্মাবসানে চায়ে 'আহহহ' শব্দসহযোগে চুমুকপূর্বক নবজাতক ঈশ্বর-কণার ঠিকুজি-কুলজি সন্ধানে ব্যস্ত হইয়া  উঠিয়াছে। পিতা-মাতা আপন সন্তানদিগের সম্মুখে অমর সাফল্যের মাপকাঠি হিসাবে শ্রী সচিন তেন্ডুলকর মহাশয়ের একশত শতরান, শ্রী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মহোদয়ের দুষ্ট গ্রেগ চ্যাপেলকে কদলী প্রদর্শনপূর্বক ভারতীয় ক্রিকেটদলে প্রত্যাবর্তন, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ শ্রী অমর্ত্য সেনের নোবেলজয় প্রভৃতির সহিত ঈশ্বর-কণার জন্মদানের উদাহরণ স্থাপন করিতে লাগিয়াছেন। সংবাদমাধ্যম বঙ্গবাসীর সম্মুখে সুনিশ্চিত-সাফল্যের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় জীবনযাত্রার উদাহরণস্বরূপ ঈশ্বর-কণার যন্ত্র-জন্মের সহিত যুক্ত বাঙালি বিজ্ঞানীগণের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নিরন্তর প্রকাশ করিয়া চলিয়াছে। শ্রী-বসুর গর্বে গর্বিত বঙ্গপুঙ্গবেরা ফেসবুক, গুগল প্লাস প্রভৃতি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ভক্তিসহকারে চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক স্বল্পজ্ঞান-নির্ভর দুঃসাহসিক 'হিগস বোসন পাঁচালি' রচনা করিয়া চলিয়াছেন, যাহা ক্রমশ: বৈজ্ঞানিকগণের বিশেষ গাত্রদাহের কারণ হইয়া উঠিতেছে। রন্ধনে স্বাদ আনিবার জন্য পাচক যেমন বিবিধ মশলাদির প্রয়োগ করিয়া থাকে তেমনই সাংবাদিকগণ তাঁহাদের সংবাদের স্বাদবৃদ্ধির নিমিত্ত রকমারি মশলার সন্ধান করিয়া ফিরিতেছেন এবং দিবারাত্র মধুভাণ্ডে মক্ষিকার ন্যায় বিজ্ঞানীদিগের আশেপাশে ভনভনাইয়া চলিয়াছেন…
(আমাদের বন্ধু অমিত পাল এর Supposedly True ব্লগ থেকে)


গোলমালটা কোথায়?

প্রথমত: জনতার দাবি, হিগ্‌স্‌ কথাটার পরে যেহেতু বোসন আছে, তাই বঙ্গ-সন্তান সত্যেন বোসের নামেই আসলে ওই কণার নাম, উনিই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন এই কণার অস্তিত্ব নিয়ে আর সেই কারণে তাঁকে মরণোত্তর নোবেল দিতে হবে। এতক্ষণ লেখাটা আদৌ পড়ে থাকলে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, যে সেই যুক্তি অনুসরণ করলে W, Z এমনকি আমাদের সবার পরিচিত ফোটনের নামও বলতে হয় ওঁর নামে, আর উনিই দায়ী এই সব কণার আবিষ্কারের পিছনে। আবার, সব ফার্মিয়নের জন্যেও কৃতিত্ব প্রাপ্য বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির। একটু বাড়াবাড়ির গন্ধ আসছে না?

কিন্তু মুশকিল হলো, সাধারণ মানুষ ছাড়াও যখন অন্যেরা এ সব কথা বলতে শুরু করেন, তখন গণ-হিস্টিরিয়া ঠেকায় কার সাধ্যি? এই দেখুন, এই লেখায় যে লেখক বলছেন
"...ভারতীয় হিসেবে গর্ব বোধ করছি। সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে ধরনের কণার কথা বলে গিয়েছিলেন, অবশেষে সেই জাতের কণারই চিহ্ন মিলেছে যে! আমি মনে করি, সার্ন-এর আবিষ্কার সত্যেন্দ্রনাথের প্রতি বিনম্র প্রণাম...",
তাঁর আবেগের কারণ সম্পূর্ণ থাকলেও তিনি কি ভেবে দেখেছেন, সাধারণ মানুষ এর কি মানে করতে পারে?

দ্বিতীয়ত: ওই অতি ভয়ঙ্কর 'ঈশ্বর-কণা' নামটি।

পরিষ্কার করে বলা দরকার: ঈশ্বর-কণা বলে কোত্থাও কিচ্ছু নেই!!
ব্যাপার জানতে এখানে ক্লিক করুন: HG


“…হিগ্‌স বোসনের নাম ঈশ্বর কণা মোটেই ছিলো না প্রথমে। এমনকি এখনো পদার্থবিজ্ঞানের সরকারী পরিভাষায় এটা নেই। এটা ‘ঈশ্বর কণা’ হিসেবে পরিচিতি পায় নোবেল প্রাইজ বিজয়ী বিজ্ঞানী লিওন ল্যাডারম্যানের একটি বইয়ের প্রকাশনার পর। বইটার শিরোনাম ছিলো – The God Particle: If the Universe Is the Answer, What is the Question? বলা হয় কণাটির গুরুত্ব বোঝাতে নাকি ঈশ্বর শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হল, লেখক নাকি নিজেই বইটির নাম ঈশ্বর কণা না রেখে ‘ঈশ্বর-নিকুচি’ কণা (Goddamn Particle) হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার উৎস উল্লেখ করে লেখা হয়েছে এখানে
"…অনাবিষ্কৃত কণাটির গুরুত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝাতে ১৯৯৩ সালে কলম ধরেছেন লিও লেডারম্যান। বইয়ের নাম কী হবে? লেডারম্যান বললেন, “নাম হোক হিগ্‌স বোসন।” ঘোর আপত্তি প্রকাশকের। বললেন।, “এমন নামের বই বিক্রি হবে না। ভাবা হোক জুতসই কোনও নাম।” বিরক্ত লেডারম্যান বললেন, “তা হলে নাম থাক গডড্যাম পার্টিকল।” অর্থাৎ, দুচ্ছাই কণা। প্রকাশক একটু ছেঁটে নিলেন সেটা। বইয়ের নাম হল ‘দ্য গড পার্টিকল’। নামের মধ্যে ঈশ্বর! বই বিক্রি হল হু হু করে। …"
ব্যাপারটা ঠিক এরকমভাবেই ঘটেছিল কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চয়তা দিয়ে না বলা গেলেও লেখক আসলে তার বইয়ের জন্য গড পার্টিকলের বদলে গডড্যাম পার্টিকল প্রস্তাব করেছিলেন,আর প্রকাশক শেষ সময়ে সেটা পরিবর্তন করেন, তার উল্লেখ আছে এখানে, এখানে কিংবা এখানে ... পিটার হিগ্‌স যে নাস্তিক এবং নিজেই হিগ্‌স কণাকে ‘ঈশ্বর কণা’ বলার সাথে একদমই একমত নন, তার প্রমাণ মেলে এখানে। তাঁর ভাষ্যেই –
"I find it embarrassing because, though I’m not a believer myself, I think it is the kind of misuse of terminology which I think might offend some people."
...তবে আশার ব্যাপার হল, আমরা জেনেছি – সার্নের পুরো কনফারেন্সে বিজ্ঞানী ও সাংবাদিক সবাই এই নামটা সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেছেন। এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই নাম উচ্চারণ না করতে...
(অভিজিৎ রায়ের লেখা থেকে)
মোদ্দা কথাটা অমিত নিখুঁত বলেছে:
"অনর্গল ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে আমরা সকলেই সদ্যোজাত শিশুটিকে বিস্মৃত হইয়াছি। জন্মাবধি তাহার ঈশ্বরত্ব অথবা নিরীশ্বরত্ত্ব, নাম এবং নামের বানান লইয়া এমনি মাতিয়া উঠিয়াছি যে সদ্যোজাতের শুভাশুভ সম্পর্কে খবর রাখি নাই। সে কেমন আছে, কি খাইতেছে, প্রাত্যহিক প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্মাদি ঠিকভাবে সম্পাদন করিতেছে কিনা সে বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখা যাইতেছে না। ইহা কেবল আমাদের মানসিক সুস্থতার অভাবই প্রমাণ করে তাহা নহে, শিশুটির পক্ষেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সূচনা করিয়া থাকে।

ঈশ্বর উহাকে ভাল রাখুন।"
হিগ্‌স্‌ কণার গান শুনেছেন? ATLAS ডিটেক্টরের থেকে পাওয়া তথ্য সাজিয়ে সঙ্গীত বানিয়েছেন ছ্যাবলা বিজ্ঞানীর দল। বিস্তারিত এইখানে। নিচের ছবিতে গোল্লা পাকানো অংশটা হিগ্‌স্‌ এর পরিচায়ক:


চলুন, সেই গান (আসলে বাজনা) শুনে শেষ করা যাক আজকের আড্ডা:


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই