Monday, September 24, 2012

ঘুরতে গিয়ে** -- সুনন্দ


বছর তিনেক আগের কথা...
আমরা যখন রেল-জংশন পিছনদিকে ফেলে রেখে, মস্ত মস্ত গাড়ি বোঝাই বন্য-সীমা লক্ষ্য করে পথ চলেছি - পেটের ভিতর নিউ আলিপুর দুয়ার থেকে খেয়ে আসা কচি পাঁঠার খয়েরি ঝোলের খলবলানি – ঠিক সে সময় সুয্যিমামা ক্লান্ত দেহে পশ্চিমে পিঠ হেলান দিয়ে লালচে হলেন; আমরা তখন বছর পঁচিশ বয়স নিয়ে তরতাজা আর উদ্ধত-প্রাণ জনা-দশেক যুবী-যুবা শহর-গন্ধী ছুটির মেজাজ সঙ্গে নিয়ে জংলি হলাম।


জয়ন্তী যে ঠিক একটা নদী, তা নয়- অভিজ্ঞতা। সামনে বিশাল পাহাড়শ্রেণী দিক থেকে দিক আড়াল করে কোল পেতেছে। সেই প্রসারে মাতাল হয়ে হিমালয়ের দুলালী আর রগচটা মেয়ে জয়ন্তী, তার খামখেয়ালী হৃদয়খানা সমতলের উদার বুকে উজাড় করে পোষ মেনেছে। ঝিরঝির আর কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে দেদার জলে মাখামাখি পাহাড়-মেয়ের অভিমান আর এই আমাদের অতি কষ্টে কাজের থেকে তিল তিল করে জমিয়ে তোলা ছোট্ট ছুটির সন্ধেটুকু।

তাই বলে কি আমরা সবাই খুব গম্ভীর? মোটেই তা নয়। দিব্যি সবাই হাত পা ধুয়ে দল বেঁধে আর হট্টগোলে বিকেলবেলা নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলাম। নদীর আগেই বটের ঝুরি আমার মতো বিরাট-দেহী খোক্কসকেও ওজন এবং বয়স ভুলে শিশুসুলভ দোলনা খেতে বাধ্য করে। ‘তুইও আবার ঝুলতে বাকি থাকিস কেন?’ বুলি দিয়ে অনিচ্ছুকের আপত্তিটাও উড়িয়ে দিলো সবাই কেমন ঘুড়ির মতো।

হাতে চটি, খালি পায়ে নদীর জলে নামতে গিয়ে সে এক ভীষণ কেলোর কীর্তি! হঠাৎ করে জল বেড়েছে কুলকুলে সেই শান্ত নদীর ফর্সা খাতে। মেয়েগুলোকে এপার থেকে ওপার নাহয় করা গেলো, কিন্তু আমার হাত-বন্দী হ্যান্ডিক্যাম আর বাকি সবার ছেড়ে রাখা জুতোগুলোর দায় এড়িয়ে যাই কি করে? হাঁটাহাঁটির অভ্যেস নেই, পায়ের নিচের নরম ত্বকে কড়কড়ে ওই নুড়িগুলো লাগছেও বেশ। তবু আবার দলের বিধান একলা জনের মতের উপর দীর্ঘ ছায়া ছড়িয়ে দিলো, বিরক্তিতে গরগর আর গজগজানি সঙ্গে নিয়ে খালি পায়ে ওই নদীতেই নামতে হলো। আমার যতই বিরক্তি থাক, বউয়ের মুখে(যদিও তখন আইন মেনে বউ হয়নি) কীর্তিমতীর ফর্সা আলো জ্বললো ভালো।

অনেকটা পথ নদীর পাড়ে উধাও হয়ে হাঁটার পরেও, প্রকৃতি তার শোভা কিছুই কম করেনি। তবুও বাড়তি অন্ধকার আর মশার ঝাঁকে, এক-দঙ্গল বঙ্গবাসী বীরপুঙ্গব অল্প হলেও, আতঙ্কিত। তাই ঠিক হলো, এবার না হয় হাঁটা চলুক ফিরতি পথে। ফেরার সময় যদিও সবাই ঝিমিয়ে ছিলো। ফিরলাম ওই নদীর পাড়েই, ঘরোয়া মতন টালির চালার গেস্ট হাউসে। দু’খানা ঘর ছেলেদের আর একটি পৃথক- বন্ধুনীদের রাত্রিবাসের জন্যে তোলা। সন্ধের পর সামনে কমন ব্যালকনিতে গোলটেবিলে তেলেভাজার উষ্ণ-নরম ধোঁয়ার সাথে গরম গরম ঘন দুধের চায়ের গ্লাসে হুল্লোড় আর প্রচুর গানের মিশেল হলো। গত রাতেই পাশের বনে খানদু’ত্তিন জংলী হাতি কেমন করে লোকালয়ে আসছিলো, সেই গল্প হলো। কাল সকালে আমরা যাবো সাফারিতে- গহীন কালো নিঝুম বনে না জানি ঠিক কেমনতরো অভিজ্ঞতার গল্প হবে? সেই চিন্তা মাথায় নিয়ে, মাছের ঝোল আর মোটা চালের ঝুরঝুরে ভাত গোগ্রাসে খেয়ে, বেজায় ক্লান্ত কাঠের মতো শরীরগুলো ফেলে রেখে এক নিমেষে সবাই মিলে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলাম।

এতক্ষণে সবেমাত্র প্রথমদিনের ঘুরতে যাওয়ার গল্প হলো। বেশ পুরনো এই গল্প। কিন্তু জানেন, এখনও ঠিক চোখ বুজলেই মুভির মতো চোখের সামনে ঘটতে থাকে। সামনে পুজো, কোথায় যেন ঘুরতে যাবো সবাই মিলে। জানিও না ঠিক। ভালই লাগছে, কিন্তু অল্প চিন্তা নিয়ে ভাবছি বসে...
নির্ভার সেই দিনগুলো কি এখন কোথাও - কোথাও গিয়েই ফিরে পাবো?

বললাম না, জয়ন্তী ঠিক নদী তো নয়-

ওই নামেরই অভয়-বনে দিন-রাত্তির নির্ভীক সব বন্য পশুর পদচারণ। পুজোর আগে, বর্ষা তখন তল্পি-তল্পা গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির পথে দেয়নি পাড়ি। বৃষ্টি-দিনে, সবুজ বনে, জলের অঢেল খোরাক মেলে। তাই পশুরা গহীন, আরও গহীন বনে ঘাপটি দিয়ে দু’পেয়েদের নাগাল থেকে দূরেই থাকে- অনেক দূরে। তাই এ সময় বনের জন্তু দেখতে পাওয়া সুপার লোটোর প্রথম প্রাইজ জেতার সামিল। শীতকালে তো জল পায় না, তাই বেচারা প্রাণীরা সব বন-কর্মীর খুঁড়ে রাখা পুকুর ধারে জটলা করে। সুযোগ বুঝে মানুষগুলো হয় ক্যামেরা, নয় বন্দুক ফন্দি আঁটে। আমরা বোকা, সময় করে বর্ষা দেখেই ঘুরতে গেছি। মন্দ কপাল, বিরাট পশুর টিকির দেখা মিলল না তাই। বেশ ক’খানা মস্ত মস্ত জোঁক দেখছি- সঙ্গে গাইড- একহাত এক কুকরি নিয়ে শহুরে জীব ঠাউর করে সত্যি মিথ্যে মিশেল দিয়ে বিরাট বিরাট গপ্পো ফাঁদে।

খান তিন চার বন মুরগি আর গোটা-দুই হরিণ দেখে আমরা যখন হাপিত্যেশে, ঠিক তখনই জিপ থামলো বনের মাঝে অদ্ভুত এক চৌরাস্তার মোড়ের মাথায়। এ পথ নাকি খাবার খোঁজা হাতির দলের পায়ের তলায় বছর বছর পিষতে পিষতে তৈয়ারি হয়। এক এক করে সব্বাইকে নামিয়ে দিয়ে, এদিক ওদিক ঘুরতে বলে, গাইড ব্যাটা নিজে কোথায় উধাও হলো, কেউ দেখেনি। চোখ যখনই থিতিয়ে এলো আবছায়াতে- সে আশ্চর্য দৃশ্য-মুখে শহুরেদের কলকাকলি থমকে থামে।

‘এ যে বন্য- এ অরণ্য’ –সত্যজিতের গুপীর মুখে ছেলেবেলায় শুনতে পাওয়া গানের কথা এদ্দিনে তার উপযুক্ত অর্থ আনে। বন শুধু নয় বাঘ-হাতিদের অভিনয়ের নাট্যশালা- এর নিজেরও গোপন কথা অনেক আছে বলার মতো, কানে কানে। কান পাতলেই সেই শব্দের সংগীতময় মূর্ছনা ঠিক শুনতে পাবে। যেমন করে শুনতে পেলাম আমরা সবাই- ওই কোরাসে নিজের গলা নিজের কানেই বেসুর লাগে।

ভাব-গম্ভীর সেই দৃশ্যের ঘোর কাটিয়ে আমরা আবার এগিয়ে গেলাম, পায়ে পায়ে, নদীর দিকে। অরণ্যকে দু’ভাগ করে সীমান্ত-হীন লাইন টেনে, যে দিক পানে ধায় দুই চোখ, দুলকি চালে সেখান দিয়েই জয়ন্তী যায়। ফের সকলে গুটি গুটি নেমে পড়লাম নদীর ‘বেডে’।
যে যার মতো ঘুরছি, থামছি, হাত-পা দিয়ে জোঁক ছাড়াচ্ছি, বালির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এক বেওয়ারিশ গাছের গুঁড়ির ছবি তুলছি - এমন সময়, কেউ একজন হাঁকড়ে ওঠে- ‘ওই বাইসন!’ দেখি, ওমা, সত্যিই তো! বেশ খানিকটা দূর দিয়ে এক নেহাত বুড়ো বাইসন তার পিছন পিছন অনেকগুলো বিরক্তিকর বককে নেহাত তুচ্ছ করে হাঁটছে একা। বুড়ো, সেটা বললো গাইড। হ্যাঁ, সে ব্যাটাও কখন যেন শূন্য থেকে আবির্ভূত। বাইসনেরা সমাজবদ্ধ, ঠিক আমাদের মতোই ওরা দল বেঁধে সব জীবন যাপন সাঙ্গ করে। এ দলছুট। বয়স্ক, তাই দলের সাথে তাল মিলিয়ে পা চালাতে পারেনি আর। একলা, বনের আড়াল ছেড়ে খোলা নদীর উপত্যকায় চরছে, যাতে শিকারিদের চলন-বলন দূর থেকে আর সজাগ হয়ে দেখতে পারে।

একলা বোধহয় মরবো সবাই। সঙ্গে কাঁদার মানুষ অনেক থাকতে পারে, কিন্তু এ পথ সরু ভীষণ- একজনই ঠিক এক এক বারে চলতে পারে। তবুও শেষের দিনেও যদি হাল না ছেড়ে, অহংকারী ঘাড় না নুয়ে বুক চিতিয়ে একলা হেঁটে চারপেয়ে ওই জীবের মতো মৃত্যুকে শেষবারের মতো মাপতে পারি, গর্ব হবে। দূর থেকে তাই সেলাম করে ফিরে এলাম বাইসনকে নিজের মতো থাকতে দিয়ে।
এসব সেরেও দিনের অনেক বাকি ছিলো। আমরা আবার অনেক ঘুরে, ভুটান, বক্সা, কোচবিহারের রাজবাড়িতে দিন কাটিয়ে সন্ধেবেলা জংলী পথে খানিকটা ভয়, অনেকখানি খুশি নিয়ে আবার ফিরে এসেছিলাম ওই ঠিকানায়।

কিন্তু সেদিন সকালবেলার বন্য স্মৃতি, কুয়াশা আর আবছায়াতে মাখামাখি- তেমন করে আর কখনো, কোন-খানেই পাইনি খুঁজে। সে কি আমার বয়স খানিক কম ছিলো তাই? নাকি মনের কৌমার্য অটুট ছিলো? এর পরেও তো কম ঘুরিনি! রেলগাড়িতে, প্লেনের পেটে পূব-পশ্চিম অনেক চরকি-পাক কেটেছি। অবশ একটা ভালোলাগা কম্বল হয়ে মনকে এমন জড়ায়নি আর।
তাই তো এমন রাত-কাবারি সময় এলে উতল মনে কি-বোর্ড হাতে ভাবতে বসি...

নির্ভার সেই দিনগুলো কি এখন কোথাও - কোথাও গিয়েই ফিরে পাবো?



**আইডিয়ার কপিরাইট আংশিক ফরিদার 'রং না দিলেও' লেখাটার। ওটা যদিও অন্য গোত্রের- অসাধারণ একটা লেখা। ওটা অবশ্যই পড়ে দেখবেন।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই