Wednesday, May 15, 2013

নামান্তর -- নির্মাল্য

অনেকদিন আগে, যখন বিজ্ঞান মাথাটাকে পুরোটা মুড়িয়ে খায়নি, মানে যখন পুরনো বাড়ির কার্নিশে ভুতের সাদা কাপড় দেখে ভয় পাওয়ার আনন্দটুকু পেতাম, তখন ক্লাস সেভেন-এর সদ্য গোঁফ ওঠা ‘বড়’ দাদা প্রশ্ন করেছিল, “আচ্ছা, বলত, এমন কি জিনিস, যা ছোট-বড়, জ্যান্ত-মরা, প্রাণী-ভুত সব্বার আছে?” গোল গোল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেও এরকম সার্বজনীন সম্পত্তির কোন পাত্তা পাই নি। পাড়াতুতো দাদা বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে জানিয়ে দিয়েছিল, সেই বস্তুটি আর কিছুই নয়, সেটি হল “নাম”। সত্যিই তো এটা মনে এল না! সেদিন বুঝলাম ক্লাস সেভেনে উঠলে সত্যিই পণ্ডিত হয়ে ওঠা যায়। তারপর থেকে আজ অবধিও এই ব্যাপারটার তেমন কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়ে নি। “প্রাচীরের গাত্রে” “নামগোত্রহীন” ফুলের পরিচয় জমিদার বাড়িতে বসে হয়তো পাওয়া যায়নি, কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা ফচকে ছেলের কাছে ফুলটা বোধহয় অতটাও অখ্যাত নয়। যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের উদ্দেশ্যে দু’চার কলি গেয়ে নিতে আমার মোটেই ভাল লাগে না। কিন্তু নাম ব্যাপারটা নিয়ে দু’চার কথা বলতে পেলে মন্দ হয় না।

প্রাচীন সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রীক প্রায় সব ভাষাতেই “নাম” শব্দের মূলটি মোটামুটি একই। তবে প্রাচ্যে “নাম” তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং বহুমাত্রিক। আপনার নিশ্চয় মনে আছে,
ছোটবেলায় (হয়ত বুড়োবেলাতেও) অসীম, সুরেশ, শম্পা এদের মধ্যে অনেককেই ঠাট্টা করতে বা সংক্ষিপ্ত করতে প্যাঁচা, কানু, শুকু, ***, এসব বহু নামেই ডেকেছেন। কিংবা আপনি নিজেই যদি এই সুরেশ বা শম্পার মধ্যে কেউ একজন হন, তাহলে তো মোটেই ভুলবার কথা নয়। শুধু ঠাট্টা করতেই নয়, চিকিৎসাহীন অশিক্ষার দেশে যমের নজর এড়ানোর জন্য খেঁদি, বুঁচি, পেঁচি ইত্যাদি নাম দেওয়ার চল এমনকি আজও আছে। কিংবা পুণ্যিলাভের শর্টকাট হিসেবে নিজের ছেলেপুলের নাম শিব, হরি, দুর্গা ইত্যাদি দিয়ে দেওয়াটাও খুবই জনপ্রিয়। “ওরে হরি, গেলি কোথায় হারামজাদা”- একবার ডাক দিলেন, খিস্তিটা ফিল্টার হয়ে গিয়ে একবার হরিনামের ফল হিসেবে এক আনা পুণ্য আপনার ওপারের ভল্ট এ জমা হয়ে গেল। পান থেকে চুন খসতেই লক্ষ্মী এবং তার বাপের বাড়ির গুষ্টি উদ্ধার করে শাশুড়ি এক পুঁটলি পুণ্যি বাগিয়ে নিলেন। তোফা স্বল্প সঞ্চয় যোজনা। মুশকিলটা হল, নামের ওপর কারোরই নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। গাছ, চারপেয়ে, দুপেয়ে- কারোরই না। আম্র থেকে উচ্চারণের সুবিধার্থে ‘আম’ হয়ে গিয়ে বেচারার গৌরব মাঠে মারা গেল। ‘আম’ শব্দের সাধারণত্ব নিয়ে উক্ত রসালো ফলটির আপত্তি করার ক্ষমতাও নেই, আর করলেই বা শুনছে কে? হলফ করে বলতে পারি আপনার নাম দেওয়ার আগে আপনার মা-বাবা আপনার সাথে মোটেই কোন আলোচনার ধার ধারেননি। অতএব নাম পছন্দ না হলে আদালতে গিয়ে হলফনামা দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই নেই। কিন্তু ততদিনে আপনি আপনার অপছন্দের নামে (এবং অবশ্যই তার অগুনতি ইচ্ছাকৃত অপভ্রংশে) বিখ্যাত হয়ে গেছেন।

এই প্রসঙ্গে কিছু মজার তথ্য চোখে পড়ল কিছুদিন আগে। বিশ্বের বহু দেশ নিজের হবু নাগরিকদের নামকরণের ওপর বিধিনিষেধ ও সরকারী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। জার্মান সরকার যেমন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন যে সন্তানের নাম অবশ্যই তার লিঙ্গের পরিচয় দেবে এবং নামটি এমনই হতে হবে যা কিনা ভবিষ্যতে সন্তানের বিব্রত হওয়ার কারণ হবে না। প্রাচীরঘেরা চীন অবশ্য নামের ব্যাপারে যথেষ্ট উদার। তেমন কোন বিধিনিষেধ নেই। শুধুমাত্র অ-চৈনিক বর্ণ ব্যবহারে আপত্তি তাদের। আর নিজেদেরকে পুরোপুরি computerized জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে বেজিং এমন ধরণের নামের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে, যেসব নাম Key-board friendly নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার উলটো পথের যাত্রী। সেখানকার একাধিক রাজ্য নামের মধ্যে ‘@’- এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। একটু বেশিই Key-board friendly বলে হয়ত। ডেনমার্ক, নরওয়ে, জাপান, আইসল্যাণ্ড এসব দেশে আবার সরকারী নামের তালিকা থেকে নাম বাছাই করা বাধ্যতামূলক। ফ্রান্স আবার জানলা খুলে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে। কয়েক শতাব্দী আগেও সেখানে গুটিকতক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীর নামের অনুকরণে নামকরণ বাধ্যতামূলক ছিল। পরে আইন করে সরকার বাপ-মাকে নামকরণের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়। নামকরণের ওপর সংবিধানের হস্তক্ষেপ যেমন ছিল, তেমন “মানছি না-মানব না”ও কম নেই। সবচেয়ে মজার প্রতিবাদটি বোধহয় জানিয়েছেন এক সুইডিশ দম্পতী। সরকারী রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে সরকারেরই দেওয়া নিয়ম মেনে নিজেদের সন্তানের নাম দেন 

আমাগো দেশে এসব উৎপাতের বালাই নেই। নিজের সন্তানের উৎকট নাম দিয়ে প্রচারের আলোয়
আসতে চান না কোন অভিভাবকই। লোকালয় অনুযায়ী জনপ্রিয় নামই তাদের পছন্দ। রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের দিয়ে নামকরণ করানোর চলও বেশ আছে। ব্রিটিশ-উত্তর যুগে বর্ণবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার পর অনেক মা-বাবাই তাদের কৃষ্ণবর্ণা কন্যাসন্তানের নাম রেখেছিলেন কালী। হুঁ,হুঁ, বাবা, ওর গায়ের রঙ নিয়ে কুচ্ছো করেছো কি গেছো, বিশমণি খাঁড়ার আঘাতে মুণ্ডু ঘ্যাচাং। এই ভিড়ের দেশে আবার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে নাম নিয়ে বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বনের ইতিহাসও পুরনো। এই যেমন কিছুদিন আগেই শোনা গেল বলিউডের অভিনেত্রী “রিমা লাম্বা” আদালতের চৌকাঠ না মাড়িয়েই নিজের নাম পরিবর্তন করে ফেলেছেন। তার মত ‘বিশিষ্ট’ অভিনেত্রীর অন্যান্য বলিউড বিহারিণী রিমার সাথে মুড়ি-মিছরির একই দর যাতে না দাঁড়ায়, তাই তিনি নাম নিয়েছেন “মল্লিকা শেরাওয়াত”। সুফল কতটা ফলেছে সে কথা আলাদা। কিন্তু আমরা ‘সবাই রাজা’র দেশে নাম নিয়ে এমনিতে খুব বেশি ছুঁৎমার্গের খবর নেই। সবাই ‘ভালো’নাম ও ‘ডাক’নাম মিলিয়ে তিন চারটি নাম নিয়ে বেশ খুশী। দেখলে হবে, খরচা আছে। অষ্টোত্তর শতনামের দেশে এটাই স্বাভাবিক।

নামের সঙ্গে ‘কাম’-এর কুৎসিত বৈপরীত্যও জনপ্রিয় আলোচ্য বিষয়। ‘অনামিকা’র মত একটা জনপ্রিয় নামের অর্থই ‘নামহীন’। ‘শিব’ শব্দের অর্থ মঙ্গল। কিন্তু সর্বনাশা তাণ্ডব ও প্রলয়ের গুরুদায়িত্ব ঐ ভোলেভালা দেবতার কাঁধেই। ‘বিশ্বামিত্র’ মুনিই বশিষ্ঠের সাথে ‘শত্রুতা’র অবিস্মরণীয় কীর্তি রেখে গেছেন। অভিনেতা ‘ধর্মেন্দ্র’ (আসল নাম ধরম সিং দেওল) স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্ম পরিবর্তন করেছেন বলে অভিযোগ। ‘ফুলন’ নামটির সাথে ফুলের কোমলতা জড়িত ছিল বোধহয় এককালে। সংসদে সর্ব্বাধিক হৈ-চৈ এবং শারীরিক ভাবে সভা চলতে বাধা দেওয়ার রেকর্ড করায়ত্ত করেছেন ‘মুলায়ম’ সিং যাদব। প্রথমে তেরো দিন, তারপর তেরো মাসে অসহায় ভাবে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন ‘অটল’বিহারী বাজপেয়ী। বফর্স কামান আর এ কে ৪৭ এর শব্দে অতন্দ্র হিমবাহের নাম ‘সিয়াচেন’। শব্দের অর্থ নাকি ‘অনেক গোলাপ’!! তাতে কি, পদ্মলোচন নামটা তো চিরদিনই......


About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই