Monday, July 30, 2012

সিমেট্রি ব্রেকিং, গঙ্গাসাগর এবং বেগুন -- রোদ্দুর

চাপ খাবেন নাকো ব্রাদার্স এবং সিস্টার্সসিমেট্রি-মিমেট্রি বোঝাচ্ছিনে... নিজেই বুঝিনা তো কি বোঝাব? ইন ফ্যাক্ট, সংক্রান্তির সাথে বেগুন মিলিয়ে
নতুন কিছু করবার ইচ্ছেও নেইকো... (আচ্ছা, বেগুনে সংক্রান্তি কেন হয় না? বেশ বেগুনের ভর্তা আর বেগুনপোড়া খেতুম মৌজ করে...)। বরং দুঃখের কথা বলছি, ভয়ঙ্কর দুঃখ।
স্যার বলেছেন, “এই পেপারটি সময় করে একবার দেখো... এই ২০০৯ সালেই বেরিয়েছে” (পড়ুন, “পেপারটা পড়ে, বুঝে, ক্যালকুলেশনগুলো রিপ্রোডিউস করে, তার থেকে ভাল কিছু করা যায় কিনা দেখ, এবং করা গেলে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার করে কষে, গুছিয়ে লিখে ফেল…যত তাড়াতাড়ি সম্ভব...” )। সময় করলুম, দেখলুম এবং হতাশ হলুম...ধুত্তেরি! এসব কি আমাদ্দারা হয় নাকি রে বাবা! কি সব হিজিবিজি গ্রাফ, তার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝলুম না। শেষের দিকে আবার খান-পঞ্চাশ রেফারেন্স... এখানে সেখানে, পাতার এপাশে-ওপাশে পেপার লেখকের সগর্ব ঘোষণা, “এই অঙ্কটি আমরা তমুকের লেখা অমুক পেপারটি দেখে দেখে কষলাম...”, এভাবে হয়? বলুন দেখি? প্রতি চতুর্থ লাইনে যদি একটা করে রেফারেন্সের নাম দেওয়া থাকে তাহলে পেপার লেখা কেন? ওই পেপারগুলোই যদি পড়ব, তাহলে আর তোমারটা পড়ব কেন হে বাপু? তাও রাগ-টাগ চেপে খান কতক ভালো (মানে সাইজে ছোট, পরিষ্কার করে লেখা) দেখতে রেফারেন্স খুঁজে বের কল্লুম... দেখলুম সবথেকে সহজবোধ্য পেপারটি ১৯৮৪ তে লেখা। সবটা বুঝলুম, মাত্তর শেষের একটা লাইন বাদ দিয়ে (“এই এক্সপ্রেশনটি ১৯৭১-এর ওই সেই পেপারটা থেকে নেওয়া, যেটা কিনা সেই যে সেই তিনি কষে বের করেছিলেন")। উত্সাহিত হলুম, এই লাইনটা যদি বুঝতে পারি তাহলেই কেল্লা ফতে! ঝট্‌পট্‌ বের করে ফেললাম পেপারখানা...করেই সেই জায়গাটা বের করে ফেল্লুম যেখানটায়... দেখেছ? “এই ইক্যুশনটা ওই ১৯৬১ এর সেই ভদ্রলোকের লেখা ওই পেপারটা থেকে নেওয়া" বলুন, কোনও মানে হয়? এটা কি ইয়ার্কি নয়? ভয়ানক রেগে গিয়ে ১৯৬১ সালে চলে গেলুম... শেষ চেষ্টা করে দেখতেই হবে... একটা আড়াই এম-বি বড় বিকট দেখতে পেপার নামল... যিনি এটা লিখেছিলেন না জানি তেনাকে কেমন দেখতে ছিল...উফ্‌! প্রথমেই চলে গেলুম শেষ পাতায়...যাক্‌ বাব্বা, এতে কোনও রেফারেন্স নেই... নির্ঘা এটা পড়েই সব কিছু জলব বোঝা যাবে। উত্তেজনায় নাকের ডগা সুড়সুড় করে উঠল... মন দিয়ে পড়তে শুরু করলুম পেপারটা। কিন্তু একি... কি ভাষা? শেষে কি জার্মান ভার্সন মার্কা কিছু নামিয়ে ফেল্লুম নাকি ভুল করে? আমার যে ইঞ্জিরি চাই... আবার সার্চ দিলুম, কিন্তু একি! সেই জিনিসটাই এল যে... তাহলে কি… তাহলে কি এইটা ইংলিশ? মনে হল জীবনের সব স্বপ্ন, সব আশা এক লহমায় ফুস্‌ হয়ে গেল! মনের দুঃখে খান বারো রাজা-মিল্ক বিস্কুট খেয়ে ঘুমুতে গেলুম... সব মায়া, সবই মায়া! সমস্ত!

সকালে উঠে চোখ কচ্‌লে দাঁতের যত্ন নিয়ে সবেমাত্তর গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঘড়িটার দিকে তাকিয়েছিদেখি সাড়ে ন'টা! ঘড়িটা এত ফাস্ট হয়ে গেল কি করে... ব্যাটারি ডাউন হলে শুনেছি ঘড়ি স্লো হয়... কিন্তু এমনটা তো দেখিনি! চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বাথরুমে ঢোকবার সময় টেব্‌ল ক্লকটায় দেখলুম ন'টা সাঁইত্রিশ... এবারে ঘোরতর সন্দেহ হল। নাহ্‌, দেখতেই হচ্ছে ব্যাপারটা। "মাআআ...কটা বাজে গো?” এতক্ষণে উঠলেন বাবু। আজ কি তোর ছুটি নাকি রে? সাড়ে ন'টা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিস... স্যার কি আজ আসবে না নাকি ইন্সটিট্যুটে?” আরেকটু হলেই গামছাটা হাত ফস্কে যাচ্ছিল, রিন্টিদের বাড়ির বারান্দা থেকে আবার আমাদের বাথরুমের দরজাটা দেখা যায়... কেলেঙ্কারি হচ্ছিল আর কি! রিন্টিটা আবার বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে আছে... কোনও মতে গামছা খামচে ধরে দৌড়লুম... জন পাম্পের থেকেও বেশি তাড়াতাড়ি জামাপ্যান্ট পড়লুম, মায়ের বাক্যিবাণ অগ্রাহ্য করে রেকর্ড সময়ে খাওয়া সারলুম, আর সেরেই সোজা ইস্টিশন।

ওই যে বলে না, বিপদ কখনও একা আসে না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পান্ডুয়া লোকালের ল্যাজটা দেখতে পেলুম এক মিলিসেকেন্ডের জন্যে...যাক্‌ গে যাক! পরেই বর্ধমানটা আছে... কিন্তু আজকেই কিনা সেটাও পাক্কা চল্লিশ মিনিট লেট। হাওড়া পৌঁছে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লুম... এই তো সবে বারোটা...বাসটা ধরব, আর এই সময়ে ফাঁকাও পাবো। মিনিট কুড়ির মধ্যে ইন্সটিট্যুট...ওমা! বাইরে বেড়িয়ে দেখি বাসস্ট্যান্ডে অসংখ্য লাইন... কিন্তু একি রকম অদ্ভুত লাইন? লোকগুলোকে যেন শিরীষের আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে । চিরুনির দাঁড়াগুলোর মধ্যে যতটুকু ফাঁক থাকে, তাও নেই যে। নাহ্‌, আজ চাদ্দিকে হচ্ছে কি! মাথা ঠাণ্ডা করে গুণে দেখলুম... মোট চারটে লাইন। কিসের লাইন রে বাবা? বাসের কি ধর্মঘট নাকি? কই, কালকের খবরে তো বলল না? সামনেই এক মুশকো চেহারার বীরাপ্পন মার্কা বিশাল গোঁফওয়ালা গম্ভীর ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে চাদ্দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন... ওনাকেই জিজ্ঞেস করলাম ভয়ে ভয়ে, “দাদা? কিসের লাইন?”

ভদ্রলোক পাত্তাই দিলেন না, ওনার ভুঁড়ির সাথে যে বাচ্চা ছেলেটি চিপকে দাঁড়িয়ে ছিল তার চুলে অন্যমনস্ক ভাবে বিলি কাটতে শুরু করলেন...আশ্চর্য পাবলিক তো? বাংলা বোঝে না নাকি? নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়ে চুলটুল ঠিকঠাক করে গলা খাঁকড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করলুম, “ও দাদা! লাইনটা কিসের?” এবারে গোঁফে কম্প দেখা গেল, মেঘগর্জনের মত গুম্ফবাণী শুনলুম, “লাইন আছে দেখছেন না? লাইনে দাঁড়ান! যান!" যাব্বাবা! একি রে? পাগল নাকি? রেগে মেগে আবার কড়া করে জিজ্ঞেস করতে যাব, ভদ্রলোক নিজেই বাঙ্ময় হলেন, “গঙ্গাসাগরে যাবেন, আর বাসের জন্যে এট্টু লাইন দিতে পারবেন না? আমি আপনার বয়স থেকে গঙ্গাসাগরে  যাচ্ছি, বুঝেছেন? যান, স্টেশনের পিছন দিকে চলে যান, লাইনের মুখ পেয়ে যাবেন।" টিং করে মাথায় একশ ওয়াটের বালব জ্বলে উঠল... এইবারে বুঝেছি! গঙ্গাসাগরের বাসের লাইন, বাপ্‌রে! কিন্তু তাতে আমার কি, আমি তো আর গঙ্গাসাগর যাচ্ছিনে! মধুর হেসে বল্লুম, “নানা, আপনি ভুল করছেন, আমি গঙ্গাসাগর যাব না। আমি চুয়াল্লিশ ধরব... তাই একটু ওই দিকটায় যেতে হবে... দাদা, প্লীজ একটু পাশ...” এই বলে এক পা এগিয়েছি কি এগোইনি, ভদ্রলোকের গোঁফ খাড়া হয়ে উঠল। 
সামনের ছেলেটিকে জাপটে ধরে বললেন, “ইয়ে না? মামাবাড়ি? জানো আমি দুণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি? ওসব কায়দাবাজি চলবে না, বুঝলে? আমি তোমার মত বয়স থেকে গঙ্গাসাগর যাচ্ছি, আমাকে কি ক্যাবলা পেয়েছ? এভাবে লাইনে ঢোকা যাবে না, যাও বলছি, পিছনে যাও...” হাঁ হয়ে গেলুম! ইকি রে বাবা... পাগল নাকি? বোঝাবার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে, “নানা, আপনি ভুল করছেন, আমি গঙ্গাসাগরেই যাচ্ছি না! আমি শুধু লাইনটা টপকে গিয়ে অন্য একটা বাস ধরব...”, ভদ্রলোক স্প্যানিশ বুলফাইটের বুলগুলোর মত মাথা নাড়লেন, “যাই বল বাপু, আমি তোমাকে ঢুকতে দেব না... এই, আপনারা কেউ একে ঢুকতে দেবেন না। বজ্জাত ছেলে, লাইন ব্রেক করবার চেষ্টা! যাও, যাও বলছি এখান থেকে...”। কি সর্বনাশ, তাহলে কি পুরো স্টেশন ঘুরে উল্টো দিক দিয়ে আসতে হবে? আরেকবার মরীয়া চেষ্টা করলাম, “মাইরি বলছি দাদা। সত্যি... আমি চুয়াল্লিশ...”, এইবারে ভদ্রলোক শার্টের হাতাটা গুটোতে শুরু করলেন, মরেছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলাম সব লোকজনেরই কেমন আপত্তিকর ভাবভঙ্গী। নাহ... আর এখানে না। যঃ পলায়তি...

গোটা বাস স্ট্যান্ডটাকে পিছন দিয়ে পাক মেরে একটা ভিড়ে ঠাসা চুয়াল্লিশ ধরে তো ইন্সটিট্যুট পৌঁছনো গেল। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে ইন্সটিট্যুটের দিকে তাকিয়ে দেখি সামনেই একদল মাথায় হলদে ফেট্টি বাঁধা লোক... থেকে থেকে চিত্কার, "বি-টি বেগুন চলবে না চলবে না...বি-টি বেগুন বিষে ভরা বিষে ভরা...”, এ আবার কি রে বাবা। গুটিগুটি কাছে গিয়ে দেখি গেটের সামনেই একদল বেগুন-বিপ্লবী, তাদের সামনে আমাদের ইন্সটিট্যুটের বিশাল কালো বন্ধ গেট, তার পিছনে কতিপয় লাঠিধারী বিবর্ণমুখ পুলিশকর্মী। এই রে, কি করে ঢুকি! চারদিকে খালি হলুদ মাথা, স্লোগান আর বি-টি বেগুনের মুণ্ডপাত। একটু এধার ওধার ঘুরে বেড়ালুম, বাইরে থেকে সিক্যুরিটির একজনকে ইশারা করলুম, তিনি করুণ মুখে ঘাড় নাড়লেন। শুনলুম আজ নাকি বেগুন উত্সব, কে এক মন্ত্রীমশাই এসেছেন সেই উত্সবে। তেনার কাছেই নাকি বেগুন-বিপ্লবীরা এসেছে অভিযোগ জানাতে। অনন্যোপায় হয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি, হঠা দেখি ব্যান্ডোদা... কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা, মুখে একটা নিঃস্পৃহ উদাস ভাব... গটগট করে পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে একজন সিক্যুরিটিকে ডেকে কানে কানে কি সব বললে, তার পরে আমার কনুই ধরে ভিড় থেকে টেনে এনে ফিসফিস করে বললে "ঢোকার ব্যবস্থা করেছি। চলে এস...", বলে ইন্সটিট্যুটের পিছন দিকে হাঁটা দিলে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে ব্যান্ডোদার পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করলাম... খানিকদূর গেছি, হঠা ব্যান্ডোদা হাঁটার স্পীড কমিয়ে আমার পাশে এসে বললে, “শশশ... মনে হচ্ছে আমাদের ফলো করা হচ্ছে... পিছনে দেখ।" ওমা সত্যি তো, চারটে মোটাসোটা লোক আমাদের পিছন পিছন আসছে যে... এদের মধ্যে ওই লম্বা লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন না? আমাদের পিছুপিছু ইন্সটিট্যুট ঢুকতে চায় নাকি? ব্যান্ডোদা স্মার্টলি বললে, “চলো, ব্যাটাদের বোর করা যাক...” বলেই পিজি হস্টেলের সামনের বেঞ্চিটায় বসে পড়লে। আমিও বসলুম... লোকগুলোও খানিক দূরে চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালে। প্রায় মিনিট পনেরো বসে থাকবার পরে দেখলুম লোকগুলো ব্যাজার মুখ করে চায়ের দাম মিটিয়ে চলে গেল। ব্যান্ডোদাও আমাকে টেনে নিয়ে একটা লোকের বাড়িতে সিঁড়ির তলাকার কলঘরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে একটা ছোট্ট টিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে  গলা তুলে ডাকলে, “ মানুদা...ও মানুদা।" সেই সিক্যুরিটির ভদ্রলোক ওপাশ থেকে দরজাটা খুলে দিয়ে  একগাল হাসলেন... দেখলুম ক্যান্টিনের পিছন দিয়ে ইন্সটিট্যুটের ভিতর এসে গেছি...

এত করেও কি কিছু হল? সামনের লনে চেয়ার টেবিল পেতে বসিয়ে মন্ত্রীমশাইকে কত ভাল ভাল জিনিস  খাওয়ানো হল... সব্বাইকার নেমন্তন্ন ছিল... কিন্তু আমার যে চারদিন হল পেট খারাপ! বলুন, দুঃখ হয় না?       

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই