Wednesday, January 2, 2013

ছোট্ট দেশ-লাক্সেমবার্গ -- অভীক

(ছবিগুলো বড় করে দেখতে চাইলে ছবির ওপরে ক্লিক করুন।)


অভিজিৎ বললো “আরিব্বাস, ওই দেখো একটা পাথরের ব্রিজ, ওই দিকে চলো।” লাফাতে লাফাতে দু’জনে চললাম সেই দিকে, ব্রিজের সামনে গিয়ে পুরো হাঁ হয়ে গেলাম।
আকারে কলকাতার থেকে একটু বড়, কিন্তু এটাই হলো গোটা একটা দেশ, লাক্সেমবার্গ। বেনেলাক্স বলতে যে তিনটি দেশ বোঝায় তার (BENELUX) শেষের অক্ষরগুলোই লাক্সেমবার্গ – বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড আর লাক্সেমবার্গ। বেলজিয়াম, জার্মানি আর ফ্রান্স দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা দেশ, কিন্তু এরই পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ GDP (PPP) per capita, মানে এক কথায় বেশ ধনী দেশ।
আমি আর অভিজিৎ, লাক্সেমবার্গ ষ্টেশনে নেমে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি, এমনিতে ছোটখাটো একটা শহর, গাছপালার ফাঁক দিয়ে দূরে একটা ব্রিজ দেখে সেই দিকে যাচ্ছিলাম, সামনে পৌঁছে সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো আধুনিক সভ্যতা থেকে বেশ কয়েকশো বছর পিছিয়ে এসেছি। আর্চওয়ালা বড় বড় সব পাথরের ব্রিজ যোগ করছে প্রাচীন শহরের সঙ্গে আধুনিক শহর, কিছুটা পরপর একটা করে, নীচে সবুজ উপত্যকা।
এই রকম অদ্ভুত সুন্দর সব ব্রিজ, ওপর দিয়ে ট্রেন যায় ধোঁয়া উড়িয়ে... কোন সিনেমাতে দেখেছিলাম ঠিক এই রকম কিছু একটা! ছোট্ট একটা দেশের মধ্যে ছোট্ট একটা শহর। শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত দেখা যায়। মজার ব্যাপার হলো  পায়ে হেঁটেই শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে চলে যাওয়া যায়। পুরো শহরটাই খুব উঁচু নীচু, এই ঢাল বেয়ে নীচে নেমে এলাম, তো আবার এই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠে পড়লাম। এই একটু আগে যেখানে ছিলাম, সেই জায়গাটাই আবার একটু দূরে অনেক উঁচু থেকে দেখতে পেলাম কয়েক মুহূর্ত পরেই।

আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন বেশ গরমই ছিল। টেম্পারেচার ছিল ১০-১৫ ডিগ্রী মতো। হঠাৎ দেখি খুব শীত করতে শুরু করলো, আকাশ মেঘ করে এলো, আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঝুরঝুর করে বরফ পড়তে শুরু করলো। এতই আকস্মিক ছিল ব্যাপারটা যে প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না  ওগুলো বরফ। জ্যাকেটের ওপরে পড়া বরফগুলো যখন গলে জল হতে শুরু করলো, তখন সত্যি বিশ্বাস হলো যে ওগুলো বরফ। ওয়েদার ফোরকাস্টে গরম দেখে অভিজিৎ জ্যাকেট নিয়ে আসেনি, ঠাণ্ডায় ও রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো। ঘণ্টা খানেক পরে রোদ্দুর উঠে আবার আগের মত ওয়েদার হয়ে গেল, মজার দেশে এ এক মজার ওয়েদার।
একটা চার্চের ঘণ্টার আওয়াজ পাচ্ছিলাম অনেকক্ষণ ধরেই, আওয়াজ শুনে শুনে সেই দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সামনে এসে দেখলাম বেশ পুরনো একটা চার্চ, বেশ বড়ই, ইউরোপের টিপিকাল গথিক ডিসাইনের।
 যখন ঢুকলাম, তখন প্রার্থনা সঙ্গীত হচ্ছিল, মাথায় গোল গোল সাদা টুপি পরে গান গাইছিল তিন জন ধর্মযাজক, সঙ্গে চার্চ-বেল বাজছিল – হ্যালেলুইয়া, হ্যালেলুইয়া... শুনতে বেশ লাগছিল। চার্চের একদিকে কয়েকটা ছবি নিয়ে এক্সিবিশন হচ্ছিল, একটা ছবি বেশ অবাক করলো, যিশুর একটা ছবি, মাথায় কাঁটা আর নাকে লাল বল লাগানো, জোকার যিশু। চার্চের মধ্যে এই রকম একটা ছবি সত্যি অদ্ভুত। কালীঘাটের কালীর নাকে লাল বল লাগিয়ে জোকার সাজিয়ে সেই ছবির প্রদর্শনী কালীঘাটের মন্দিরের মধ্যেই হচ্ছে, এতদূর ভাবাটাই অনেক...

 চার্চ থেকে বেরিয়ে একটা সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা প্রাসাদের সামনে এসে পড়লাম, তার সামনে একজন প্রহরী লম্বা একটা বন্দুক নিয়ে প্যারেড করছে, রাজকীয় কায়দায়, কোনোদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই, যেন সেই প্রাসাদটা ছাড়া চারপাশে কিছুরই কোনও অস্তিত্ব নেই।
পাশেই ছিল ইনফরমেশন সেন্টার, সেখান থেকে লাক্সেমবার্গের একটা ম্যাপ জোগাড় করলাম। অনেক হাঁটাহাঁটি করে খুব খিদে পেয়ে গেছিল, স্থানীয় কোনও খাবার খাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ভিড় দেখে সেই চিরাচরিত বার্গারের দোকানে ঢুকেই পেট-পূরণ করতে হলো, ইতোমধ্যে বাইরে আবার কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিতে শুরু করেছে, ভেতরে জায়গা না পেয়ে বাইরে বসতে হয়েছিল... ঠাণ্ডা হাওয়ায় গরম বার্গার বড্ড তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

একটা পাথরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, আগে বোধহয় বলিনি যে, শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই পাথরের, দেখেই বোঝা যায়, অনেক দিন আগে তৈরি। লাক্সেমবার্গের রাজার একটা সিম্বল আছে, সেটা রাস্তার দু’দিকে বেশ কিছু জায়গায় চোখে পড়লো।
 ঢালু রাস্তা বেয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে এলাম, মাঝে আর একটা ছোট চার্চ পেরিয়ে এলাম। এর পরেই একটা দারুণ জায়গায় চলে এলাম - কেসমেট। 




পুরনো কেল্লার চারপাশে যুদ্ধের জন্য তৈরি আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল – লম্বায় তেইশ কিলোমিটার। ১৭০০ শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরি, বানাতে শুরু করেছিল স্প্যানিশরা, কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যায় ফরাসিরা, আর শেষ করে অস্ট্রিয়ানরা।  প্রায় পঞ্চাশটা কামান রাখার জায়গা ছিল। এখনো দেখলাম অনেক কামান রাখা আছে সুড়ঙ্গের ফাঁক দিয়ে বের করা, নল উঁচিয়ে আছে বাইরের শত্রুকে শেষ করে দেবে বলে। কয়েকটা কামানের গোলাও রাখা আছে আশেপাশে।
জায়গাটা অনেকটা গোলোক ধাঁধার মতো, আমরা অনেক বার বাইরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ঘুরে ফিরে বার তিনেক একই জায়গায় চলে এলাম, অনেকটা নীচে নেমে যাওয়া যায় সরু ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে... প্রায় চল্লিশ মিটার। নীচে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা... অনেক দূর গিয়ে একটা প্রান্তে পৌঁছে দেখলাম সেখানেই শেষ, আর কোনও যাওয়ার জায়গা নেই। একটা খুপরি দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলাম, দেখি সেখানে কে একটা তালা লাগিয়ে রেখেছে। আসলে পুরো কেসমেটটা সব লোকজনের যাওয়ার জন্য খুলে রাখেনি। অগত্যা আবার অন্যদিকের একটা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম। সিঁড়িগুলো এত  সরু যে কেউ ওপর থেকে নীচে নামলে আর উঠতে পারবে না, উঠতে গেলে দেওয়াল ধরে ধরে উঠতে হয় এতই সরু, পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ভালোই। ভাবলে শিহরণ জাগে যে এগুলো দিয়েই একসময় হাজার হাজার সৈন্যসামন্ত যুদ্ধের সাজে যাওয়া আসা করতো।
 সুড়ঙ্গের মাঝে মাঝে কয়েকটা বড় বড় পাথরের ঘরের মত আছে, সঙ্গে ব্যালকনি। সেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম কখন-ও আমরা মাটি থেকে অনেক ওপরে, কখন-ও একদম নীচে... দেখা যাচ্ছে ওই ওপরে, একটু আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

 কেসমেট দিয়ে নীচে একটা যাওয়ার রাস্তা ছিল কোথাও একটা, অনেক লোকজন দেখলাম নীচে, কিন্তু সেই রাস্তাটা আর আমরা খুঁজে পেলাম না... যে রাস্তা দিয়ে নেমেছিলাম, সেই দিক দিয়েই ওপরে উঠে কেসমেট থেকে বেরিয়ে এলাম, কিন্তু তখন-ও মন পড়ে রয়েছে ৩০০ বছর আগের সময়ে।
একটা ঢালু রাস্তা দিয়ে নীচের দিকে চললাম, সেই নীচু জায়গাটার উদ্দেশ্যে যেটা ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু যেতে পারছিলাম না।  মন বলছিল এই দিকে গেলেই পাবো। ডানদিকে একটা সরু গলি নেমে যাচ্ছে মনে হলো, তাই সেই পথে পা বাড়ালাম। গলির মুখে একটা বাড়ির লোহার রেলিং এর সামনে একটা ছোট কুকুর আমাদের দেখে খুব চেঁচামেচি জুড়ল, আমিও ওকে ভেঙ্গিয়ে কুকুরের মতো একটা ডাক ছাড়লাম, আছে তো রেলিং এর মধ্যে কি আর করবে... কিন্তু হঠাৎ দেখি কুকুরটা রেলিং এর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, অর্ধেক বেরিয়ে পড়েছে... আমাদের ওপর খেপে গিয়ে কামড়ানোর জন্য, আমরা তো তখন পড়িমরি করে ঢালু রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম, ঢালু বলে এমনিতেই জোরে জোরে দৌড়চ্ছি, পিছনে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক... অনেক দূর দৌড়ে আসার পর ডাকটা হালকা হয়ে এলো... আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড় থামালাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আমরা দাঁড়িয়ে আছি বিশাল বড় সবুজ একটা মাঠে, সামনে বিশাল বড় একটা পাথরের ব্রিজ, সরু একটা নদী সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এটাই সেই ওপর থেকে দেখা জায়গাটা।



মাঠে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম, এতক্ষণ যা দৌড়েছি দু’জনে... পাশেই একটা ফুলের বাগান, টিউলিপের সিজ্‌ন বলে অনেক রঙের টিউলিপ ফুটে রয়েছে, জায়গাটায় বসে থাকতে বেশ লাগছিল... কিছুক্ষণ পরে ম্যাপটা বের করে আরও অনেক কিছু দেখার উদ্দেশ্যে উঠে পড়লাম। পাশেই একটা সিঁড়ি ছিল সেইটা দিয়ে ওপরে ওঠা শুরু করলাম... সে অনেক সিঁড়ি, উঠছি তো উঠছি, জেদ চেপে গেছে, সবটা একবারেই উঠবো... কেল্লার মাথায় ওপরে পৌঁছলাম। আবার তখন রোদ ঝলমল করছে, ঘেমে গেছি এতো পরিশ্রমে। কেল্লার ওপর থেকে সব ব্রিজ গুলো একে একে দেখা যাচ্ছে... সামনেই একটা পাথরের ব্রিজের ওপর দিয়ে একটা ট্রেন চলে গেল... ইলেকট্রিক ট্রেন, মনে হলো ইস্‌ যদি ধোঁয়া উড়িয়ে কোন-ও একটা ট্রেন যেত।

কেল্লা থেকে নেমে আসার রাস্তাগুলো অদ্ভুত... কোন দিক দিয়ে কিভাবে যে নেমে এলাম বুঝতেই পারলাম না... এদিক ওদিক করে হঠাৎ দেখি কেসমেটের কাছে চলে এসেছি... আর হেঁটে ওপরে ওঠার ক্ষমতা ছিল না... ম্যাপ দেখে বের করলাম যে সামনেই একটা লিফ্‌ট আছে। সেটার সামনে এসে দেখি অনেক লোকজনের ভিড় সেখানে... লিফ্‌ট এ দু’টোই মাত্র ফ্লোর...  গ্রাউন্ড ফ্লোর আর ফিফ্থ ফ্লোর। লিফ্‌ট-এ করে আমরা সোজা ছ’তলায় উঠে এলাম... যেখানে আমরা প্রথম এসেছিলাম... প্রথম ব্রিজটা পেরিয়ে...



 অল্প খিদে পাচ্ছিল, তাই আইস ক্রিম কিনে ফেললাম দু’জনে দুটো। একটু এগোলেই সামনে একটা ভিউ পয়েন্ট, অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে। কিছুটা অন্তর একটা করে পাথরের ব্রিজ,  কোনটায় একটাই বিশাল আর্চ কোনটায় অনেকগুলো আর্চ পরপর রয়েছে... পাশ দিয়ে দেখলাম সিঁড়ি নেমে গেছে অনেক নীচে... নীচে সবুজ ঘাস ঢাকা মাঠ, সরু পাথরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে, সরু একটা জলের রেখাও দেখা যাচ্ছে। পাথরের গায়ে কিছু বাড়ি আর একটা ছোট্ট টয় ট্রেন... তাই আবার নীচে নামার লোভ সামলাতে পারলাম না... সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে আবার নেমে এলাম... নীচে প্রচুর গাছপালা, একটা গাছ দেখলাম পুরো লাল রঙের পাতায় ঢেকে গেছে... সামনে সেই একটা আর্চ -ওয়ালা বিশাল বড় একটা পাথরের ব্রিজ, ওপর থেকে যে বাড়িগুলো দেখলাম সেগুলো আসলে পাহাড়ের গায়ে পাথর খোঁদাই করে তৈরি করা ছোট ছোট ঘর, তার মধ্যে একটা চার্চ। তাতে যিশুর মূর্তিও দেখলাম। সামনেই একটা বেঞ্চ-এ বসে আমরা আইস ক্রিম টা শেষ করলাম...



তখন বিকেল হয়ে গেছে... সূর্য অস্ত যেতে তখনও অবশ্য অনেক দেরি... এই সময়টা ইউরোপে সূর্য ডুবতে ডুবতে রাত ১০ টাবেজে যায়... তবু এতো উঁচু নীচু রাস্তা, বড় বড় ব্রিজ, কেল্লা, এতো গাছপালা... তাই চারদিকটা ছায়া ছায়া হয়ে এলো... আমরাও তখন প্রায় পুরো শহরটাই দেখে ফেলেছি... চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রায় দু’জনেই ক্লান্ত... নিজেদের টেনে টেনে ওপরে উঠিয়ে আনলাম... একটু পাথরের ব্রিজে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো দেখলাম শহরটাকে... দূরে দেখা যাচ্ছে কেল্লা সেই পাথরের পরপর ব্রিজ, কেসমেটের একটা অংশ। তার ওপর Luxemburg এর পতাকা উড়ছে পতপত করে... সেই চার্চটা থেকে আবার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আমরা বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়ালাম... 

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই