Monday, July 30, 2012

ফটিক ও বিরিঞ্চি বাবা-৩ -- ঘনাদা



উদ্ভট হাস্যরসের পরিবেশন আমরা দেখি, বিরিঞ্চি বাবা, মহাবিদ্যা, কচি সংসদ, চিকিৎসা সংকট, উলট পুরাণ; এই সব
গল্পে। ভণ্ডামি, জোচ্চুরি, ভাববিলাস, সমাজ বিরোধিতাকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। এটা আমাদের অজানা নয়, ব্যঙ্গ অনেক সময়েই রূপকের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যেমন, একটা উদাহরণ হাতের সামনেই আছে- রবীন্দ্রনাথের, “তোতা কাহিনী”। এটাও রূপক ধর্মী ব্যঙ্গ। “উলট পুরাণ” গল্পটিতে পাই রূপকের মধ্যে পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ। এটিকে, রাজনৈতিক ব্যঙ্গ বা ইংরেজিতে বলা যায় পলিটিকাল স্যাটায়ার। “বিরিঞ্চি বাবা”-য় পাই গুরুগিরির ভণ্ডামির মুখো টান মেরে খুলে ফেলা, “কচি-সংসদ” গল্পে পাই তরুণ সমাজের উৎকট ভাববিলাসিতা  আর ন্যাকামির হাস্যকর স্বরূপ সম্মুখে আনা, “চিকিৎসা সঙ্কট”-এ মানুষের হাস্যোদ্দীপক আচরণ, “মহাবিদ্যা”-য় পাই চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যার মহিমা কীর্তন। এই সবেতে, আমরা একটা জিনিস দেখতে পাই, সেটা হল, আহাম্মুকি-অপদার্থতা-ভণ্ডামি- কাপুরুষতার শাশ্বত রূপ। কোন একটা সীমিত কালে আটকে নেই এই সব চরিত্র। সব চরিত্র যেন চেঁচিয়ে বলছে, “দুনিয়া বুরা মুই সাচা হয়ে কি করবো"। অসাধারণ মন্তব্য।
রাজশেখরের গল্পে আমরা দেখতে পাই, সুনিপুণ মনের উজ্জ্বল প্রকাশ। কবিতাতেও তিনি তাঁর সংযম সিদ্ধ রসিকতা বোধ- বিদ্যা আর wit দেখিয়েছেন।

তিনি লিখছেন-
মাননীয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোকগণ
এবং আর সবাই যাঁদের এপাড়ায় বাস,
মন দিয়ে শুনুন আমার অভিভাষণ,
আজ আমাদের আলোচ্য- Eat more grass
কবিতাটার উপসংহারে তিনি বলছেন
এদের দেখে শিখুন। যদি আপনারাও চান
এই অতি আরামের আদর্শ যাত্রা,
তবে আজ থেকেই উঠে পড়ে লেগে যান,
সব কমিয়ে দিয়ে বাড়ান ঘাসের মাত্রা।


এবারে দেখি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। রাজশেখরের পড়াশোনা- দ্বারভাঙ্গা স্কুল, পাটনা কলেজ, প্রেসিডেন্সী কলেজ। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে রসায়নে এম.এ (তখন এম.এস সি. ছিল না)-তে তিনি প্রথম হলেন। তারপর ওকালতি পাশ করলেও বেশিদিন ওকালতিতে মন লাগে নি। বাবা, চন্দ্রশেখর তখন তাঁর ছেলেকে তুলে দিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের হাতে (১৯০১)। সেই থেকে তিনি আমৃত্যু বেঙ্গল কেমিক্যালেই থেকে গেলেন। ১৯০৪ থেকে ১৯৩৩, এই ত্রিশ বছর ছিলেন ম্যানেজার আর বাকী ১৯৬০ পর্যন্ত (২৭ বছর) ডিরেক্টর।
নিজে রিসার্চ করে কসমেটিকসের কেমিক্যালস্ আবিষ্কার করা, লোক দিয়ে করান সেই সবের ব্র্যান্ড নেমিং- মোট কথা, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবই করতেন তিনি। বাড়ীতেও একটা ছোটোখাটো ল্যাবরেটরী করেছিলেন। অফিস থেকে ফিরে এসে, তিনি এখানেও  নানা রকম ছোট খাট পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতেন।
সারাটা জীবন এক সুশৃঙ্খল কর্মপদ্ধতির কঠিন বন্ধনে নিজেকে বেঁধে নিয়েছিলেন। সব হিসেব নিকেশ করেই চলতেন। নাহলে ভেবে দেখুন তো, রামায়ণ- মহাভারত চলন্তিকা অভিধান- সাহিত্য- অফিস, কিভাবে সব একসঙ্গে সামলানো যায়? ভাবাই যায় না! এই প্রসঙ্গে, একটা কথা না বললেই নয়। তাঁর লিখিত নির্দেশ ছিল, মৃত্যুর পর যেন বল হরি, হরি বোলবলে মৃতদেহ না নিয়ে যায়। কিন্তু, তাঁর প্ল্যানের সঙ্গে মহাকালের প্ল্যান মেলে নি। সে কথা পাঠক মাত্রই পরবর্তীতে বুঝতে পারবেন।
অপ্রয়োজনীয় কথা তো বলতেনই না, সময়ও খরচ করতেন না। একটা মজার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। একবার পেন্সিল কাটতে গিয়ে, আঙ্গুল কেটে যায়। আয়োডিন লাগিয়ে বেঁধে রাখলে প্রচুর লোকে প্রশ্ন করবে আর তার উত্তর দিতে হবে জেনে তিনি বড় করে একটা বিজ্ঞাপন লিখে টেবিলে রেখেছিলেন, “পেন্সিল কাটতে গিয়ে আঙ্গুলটা একটু কেটেছে। ভয়ের কারণ নেই
রাজশেখর বিয়ে করেছিলেন পটলডাঙ্গার দে পরিবারে। প্রসঙ্গত বলে রাখি কবি বিষ্ণু দে এই পরিবারেরই সন্তান। রাজশেখরের স্ত্রীর নাম ছিল মৃণালিনী। একমাত্র মেয়ে প্রতিমার বিয়ে দিয়েছিলেন, রাসায়নিক অমর পালিতের সঙ্গে। ক্যানসারে (মতান্তর আছে) অমর মারা যান ১৯৩৪ সালে। সেই শোক সামলাতে না পেরে, মেয়ে তার ঠিক এক ঘণ্টা পরেই মারা যান হার্ট ফেল করে। এদের একই সঙ্গে সৎকার করা হয়। প্রতিমা রেখে গিয়েছিলেন, দুটি শিশু সন্তান। ছেলেটা ছিল, জন্ম থেকেই বোধ শক্তিহীন। নাতনী আশাই, স্বামী-ছেলে নিয়ে ছিলেন, রাজশেখরের শেষ জীবনের সাথী। মৃণালিনী মারা যান ১৯৪২ সালে। রাজশেখরের বয়স তখন ৬২।
আগেই বলেছি, রাজশেখরের প্রথম বই গড্ডলিকাবের হয় তাঁর ৪২ বছর বয়েসে। মোট বই২১ টি। দুখানা তাঁর মারা যাবার পর প্রকাশিত। ১ টা অভিধান, ৯ টা গল্পের বই, ৫ টা অনুবাদ মূলক বই, ৩ টা প্রবন্ধ, ২ টা বিজ্ঞান আর  ১ টা কবিতার বই। গীতা”- বইটি তিনি আগে লিখলেও ছাপান নি। কারণ, ছোট ভাই গিরীন্দ্রশেখর মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে শ্রীমদ্ ভগবদ্ গীতার ওপর একটা বিরাট বই লিখেছিলেন। গিরীন্দ্রশেখর বলেছিলেন, দাদা রাজশেখরের গীতার পাণ্ডুলিপি সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন। রাজশেখর তাই পাণ্ডুলিপির ওপর বড় করে লিখে রেখে ছিলেন, “ছাপা হবে না
প্রতিমা মারা যায় রাজশেখরের ৫৪ বছর বয়সে। স্ত্রী তার ৮ বছর পর। তারপরও তিনি ১৮ বছর ধরে, সমস্ত শোক বুকে রেখে সাহিত্য চর্চা করেছেন, নাতি নাতনীকে বুকে করে আগলে বড় করেছেন। নাতনীর ভাল বিয়ে দিয়েছেন।
তিনি নিজেই নিজের চিকিৎসা করতেন। রক্তচাপ বাড়ায়, চারবার অজ্ঞানও হয়েছিলেন। শেষে ১৯৬০ সালের ২৭ শে এপ্রিল, দুপুর বেলা হৃদ্‌রোগে তিনি মারা যান।

(চলবে)

তথ্য ও ঋণ স্বীকার:
আলিপুর দুয়ার থেকে প্রকাশিত রাজশেখর বসু (পরশুরাম) স্মরণিকায়”, ১৯৮৩ তে প্রকাশিত প্রবন্ধ সকল।
১। সর্বশ্রী বিমলেন্দু বিষ্ণু, কমলেশ রাহা রায়, ডঃ জোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী, মিহির রঞ্জন লাহিড়ী, ডঃ হরিপদ চক্রবর্তী, ডঃ সুরঞ্জন দত্তরায়, অর্ণব সেন, পবিত্র ভূষণ সরকার।
২। সংসদ বাংলা চরিতাভিধান।
৩। ইন্টারনেট।
৪। পরশুরাম রচনাবলী।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই