Monday, January 28, 2013

দূরদেশী সেই স্বর্ণপদক (১) -- সুনন্দ


এই এক নতুন উপদ্রব হয়েছে। যে দিন থেকে বাঙালি মধ্যবিত্ত নিজেকে আর “দরিদ্রঘোষণা করতে ভয় পায় না, যখন থেকে সে নিজেকে আন্তর্জালের “খরস্রোতে” ভাসিয়ে দিতে শিখেছে- তখন থেকেই এই বাৎসরিক বাসন্তী উৎসবে যোগ দেওয়াটাকে সে পাড়ার পুজোয় তুবড়ি- কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করার মতোই নিজের অধিকার বলে ভাবতে শুরু করেছে। হোক না সে উৎসব সাত-সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে, নিন্দুকে আর ক্রিটিকে মিলে যতই বলুক না কেন যে, ‘ও সব পয়সাওয়ালা শিশুদের গড়াপেটা ম্যাচ’, উদ্যোক্তারা ভাবুক না তাকে সেখানে অবাঞ্ছিত- তবু বাঙালি দেখবেই দেখবে, কে পেলো, ক’টা পেলো এবারের অস্কার

আমরাও কি আর সে জ্বরে ভুগি না? সে জন্যেই তো একে বলে, তাকে ধরে, সকলের মিলিত নেট-কানেকশনের ফলাফল একটুও স্বার্থপর না হয়ে ভাগ করে নিজেদের কম্পিউটারে নামাই একের পর এক সিনেমা, নমিনেশন লিস্ট দেখে দেখে। প্রিয়- পরিচিত অভিনেতা, পরিচালকেরা নির্বাচিত হলেন কিনা, হলেও একে অন্যের বিরুদ্ধে একই বিভাগে নির্বাচিত হলে কার সেই পুরস্কার পাওয়া উচিত, অথচ শেষ অবধি কে পাবে, নতুন কোন প্রতিভা সাফল্যের মুখ দেখলো... এ সব কিছু নিয়েই আমরা চিন্তিত থাকি। আলোচনা হয়, ‘রাজনীতি তো হবেই!’, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্যিকারের দাবীদার সিনেমা রাজনীতি না করে বঞ্চিত হলে জাতীয় শোক পালন হয়। এ বছরও সেই একই গল্প- চব্বিশে ফেব্রুয়ারির সকালবেলা কারা যে একগাল হাসতে হাসতে উঠবে Dolby থিয়েটারের স্টেজে, (হ্যাঁ, এখন আর Kodak নয়, Dolby। নতুন কন্ট্রাক্ট হয়েছে কিনা, সে’জন্য), আর কারাই বা অতি কষ্টে শুকনো হাসি মুখে ঝুলিয়ে বানানো হাততালি দেবে নিচে বসে থেকে- সেই নিয়ে চাপান-উতোর, তর্জা, তক্কো-বিতক্কো চলছেই। সে সবে না গিয়ে, চলুন আমরা বরং ‘যাহা জানো লিখ’ গোছের একটা তথ্য-বহুল ভ্রমণ সেরে আসি আকাদেমি-আঙিনা থেকে।


Life of Pi : নতুন কিচ্ছু বলার নেই, দেখে যা মনে হয়েছিলো, সেটা এই পোস্টে গুছিয়ে বলা আছে। যে টুকু বলার আছে, তা হল- ১১টা বিভাগে নমিনেশন পেয়ে গেছে সিনেমাখানা। বিস্তারিত বিবরণ- এখানে। ভারতেরও একখানা দাবি আছে এই প্রায় আধা-ভারতীয় সিনেমার সৌজন্যে- জয়শ্রী রামনাথ, যিনি ‘বম্বে’ জয়শ্রী নামে বেশি পরিচিত, ‘RHTDM’ সিনেমার ‘zআরা zআরা’ গানটা গেয়ে গোটা ভারতের কানে বেজায় আরাম দিয়েছিলেন, তিনিও নির্বাচিত- Best Original Song বিভাগে, এই গানটার জন্যে।


Lincoln : দাদু স্পিলবার্গ প্রযোজনা-টযোজনা ছেড়ে আবার স্ব-ভূমিকায়। Daniel Day-Lewis কাঁপিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি হলিউডে Bio-pic তৈরির একটা গৎ দেখা যাচ্ছে। Meryl Streep আর Leonardo DiCaprio পর পর মার্গারেট থ্যাচার আর জে. এডগার হুভার এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অতটা সাম্প্রতিক না হলেও লিস্টে আছেন Morgan Freeman আর Helen Mirrenও। ভুল বুঝবেন না, এই সিনেমা ঠিক জনতার মন বুঝে, ‘সবাই করছে, আম্মো করুম’ ভঙ্গিতে তৈরি নয়। সঙ্গের ছবিতে যদিও হাল্কা চালে ড্যানিয়েলের মনের সুপ্ত ইচ্ছের কথা বলা আছে, আসল ঘটনা কিন্তু একটু অন্যরকম। স্পিলবার্গ প্রথমে লিয়াম নিসনকে নিয়ে ছবি করার কথা ভাবলেও লিয়ামের বয়স বেড়ে যাওয়ায় তিনি সরে যান। বয়স বেড়ে যাওয়ার আর দোষ কি? বারো বছর ধরে ছবি নিয়ে গবেষণা চলছিল, জানেন! লিঙ্কনের অফিসের দেওয়াল-কাগজ(wallpaper) থেকে শুরু করে বই-পত্র – স-অ-ব আসল জিনিস। আসল মানে, সাক্ষাৎ লিঙ্কন ওইগুলো ব্যবহার করেছেন। এমনকি, Foley তে লিঙ্কনের পকেট-ঘড়ির টিক-টিক শব্দ যেটা রেকর্ড করা হয়েছে, সেটাও কেন্টাকির ফ্রাঙ্কফুর্ট মিউসিয়ামে থাকা লিঙ্কনের আসল ঘড়ির শব্দ। 13th Amendment পাশ করানোর দৃশ্যে উপর থেকে ঝুলে থাকা গ্যাস-পাইপগুলো পর্যন্ত আসল পাইপগুলোর মতো অল্প অল্প দোলে। কি বুঝলেন? এইসব করতে গিয়ে লিয়ামকে হাতছাড়া করে স্পিলুজ্যাঠা শেষ অবধি গিয়ে ধরলেন ড্যানিয়েলকে। প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনার পরে মধুর ভাষায় একটি চিঠি লিখে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন লুইস। এদিকে ডিরেক্টর ভেবে বসে আছেন, ড্যানিয়েলকে ছাড়া তিনি ছবি করবেনই না। অবশেষে লিওনার্দোর হস্তক্ষেপে অভিনেতা রাজি হলেন। ভাগ্যিস!

শুধু কিছু ব্যক্তি, যারা ওই অ্যামেন্ডমেন্টের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের ও তাঁদের বংশধরদের লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে- এছাড়া ঐতিহাসিক তথ্যের প্রতি সুবিচার দেখতে গেলে, এ ছবি প্রায় নিখুঁত। শ্যুটিং চলাকালীন স্পিলবার্গ তাঁর অতি-পরিচিত টুপি, গেঞ্জির বদলে স্যুট পরে আসতেন, প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে তাঁদের চরিত্রের নামে, যেমন ড্যানিয়েলকে ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট’, স্যালি ফিল্ডকে ‘মলি’ -এসব বলে ডাকতেন। শেষ দৃশ্যের শ্যুটিং হওয়ার পর মাইকেল কেনেডি, যিনি হিরাম প্রাইসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, কেঁদে ফেলেছিলেন। কারণ-
 “We're in this room recreating one of the most important moments in American history... and up there [in the balcony] with the press sat my great-grandfather.

এ তো গেল পর্দার পিছনের গল্প। স্পিলবার্গের সিনেমা দেখে হল থেকে বেরনোর সময় যত রকম অনুভূতি সঙ্গে থাকে সাধারণত, এই ছবি দেখার পরেও থাকবে। সঙ্গে ফাউ- বারংবার ভাববেন, এই লোকগুলো, তাদের দুনিয়াটা- সত্যিই ছিল এরকম!

আমার নিজের সবথেকে ভাল লেগেছে দু’টো জিনিস- এক, ভীষণ গম্ভীর পরিবেশে এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো Bilboর চরিত্রে James Spader, আর লিঙ্কন দম্পতির কলহের সময়টা। ওই দৃশ্যটাকে দাম্পত্য-কলহ বলে ছোট করার মানে হয় না। আক্ষরিক অর্থেই যে মানুষগুলো মাথায় ‘ভুবনের ভার’ নিয়ে চলেন, তাঁদের মানবিক দিকটা- সাধারণ ক্ষোভ, মোহ, দুর্বলতাগুলো তুখোড় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠতে দেখলে সাময়িকভাবে নিজেদের অপ্রাপ্তিগুলো বেজায় খেলো মনে হয়। আর একটা ব্যাপার, আমার বড্ড জানার ইচ্ছে, ড্যানিয়েল কি অতটাই লম্বা, নাকি ওর পেছনেও কোন হলিউডি ম্যাজিক আছে? খোঁজ পেলে জানাবেন তো!

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এই সিনেমাটা Life of Pi এর থেকে একটা নমিনেশন বেশি পেয়েছে- ১২টা। তবে ঐ যে, এর মধ্যে আবার ‘রাজনীতির গন্ধ’ পেলে ঘরে বলবেন, বাইরে নয়। এ তো আর ফিল্ম-ফেয়ার নয়, যে নির্লজ্জ শাহরুখ-তোষণ হবে! স্পিলবার্গ-তোষণ যদি হয়েই থাকে, সে নিয়ে কথা বলা কি আর আমার আপনার মতো চুনোপুঁটির শোভা পায়?


Django Unchained : শাহরুখের কথায় মনে হলো- ধরুন, ফারহান আখতার ‘ডন’ ছবিটার রিমেক করার সময় এমন একটা দৃশ্য রাখলেন, যেখানে অমিতাভ বচ্চন নামহীন এক চরিত্রে শাহরুখের পাশে হুইস্কির গ্লাস হাতে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কি তোমার?” উত্তরে আধুনিক ডন স্বভাবসিদ্ধ বাঁকা হাসি হেসে বললেন, “১১টা দেশের পুলিশ আমায় নানা নামে চেনে, কোনটা বলবো?” অমিতাভ এক চুমুকে হাতের গ্লাসটা ফাঁকা করে ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রেখে অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, “১১টা দেশের পুলিশ আমাকেও খুঁজতো এককালে, শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে; তা বলে প্রতিবার কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে আমি সে কথা শোনাতে যাই না।”- বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। ছোট্ট রোল, সিনেমার গল্প বলার দিক থেকে অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু বুদ্ধিমান ডিরেক্টর একবার সুযোগ পেলে এমন কোন দৃশ্য ছেড়ে দেবেন কি? কেন দেবেন? তাঁর কানে তো পরিষ্কার বাজছে সিন শেষ হওয়ামাত্র হল-ভর্তি দর্শকের সিটি- হাততালি। ইন্ডাস্ট্রির দুই মহীরুহের অগণন ভক্তের হয়তো ওই এক দৃশ্যেই পয়সা উঠে আসবে। তাই না?

দুই Django : জেইমি (বাঁদিকে) আর ফ্র্যাঙ্কো (ডানদিকে)
এ সব ‘মেনস্ট্রিম’ সিনেমায় আকছার হয়, হতেই পারে। কিন্তু এমন একটা সিনেমা অস্কার নমিনেশন পেতে হলে ঠিক কি কি করতে হয়, সেটা বোধহয় ‘জ্যাঙ্গো’ করে দেখিয়েছে। ওই নামেরই আসল সিনেমা বহু দিনের পুরনো, ১৯৬৬ সালের। নাম-ভূমিকায় ছিলেন Franco Nero, এই সিনেমায় যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন Jamie Foxx। উপরে যে দৃশ্যের বানানো গল্পটা বললাম, ঠিক ওই রকম একটা দৃশ্য আছে এই বছরের সিনেমায়(আমি শুধু কথোপকথনটার একটু বলিউডিকরণ করেছি)। সেখানে নতুন জ্যাঙ্গোকে তার নাম জিজ্ঞেস করছেন আসল জ্যাঙ্গো। উত্তর শুনে আবার জিজ্ঞেস করছেন, “বানান করতে পারো তো?” জেইমি বানান করা শেষ করে যখন বললেন, “The ‘D’ is silent.” ফ্র্যাঙ্কো গম্ভীরভাবে “I know.” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একই সঙ্গে পূর্বসূরির প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন, নতুনের জন্য পুরনোর স্টেজ ছেড়ে দেওয়া- সব দেখানো হয়ে গেল।
এই দৃশ্য ছাড়া দুই সিনেমার মধ্যে যা মিল, সেটা যে কোনো দু’টো ‘Wild West’ ঘরানার সিনেমার মধ্যে থাকে। দানবিক ভিলেনের নারকীয় অত্যাচার, এক বা একাধিক damsel in distress, প্রথমার্ধে প্রচণ্ড মার খাওয়া হিরো, শেষে প্রভূত পরিমাণ দুষ্টের দমন আর সামান্য শিষ্টের পালন মারফত মধুরে-ণ সমাপয়েৎ।

এছাড়াও গল্পে নানা প্যাঁচ দিয়েছেন Tarantino- প্রথমত, ভিলেনরা সব দাস-মালিক আর জ্যাঙ্গো নিজে পলাতক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। তার ‘গুরু’ হয়েছেন সেই জার্মান অভিনেতা, যিনি Inglorious Basterds এর প্রবল দীর্ঘায়িত প্রথম দৃশ্যে নাৎসি সেজে আপনার হাড় হিম করে দিয়েছিলেন- Christoph Waltz। প্রথম দৃশ্য থেকেই নিরন্তর কলার-তোলা(মানে সাদা বাংলায় কেতার) ডায়ালগ আর আচম্বিতে তীক্ষ্ণ ভায়োলেন্স- শুধু বাস্টার্ডস্‌ই নয়, তারান্তিনোর আগ-মার্কা যে কোনো সিনেমার কথাই মনে করিয়ে দেবে। বরফ-শীতল বেশ কিছু দৃশ্য আছে এই সিনেমায়, যার ঘনিয়ে ওঠা প্রচণ্ড সাসপেন্স ঠিক পরবর্তী বোমা-ফাটানো অ্যাকশন দৃশ্যের জন্য আপনাকে নখ খুঁটতে খুঁটতে অপেক্ষা করতে বাধ্য করবে।

সবশেষে, নেপথ্য সঙ্গীত। ঘরানার প্রতি একটুও অসম্মান না করে, নিজের অতীতের আর দর্শকের চাহিদার প্রতি একটুও অবিচার না করে কি করে তুখোড় অ্যাড্রেনালিন-নাচানো আবহ তৈরি করা যায়- শুনে ফেলুন।

পড়ে থাকলো আরও ছয়খানা সিনেমা- Amour, Argo, Beasts of the Southern Wild, Les Miśerables, Silver Linings Playbook আর Zero Dark Thirty; এর সবক’টা নিয়েই আলোচনা হবে পরের দুই পর্বে। সবার শেষে আমরা খেলাচ্ছলেই একটা লিস্টি বানাবো- এই বছরের অস্কারের ভবিষ্যদ্বাণী। তার পর রেজাল্ট বেরোলে মিলিয়ে দেখবো- কত ধানে কত চাল! আমাদের সঙ্গে আপনিও খেলতে পারবেন খেলাটা, ভোট দিয়ে- তবে তার জন্যে এখন থেকেই দেখতে শুরু করুন সিনেমাগুলো। মজাই হবে, কি বলেন?

পরের কিস্তি>>

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই