Tuesday, January 22, 2013

ফুটপাথের গন্ধভার ও পুরনো বইয়ের কিস্যা -- সুশোভন


যে রাস্তাটা মির্জাপুর থেকে সোজা চলে গেছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গা ঘেঁষে, ফুটপাথ জুড়ে সারি সারি বিন্যস্ত প্রচ্ছদ ও পুরনো গন্ধভারে আক্রান্ত।
কলকাতার ফুটপাথে স্বনামধন্য বা উদীয়মান লেখকদের আজও কোনোদিন হাত পেতে বসতে হয়নি যেমনটা বিদেশের ফুটপাথে গায়ক, লেখক থেকে অভিনেতাদের হয়। তবে এই শহরে লেখকদের বই বহুদিন আগে থেকেই ফুটপাথে এসে গলাগলি করে দাঁড়িয়েছে।
সেখানে কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মানেনি কোনও পক্ষপাতিত্ব ধার ধারেনি। এবং তারা ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়ে লেখকদের আসার পথ সুগম করেছে। বই এসেছে অথচ লেখক আসেননি এটা নেহাতই ভাগ্যের কথা বটে।
ফুটপাথের এপাশে প্রকাশক আর ওই পাশে প্রকাশিত বইয়ের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কলেজ স্ট্রীটে যেরকম দেখা যায়, এরকম আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ।
মধু কবি বলেছিলেন জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে!
ঠিক তেমনই লিখলেই একদিন সেই বই ফুটপাথে আসবেই। ব্যাপারটা একটা বৈজ্ঞানিক নিয়মের মতোই ক্রমে এমন অকাট্য হয়ে উঠেছে যেঅনেক বইপাগল’- কেও এই নিয়ম অনুযায়ী বই সংগ্রহ করতে দেখা যায়।

কলকাতা শহরে যে কয়েক শ্রেণীর উন্মাদ বা বাতিকগ্রস্ত লোক আছেন তার মধ্যে বইপাগলরা অন্যতম। ফুটপাথের বইয়ের প্রধান ক্রেতা তাঁরাই। সমস্ত কলকাতা শহরের অলি গলি, রাস্তা ঘাট তাঁরা চষে বেড়ান। ফুটপাথের বইয়ের সমস্ত সেন্টার তাঁদের নখদর্পণে। সিনেমা, থিয়েটার বা কোনও আড্ডাতে তাঁরা যান না, যাওয়ার সময় ও নেই , মাথার মধ্যে সব সময় ফুটপাথের বই ঘুরছে। এবং তার সন্ধানে তাঁরা অবসর সময়টুকু দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
প্রায়ই দেখবেন তাঁরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছেন এবং যেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন সেখানেই কতকগুলো বই তাঁদের সামনে অম্লান বদনে ফিক ফিক করে হাসছে , এবং তাঁরা ক্ষ্যাপার পরশপাথর খোঁজার মতো এক ডাঁই স্তূপাকৃতির মধ্যে কি যেন খুঁজে চলেছেন। 
বাস্তবিকই তাঁদের উন্মাদ ছাড়া কিছু বলা যায়না।

তা ছাড়া বই সম্বন্ধে যে বৈজ্ঞানিক নিয়মের কথা বলেছি, লিখলে বই একদিন ফুটপাথে আসবেই- সে সম্বন্ধেও অনেকের অবিচলিত বিশ্বাস দেখেছি। জীবনে তারা কখনও নতুন বই দোকান থেকে কেনেন না। অথচ সমস্ত নতুন ভালো বইয়ের খোঁজ রাখেন।
যদি তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন : অমুক বইটা কিনেছেন, নতুন বেরিয়েছেখুব ভালো 
-তারা নিঃসঙ্কোচে বলবেন: হ্যাঁ, বেরিয়েছে জানি, এই মাস দুয়েক হল। এখনও কিনিনি, কিনব আরও মাস তিন চারেক পর, আশা করছি তার মধ্যে বইটা ফুটপাথে পাওয়া যাবে
আদার ব্যাপারী হলে এই উত্তর শুনে হয়ত আঁতকে উঠবেন। যদি নতুন লেখক হন তাহলে হয়ত  মর্টালি উন্ডেড হবেন। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যিই তাই।
উত্তরের উদাসীন ভঙ্গি দেখেলেই বুঝবেন, ভদ্রলোকের কি অগাধ বিশ্বাস, যেন সমস্ত লেখক ও তাঁদের বইয়ের রাজজ্যোতিষী তিনি। কোন বইয়ের কি ডেস্টিনি তাঁর জানা।

বাস্তবিকই বইয়ের ভাগ্য গণনা করতে এঁদের মতো ওস্তাদ আর কাউকে দেখা যায়না। এই শ্রেণীর দুএকজন বইয়ের গণৎকারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। কোন বিষয়ের বই, কোন লেখকের বই, কতদিনের মধ্যে হাফ দামে ফুটপাথে বিক্রির জন্যে আসবে তা তাঁরা যেন বই দেখেই বা নাম শুনেই বলে দিতে পারেন।
এইভাবে মোটামুটি বইয়ের একটা ঠিকুজী বা কোষ্ঠী আমি তাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি।
সেই কোষ্ঠীটা বললাম, সেটা দেখলেই বুঝবেন কোন শ্রেণীর বই কতদিনের মধ্যে  হাফ প্রাইসে ফুটপাথে পাওয়া যাবে।

কবিতা ২ সপ্তাহ
গুরু গম্ভীর বিষয়ের বই ১ মাস
ইতিহাস, রাজনীতি, বিজ্ঞান, দর্শন, সমালোচনা ৩ মাস
ভালো উপন্যাস ৬ মাস
ফিল্ম উপন্যাস ১ বছর
ডিটেকটিভ ২ বছর
অশ্লীল বা যৌন বিষয়ক উপন্যাস ৫ বছর
ধর্ম গ্রন্থ ৫ দিন

এই গ্রন্থকোষ্ঠীর ফলাফল পরে আমি আরও কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে মিলিয়ে নিয়েছি। মতের বিশেষ কোনও তারতম্য লক্ষ্য করিনি। বইয়ের এই হরসস্কোপ সম্বন্ধে পোস্কার ধারনা থাকলে, নতুন বই বিক্রি সম্বন্ধেও জ্ঞান হবে। কোনও বই নতুন অবস্থায় কিরকম বিক্রি হতে পারে, ফুটপাথের বইয়ের কোষ্ঠী বিচার থেকে তা স্পষ্টই বোঝা যায়।

বই সম্বন্ধে যে অকাট্য বৈজ্ঞানিক নিয়মের কথা বলেছি সেই কথার একটা করলারিও উপরের ক্যাটালগ থেকে বেরিয়ে পড়ে। করলারিটা এই, যে বই যত অল্পদিনের মধ্যে ফুটপাথে আসে, সেই বই তত অল্প বিক্রি হয়। নতুন  এবং যে বই যত বেশি দেরি করে সেই বইয়ের বিক্রি স্বভাবতই তত বেশি।
দ্বিতীয় বিষয়টাও এর থেকে সোজা টানা যায়, ক্রেতার সঙ্গে বিশেষ বিষয়ের বইয়ের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে সমাজের মনোভাবটা ধরা যায়, বেশ বোঝা যায়, বর্তমান সমাজের মানুষের মন ধর্ম বা কাব্যিক কল্পনার খোরাক চায়না, গম্ভীর বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার মতো সময় বা প্রবৃত্তি মানুষের নেই। এমনকি একখানা ভালো উপন্যাসও ধৈর্য ধরে পড়বার অবসর নেই। মানুষের জীবন ও মন চাঞ্চল্য প্রবণ হয়ে উঠেছে। আনন্দ ক্রমেই ক্ষণস্থায়ী রোমাঞ্চে পর্যবসিত হচ্ছে। বলিষ্ঠ কল্পনার থেকে দিবাস্বপ্নের মনমৈথুন অনেক বেশি উপভোগ্য। তাই ফিল্ম আর ডিটেকটিভ কাহিনীর চাহিদা বাড়ছে বেশি। এবং খাঁটি সাহিত্যের মূল্য কমছে। ফুটপাথের বই থেকে এই কথাই মনে হয়।

বাংলার ও বাঙালির কালচারে কি হাল হচ্ছে তা কলকাতার ফুটপাথে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। কলকাতার ফুটপাথের এত বইয়ের রহস্যটা জানা দরকার। এর একটা বিরাট জটিল অর্গানাইজেশন আছে যা অনেকেই জানেন না, কারণ পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁদের ট্রেড সিক্রেটসেটা তাঁরা কোনমতেই ফাঁস করবেন না। বহুকাল ধরে তাদের সঙ্গে সখ্যতার ফলে যেটুকু জানতে পেরেছি সেইটুকু বলছি।
ব্যবসাটা প্রধানত একটা বিশেষ সম্প্রদায়েরই একচেটিয়া। উপরে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী আছেন তাঁদের কলেজ স্ট্রীট, ওয়েলেসলী, নিউ মার্কেট বা কর্ণয়ালিশ স্ট্রীটে বইয়ের দোকান রয়েছে। কিন্তু তাঁরা বই জোগাড় করেন কি করে সেটাই আসল রহস্য।
কোনো বই যদি বেশিদিন বিক্রি না হয় তাহলে বেচে দেন। এটা একটা খুব নগণ্য সোর্স। বই ছাপা হলে দপ্তরীর বাড়ি ফর্মাগুলো থাকে, দপ্তরীরা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক। পুরনো বইয়ের কারবারিদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক রীতিমত ঘনিষ্ঠ। ফর্মার হিসেব গোলমাল করে প্রচুর নতুন বই কাগজের মলাট দিয়ে সস্তায় বিক্রি করে দেন। প্রকাশকদের যখন ব্যবসা লাটে উঠে যায় তখন তাঁদের বই যা দপ্তরীর বাড়িতে থাকে তা সোজা পুরনো ব্যবসায়ীদের কাছে চলে যায়।

বড় বড় লাইব্রেরি যেমন এশিয়াটিক সোসাইটি বা ন্যাশনাল লাইব্রেরির বেয়ারাও এক ধরনের বিশেষ সম্প্রদায়। তারা নানা সময়ে অনেক মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য বই ব্যবসায়ীদের কাছে পাচার করে দেয়। এছাড়াও কলকাতার বাইরের লাইব্রেরিগুলো থেকে এমন ভাবে বই আসে।
কলকাতা বা নানা জেলাতে পর্যটন অনেক বই কালেক্টর আছেন, যাঁদের খুব ভালো প্রাইভেট লাইব্রেরি আছে। তাঁদের জীবদ্দশাতেই সাধারণত তাঁদের বংশধররা দুচার খানা করে বই হাতখরচ চালানোর জন্য পাচার করতে থাকেন। আর তাঁদের নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসলেই তো কথাই নেই, পিতার সারাজীবনের সংগ্রহ বা পারিবারিক কয়েক পুরুষের সংগ্রহ সব তাঁরা ব্যবসায়ীদের কাছে একেবারে উজাড় করে দেয়।

সেটা খুব একটা আশ্চর্যের খবর নয়। কিন্তু মজার খবর এঁদের সবার খবর পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের কাছে থাকে। কোথায় কার কীরকম বইয়ের কালেকশন আছে তা জানেন এবং তার সাথেই কে কবে মরছেন, কার গুণধর ছেলের পিঠে ডানা গজিয়েছে এবং বই বেচা শুরু করেছে তার সব খোঁজ এদের মুখস্থ।
তা ছাড়া যেসব ফেরিওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পুরনো শিশি বোতল থেকে কাগজ পত্রিকা সবই কেনেন, তাঁরা সেগুলো নিয়ে এসে এক জায়গায় জড়ো করেন। এরকম দুটি কেন্দ্রের একটি আছে আলিপুরে অপরটি আছে আপার সার্কুলার রোডে। এখান থেকে আলাদা করে ব্যবসায়ীরা বই বেছে নিয়ে আসেন।

এই ভাবে নানা জায়গা থেকে নানা উপায়ে বই সংগ্রহ করে, বিক্রি করেন। পুরনো বইয়ের ব্যবসায়ীদের এই সংগঠন নতুন বইয়ের থেকে অনেক বেশি বিস্তৃত রহস্যময় ও ইন্টারেস্টিংও বটে।
বই যারা সংগ্রহ করেন তাঁরা নিশ্চিত জানবেন যে তাঁদের বংশধররা সেটা বেচে দেবেন।

এই হল কলকাতার ফুটপাথের বইয়ের রহস্য সম্ভার। ফুটপাথের বই থেকে নৈতিক শিক্ষা যেটুকু হয়েছে সেটা দিয়ে ইতি টানি--
আপনি যত বড় লেখক হোননা কেন আপনার বই কে ফুটপাথ বুলা রহি হায় এবং তা পৌঁছবেই এবং পৌঁছেছে দেখে আপনি একটুও বিচলিত হবেন না। এটাই সমস্ত বইয়ের নিয়তি
দ্বিতীয় কথা পাঠকদের উদ্দেশ্যে। আপনি যত বড় বইয়ের সংগ্রাহক হোন না কেন, আপনার কালেকশন আপনার বংশধররা বেচে দেবেই জানবেন। তাই বইকে যক্ষের ধনের মতো আগলে না রেখে যারা পড়তে চায় তাদেরকে পড়তে দেবেন। অথবা মরবার আগে যা কিছু বই জীবনে সংগ্রহ করেছেন সব কোনও সাধারণ গ্রন্থাগারে দান করে যাবেন। তাতে আপনার মঙ্গল হবে।


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই