Thursday, August 9, 2012

ফটিক ও বিরিঞ্চি বাবা-৪ -- ঘনাদা

<<আগের সংখ্যা

প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি রাজশেখরের, পারিবারিক ঐতিহ্য গত টান তো ছিলই সাথে রোমান্টিক সাহিত্যের প্রতি টান-ই তাঁকে কালিদাসের “মেঘদূত” কাব্যের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
আগেই বলেছি, তিনি কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিলেন। ফলে, যে কাজেই তিনি মন দিতেন, তা হাল্কা ভাবে করতেন না। তাঁর বৈজ্ঞানিক মন, সব খুঁটি- নাটি না জানা পর্যন্ত শান্তি পেত না।
ল্যাবরেটরিতে
একটা রাসায়নিক দ্রব্যকে পরীক্ষা করার জন্য, যে সতর্কতা আর পর্যবেক্ষণ দরকার হয়, ঠিক সেই ধরণের সতর্কতা তিনি সাহিত্য- সৃষ্টির জন্য প্রয়োগ করতেন।

রামায়ণ লেখার সময়, পণ্ডিত অমরেন্দ্র মোহন তর্কতীর্থ যে তাঁকে সাহায্য করতেন, সেটা তিনি ভূমিকাতেই লিখেছিলেন।
দ্বিতীয় সংস্করণে সাহায্যকারী হিসেবে,অধ্যাপক দুর্গামোহন ভট্টাচার্য কাব্য পুরাণ সাংখ্যতীর্থের নাম আছে।
এছাড়াও রাজশেখর, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদ এবং অন্যান্য লেখকদের অনুবাদও যত্ন সহকারে পড়েছিলেন আর, “যজ্ঞ” ব্যাপারটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝতে রামেন্দ্র সুন্দরের “যজ্ঞ কথা” এবং অন্যান্য বইও মন দিয়ে পড়ে অনুসরণ করেছিলেন।

ঠিক, এমনটি করেছিলেন মহাভারত রচনার সময়। দেশী- বিদেশী পণ্ডিতদের লেখা প্রায় সব বই পড়ে তার নির্যাস নিয়ে ছিলেন।
রাজশেখরের, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা আর শিল্প সরস সহৃদয়তার ফলে আমাদের লাভ হয়েছিল প্রচুর।
কারণ, তিনি এই দুটো মহাকাব্যের কোন গুলো বর্জনীয় আর কোনগুলো গ্রহণ যোগ্য, সাধারণ পাঠকের কাছে “বাল্মীকি- ব্যাসের রচনার” সমগ্র, সতর্ক, জাগ্রত এবং নির্ভুলভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নিজস্ব কথ্য ভাষারীতিতে মূল রামায়ণ মহাভারতের রচনাকালের ঘটনার পরিচয় দিতে গিয়ে, যে সব তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন- তা শুধু মানান সই নয়, অত্যন্ত সুশ্রাব্য এবং কাব্যগুণে ভরা।
রামায়ণ- মহাভারতের দুটো সুন্দর ভূমিকা লিখেছেন। কিন্তু, এই দুটোর রচনা– ছকে বেশ কিছু স্বাতন্ত্র্য আছে।
রামায়ণে তিনি বাল্মীকির কিছু কিছু শ্লোকদ্ধার করে দিয়েছেন। রাজশেখর লিখছেন-

বাল্মীকির রচনায় কাব্য রসের অভাব নেই। প্রাচীন সমাজচিত্র, নিসর্গ বর্ণনা এবং কৌতুকাবহ প্রসঙ্গও অনেক আছে যা, কৃত্তিবাসাদির গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এই গ্রন্থে, বাল্মীকির বৈশিষ্ট্য যথাসম্ভব বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এবং তাঁর রচনার সঙ্গে পাঠকের কিঞ্চিৎ সাক্ষাৎ পরিচয় হবে- এই আকাঙ্ক্ষায়, স্থানে স্থানে নমুনা স্বরূপ মূল শ্লোক স্বচ্ছন্দ অনুবাদ সহ দেওয়া হয়েছে। পাঠকের যদি রুচি না হয়, তবে পড়বার সময় উদ্ধৃত শ্লোকগুলি অগ্রাহ্য করতে পারেন।


মহাভারতের কোনো মূল শ্লোক, খুব জনপ্রিয় বা পরিচিত কিছু ছাড়া, তিনি বইয়ের মধ্যে দেন নি। কিন্তু, একটা বিস্তৃত পরিশিষ্টের মধ্যে স্থান, ব্যক্তি পরিচয়াদি দিয়েছেন- যা মহাভারতে নেই। এখানেও রাজশেখরের বৈজ্ঞানিক এবং রসিক চিত্তের একটা সুন্দর সমাবেশ পাই।
রামায়ণ এবং মহাভারতের একটা ছোট্ট তুলনা করলে দেখা যায় -

১। মহাভারতের সংস্কৃত, রামায়ণের থেকে বেশ কঠিনতর এবং কিছু জায়গায় দুর্বোধ্য।
২। মহাভারতে ব্যক্তি এবং স্থানের সংখ্যা রামায়ণের থেকে অনেক অনেক বেশি।

সাধারণ পাঠকের পক্ষে মনে রাখা বা বোঝা বেশ কঠিন। এইজন্য, রাজশেখরের সম্পাদনার ক্ষেত্রে অনেক যত্ন নিয়েছিলেন।
রাজশেখরের হাতের লেখার নমুনা
এই জিনিসটা তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রেও, ব্যবহারকারীদের কথা মাথায় রেখে করেছিলেন (To associate the product Brand Name with the consumers, so that they can easily identify)।
উদাহরণ দিলেই বোঝার সুবিধে হবে, সাথে রাজশেখরের রসিক মনের নমুনাও পাবেন।

টুথপেষ্ট
রদোকেন্ – রদ= দাঁত, কেন্ = কেনো।
সাবান = নদীর সংকেত দিয়ে, যেমন- ঈরা, যমুনা, শিপ্রা।

এইরকম দৃষ্টিতে তাকিয়েই তিনি আম পাঠককে রামায়ণ এবং মহাভারত, বোঝাতে চেয়েছিলেন।
মহাভারতের ভূমিকায় তিনি লিখছেন -

এতে মূল গ্রন্থের সমস্ত আখ্যান এবং প্রায় সমস্ত উপাখ্যান আছে। কেবল, সাধারণ পাঠকের যা মনোরঞ্জক নয়, সেই অংশ সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে। যেমন, বিস্তারিত বংশতালিকা, যুদ্ধ বিবরণের বাহুল্য, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ক প্রসঙ্গ, দেবতাদের স্তুতি ও পুনরুক্ত বিষয়। স্থল বিশেষে নিতান্ত নীরস বিষয় পরিত্যক্ত হয়েছে। এই সারানুবাদের উদ্দেশ্য- মূল রচনার ধারা ও বৈশিষ্ট্য যথা সম্ভব বজায় রেখে, সমগ্র মহাভারতকে উপন্যাসের ন্যায় সুখপাঠ্য করা।

এই উদ্দেশ্য যে পূরণ হয়েছে, সেটা যে পাঠক রাজশেখরের মহাভারত পড়েছেন/ পড়বেন, তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য।

বিজ্ঞান তপস্বীর বিস্তৃত জ্ঞানের যে গাণিতিক সংহতি ও শৃঙ্খলা – পরিমিত ও গূঢ়ার্থ ভাষণের যে নৈপুণ্য, তার মোটামুটি পরিচয় তাঁর রচনা সমগ্রের মধ্যে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ও ছড়ান থাকলেও, রামায়ণ- মহাভারতের দুটি ভূমিকা একুশ (৭ + ১৪= ২১) পাতার মধ্যে যেমন ভাবে লেখা হয়েছে, সেটা তুলনাহীন।
“চলন্তিকা” অভিধানের রচনা রীতিটির, প্রাধান্য ও পথিকৃতের গৌরবও রাজশেখরের প্রাপ্য। কারণ, শব্দসম্ভারের নতুন নতুন উদ্ভব যদি পরিশোধিত ও সম্পাদিত না হয় তবে তা পুরনো হয়েও যেতে পারে।
বাংলা পরিভাষা সংগ্রহ ও সৃষ্টির জন্য রাজশেখর সবসময় চেষ্টা করতেন। ১৯৪৮ সালে, তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গঠিত “বাংলা পরিভাষা সংগ্রহ ও পরিভাষা কমিটির” সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন রাজশেখর। সম্পাদক ছিলেন- চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, সহসম্পাদক- প্রমথনাথ বিশী, সদস্য- সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য ও চিন্তাহরণ চক্রবর্তী।
বাংলা ভাষার বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য বাংলা পরিভাষার বহুল প্রচারে আগ্রহী থাকলেও, তিনি জোর করে এই কাজকে গ্রহণীয় মনে করেন নি। এই ভাবে জোর করে বাংলা পরিভাষা ব্যবহারের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না।

তিনি লিখছেন-

যদি প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ আমরা গ্রহণ করি, তবে মাতৃ ভাষার পরিপুষ্টি হবে, বিকার হবে না। অপ্রয়োজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়োজনে হয় না। যদি বলি- ওয়াইফের টেম্পারটা বড়ই ফ্রেটফুল হয়েছে, তবে ভাষা জননী ব্যাকুল হবেন। যদি বলি, মোটোরের ম্যাগনেটটা বেশ ফিনকী দিচ্ছে , তবে আমাদের আহরণের শক্তি দেখে ভাষা জননী নিশ্চিন্ত হবেন।


চলন্তিকার পাতায় পাতায় তাই অজস্র ইংরেজি শব্দ স্থান পেয়েছে।

তাই বলছিলাম, চলন্তিকার পরে আরও নানা প্রামাণ্য অভিধান রচনা হলেও, রাজশেখর বসু এই সবের পথিকৃৎ।
পরিশেষে- ঋষি সুলভ নির্লিপ্ততায়, রাজশেখর মেনে নিয়েছিলেন, তাঁর জীবনের সব কিছু।
সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন- “তাঁর (রাজশেখর) মনোভঙ্গি গঠিত হয়েছে বস্তুতন্ত্র সুলভ বিজ্ঞান বুদ্ধির দ্বারা ।”
দুঃখ একটাই- এই আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি রাজশেখরের অমূল্য সম্পদকে বারবার অবহেলা করেছে। তাই তাঁর প্রতি অক্ষম ও অপটু হাতে, অকিঞ্চিৎকর শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে পেরে এই অধম কৃতার্থ বোধ করছে।

(সমাপ্ত)

তথ্য ও প্রভূত ঋণ স্বীকার:

আলিপুর দুয়ার থেকে প্রকাশিত "রাজশেখর বসু (পরশুরাম) স্মরণিকায়", ১৯৮৩ তে প্রকাশিত প্রবন্ধ সকল।

সর্বশ্রী বিমলেন্দু বিষ্ণু, কমলেশ রাহা রায়, ডঃ জোৎস্নেন্দু চক্রবর্তী, মিহির রঞ্জন লাহিড়ী, ডঃ হরিপদ চক্রবর্তী, ডঃ সুরঞ্জন দত্তরায়, অর্ণব সেন, পবিত্র ভূষণ সরকার।
সংসদ বাংলা চরিতাভিধান।
ইন্টারনেট।
পরশুরাম রচনাবলী।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই