Monday, November 26, 2012

মৃত্যু সুখের উল্লাসে -- নির্মাল্য


বাপরে কি ডানপিটে ছেলে-কোনদিন ফাঁসি যাবে, নয় যাবে জেলে। শিশুপাঠ্য ছড়া যতক্ষণ, ততক্ষণ চলতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি হলেও কি একইরকম হাস্যকর? অস্বস্তির সূচনা কাসভের ফাঁসি নয় মোটেই। সেটার প্রতিক্রিয়ার ধরণ। অপরাধীকে আড়াল করতে কলম ধরা এই বান্দার কাজ নয়। কিন্তু শাস্তি উপলক্ষে সমারোহের আবহ তৈরি হলে চিন্তার বিষয় বৈকি।
মৃত্যুদণ্ড মানবতা বিরোধী কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। ফিডিং বোতলে করে যে রাষ্ট্র অন্যান্য অবাধ্য রাষ্ট্রকে মানবতা খাইয়ে থাকে, সেই আমেরিকা কিন্তু বহু বিতর্কের পরও মৃত্যুদণ্ড রোধ করেনি। দ্য “গ্রেট” ব্রিটেন সুদীর্ঘকাল ধরে উপনিবেশগুলিতে এই শাস্তি প্রয়োগ করার পর সাম্প্রতিককালে মৃত্যুদণ্ড রদ করেছে। বাকী রইল আরব ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। ওসব জায়গায় খুব কম অপরাধের জন্যই মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তুলনায় ভারত মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা রাখলেও এর প্রয়োগের ব্যাপারে অনেক বেশি সহনশীল এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতই দায়িত্বশীলও বটে। খুব সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় আন্তর্জাতিক ভাবে মৃত্যুদণ্ড রদ করে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।

২৬ শে নভেম্বর ২০০৮ এর মুম্বাই সন্ত্রাসের জঙ্গি ক্ষোভকে বহুদিন দীর্ঘ একটি বিচার প্রক্রিয়ার পর ফাঁসি দেওয়া হল। সে প্রসঙ্গে আসার আগে অনুরূপ আরেকটি ফাঁসির ঘটনা মনে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে হেতাল পারেখের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধনঞ্জয়ের ফাঁসি। আইন তার নিজের পথে চলেছে। জনতা নিজের। যেমন “ধনঞ্জয়ের ফাঁসি চাই” এই ব্যানার নিয়ে মিছিল হয়েছে রাজপথে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী
জায়া পথসভায় চোখের জল ফেলেছেন ফাঁসিতে বিলম্বের প্রতিবাদে। ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের দোরে সাক্ষাৎকার প্রার্থী মিডিয়া ঘাম ঝরিয়েছে। নাটা মল্লিকের পারিবারিক খাবারদাবারের মেনুটা পড়তে পড়তে চায়ে চুমুক দিয়েছে বাঙালি। শেষমেষ স্বাধীনতার সকালে বাঙলা দৈনিকের প্রথম পাতায় নিথর দুটি পায়ের ছবি দেখে নিশ্চিন্ত হয়েছে জনতা। যাক্‌ বাবা, দ্যাশ থেকে তালে রেপ-টেপ মিটে গেল। কলকাতার বিখ্যাত ইঞ্জিরি মাধ্যম স্কুলের মামণিরা হাত তুলে হাসিমুখে V দিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসেছে। কাসভের ক্ষেত্রেও ঘটনা অন্যরকম নয়। এর আগে বিগত চারবছর ধরে ফেসবুক, এস এম এস, Fun-mail জুড়ে বেঁচে ছিল ব্যাপারটা। এসবেই বেঁচে ছিল কাসভ। জেলের চাইতেও অনেক প্রাণোচ্ছল ভাবে-“তোমায় হৃদমাঝারে রাখিব, ছেড়ে দেব না”। শাস্তিতে বিলম্ব দেখে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে গর্জে উঠেছে পাবলিক। কেন্দ্রীয় সরকারের নেপথ্যবাসিনী ম্যাডাম কাসভকে ভাইফোঁটা দিচ্ছেন-এমন ব্যঙ্গচিত্রও বিরল ছিল না। শাস্তির পরের ঘটনাও বেশ মজাদার। সেদিনের ঘটনার প্রাণে বেঁচে যাওয়া শিকার, তাদের আত্মীয়রা তো বটেই, ছা-পোষা, বসের গাল খাওয়া কেরানি থেকে শুরু করে চাকরী যায় যায় সফোজীবি, চাকরী নাই-নাই পল্টুদা সকলেই ‘আনন্দ’ করেছেন। অনেকেই আগ বাড়িয়ে বলেছেন, ইস প্রি-ম্যাচিওর ফাঁসি! পাঁজি দেখে আর পাঁচদিন পর হলেই তো হত। প্যাণ্ডেল বাঁধিয়ে সাড়ম্বর বর্ষপূর্তিটা হয়ে যেত। বলিউডের বিখ্যাত পরিচালক (ঘটনাচক্রে, অন্ধকার দুনিয়াই যার ছবির পছন্দের বিষয়) তো আবার এই ‘হঠাৎ’ ফাঁসিকে আদর ছাড়াই *** এর সাথে তুলনা করলেন। সাধু, সাধু। অর্থাৎ ফাঁসির ঘটনাটা তিনি শারীরিক আদর ও “আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি”র মতোই উপভোগ করতে চান।

আচ্ছা, ভদ্রলোকের এরকম বিকৃত রাগের কারণ কি? তিনি নিজে কি স্বজনহারা?-ডেঁপো ছোকরা, তোমার মতন স্বার্থপর নই আমি। আমার তো ভাই বসুধৈব কুটুম্বকম। বসুধা না হোক, তবে কি সমস্ত মুমইবাসীর বেদনা-ক্ষোভকেই তিনি প্রকাশ করলেন? মোটেই না। সেই ঘটনার অব্যবহিত পরেই মহারাষ্ট্রের তৎকালীন উপ-মুখ্যমন্ত্রীর সাথে ঐ পরিচালক তাজ হোটেল পরিদর্শনে যান। জঙ্গিহানার ক্ষত তখনও টাটকা। রক্তের দাগ পার হয়ে পুরো ঘটনার UNTOUCHED সংস্করণ দেখে আসেন তিনি। কেন? ‘কারণ’টা আর যাই হোক মুম্বাই প্রীতি নয়। আর ফলাফল?- কয়েক মাসের মধ্যেই মুক্তি পেতে চলেছে ওনার কাসভকে নিয়ে তৈরি ছবিটি। গোপন ফাঁসির ঘটনায় অতএব তাঁর গোসা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। হয়ত ব্যাপারটা ঠিকঠাক (মানে, তারই দেওয়া উদাহরণের মত উপভোগ করতে পারলে) দেখতে পেলে সিনেমার ক্লাইম্যাক্সটা আরও একটু বাস্তবোচিত করে ফেলতেন, চাই কি অস্কারের স্বপ্নও দেখতে পারতেন শেষরাতে। এই হতচ্ছাড়া সরকারটা!

অপরদিকে অপরাধীকে শাস্তি দিতে সরকারেরই বা এই গড়িমসির কারণ কি? সত্যিই কি কাসভকে কেউ আড়াল করতে চাইছিলেন? সম্ভবতঃ কূটনৈতিক বিড়ম্বনাতেই এই বিলম্ব। ভারতের মত গণতান্ত্রিক দেশে বিরল থেকে বিরলতম অপরাধ না হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া মোটেই শোভন নয়। তা না হলে ঢিল ছুঁড়ে হত্যা বা প্রকাশ্যে গলা কেটে শাস্তিবিধান করে যে সব অর্ধশিক্ষিত দেশ, তাদের সাথে কোন পার্থক্যই থাকে না। সে জন্যই প্রথমে নিম্ন আদালত, সেখান থেকে উচ্চ আদালত হয়ে হাইকোর্ট, তারপর সুপ্রিম কোর্ট- এই দীর্ঘ পথ ঘুরে আসা। শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা এবং তা নাকচ হওয়ার পর ফাঁসি। প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়মানুগ এবং বাস্তবোচিত। সরকারের অনেক বৃথা ও নির্বোধ সিদ্ধান্তের বিপরীতে একটি সঠিক পদক্ষেপ।

যা হোক, আমি, বা আমরা অমুকের ফাঁসি চাই- এই দাবিটি জল চাই, রাস্তা চাই, বেতন চাই এর মত নয়। ফাঁসি কি আদৌ চাওয়া যায়? আচ্ছা দেশদ্রোহী পাবলিক তো আপনি মশাই! আপনারই দেশের এতগুলো মানুষকে মারল, আপনারই পাশের ঘরের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করল, আর আপনি তার ফাঁসি চাইবেন না? হক কথা। তাহলে আজ বাদ কাল এই ফাঁসির দাবী যে আরও কোন তুচ্ছ কারণে উঠে আসবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? তার চেয়ে আইন চলুক না কেন নিজের রাস্তায়। যে স্কুলের মেয়েরা ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পরে বিজয়োৎসব করেছিল, তারাও কি একইরকম ভাবে হত্যার সমর্থক নয়? আমি আবারও বলছি ধনঞ্জয় বা কাসভের ফাঁসি আইনের চোখে হয়ত ঠিকই ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রবাসীর নির্লজ্জ celebration একটা সভ্য দেশের উদাহরণ নয়। মনে আছে আমেরিকায় জঙ্গি হানার পর ধর্মীয় জঙ্গি অধ্যুষিত প্যালেস্টাইনের অধিবাসীদের আলোর উৎসব! তাহলে ঐ ধর্মান্ধ মানুষগুলোর সাথে একই পঙক্তিতে বসতে আপনি তৈরি তো?

ধনঞ্জয়ের ফাঁসির পর বহুবছর কেটে গেছে। আজও বিভিন্ন দৈনিকে নিয়মিত বেরোয় ধর্ষণ ও খুনের খবর। কাসভের ফাঁসি প্রায় নিশ্চিত হওয়ার পরেও দেশে ঘটে গেছে একাধিক উগ্রপন্থী হামলা। অর্থাৎ লাভের ঘরে শূন্য। তবু রাষ্ট্রের হাতে এই ক্ষমতা আছে। তাহকবে। থাকাটা হয়ত উচিতও। শুধু এই post ফাঁসি উৎসব যেন না থাকে। কারণ, কাসভের ধারণা ছিল এই কটা মানুষকে খুন করে আসতে পারলে হয়ত তার জন্য অক্ষয় জন্নতবাস অপেক্ষা করছে, এতেই তার আনন্দ, সেই আনন্দের বিহিঃপ্রকাশও সে করেছে নানাভাবে। একইভাবে, নিজের হাতে না হোক, নিজেদের প্রণীত আইনের বলে অপরাধীকে মেরে ফেলতে পারলেই আমাদের আনন্দ, সেই আনন্দের প্রকাশও খুবই প্রকট।

এই উৎকট আনন্দের বেতন পেয়েছে কাসভ-ধনঞ্জয়েরা, তাহলে কি আমাদেরও ....

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই