Thursday, July 11, 2013

লালবাতির রূপকথা -- সুশোভন


এই শহরের মানুষ লালবাতি ঘেরা এলাকাগুলোকে বাঁকা চোখে দেখেন। সেখানে যেন রতি এবং রতি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ওখানকার মানুষদের রোজনামচার প্রসঙ্গে সমরেশ মজুমদারের লেখা উপন্যাস ‘তিন নম্বরের সুধারানী’-র কথা মনে পড়ে।
একটা সময় পুলিশ দালাল তোলাবাজ বা বাড়িওয়ালার অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া যৌনকর্মীদের কিছু উপায় ছিলনা। স্মরজিৎ জানা নামের প্রত্যন্ত গ্রামের এক যুবক কলকাতায় এলেন। এক কাহিনীর জন্ম হল, উপন্যাসের মতো ‘কলিকাতায় নবকুমার’। তিনি নিরন্তর চেষ্টা চালালেন আলো জ্বালাবার। ১৯৯৫ সাল, প্রতিষ্ঠা পেলো যৌনকর্মীদের নিজস্ব সংগঠন ‘মহিলা দুর্বার সমিতি’। তার আগে পর্যন্ত সবকিছু ছিল বড় ধুসর। যৌনকর্মীদের দেহের জৌলুস কমলে ভিক্ষা করে বেঁচে থাকতে হতো। তাঁদের ছেলেরা একটা বয়স পার করে মস্তান হত আর মেয়েরা ১৪-১৫ পেরলে এই পেশায় আসতে বাধ্য হতো।

এমন কোনও নিরাপদ স্থান ছিলনা যেখানে তাদের সমস্ত অর্জন সঞ্চয় করে বা লুকিয়ে রাখতে পারে। সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ ঠকিয়ে টাকা নিয়ে চলে যেতো। কেউ কিছু বলতে পারতো না। এমন কেউ ওদের পাশে ছিলনা যে অন্য কিছু ব্যবস্থা করতে পারে। ধীরে ধীরে ওঁরা নিজস্ব ব্যাঙ্ক তৈরি করলেন। যার নাম ‘ঊষা কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক’। ওদের জীবনে অন্ধকার কমতে লাগলো।


বিডন স্ট্রীটে লাল আলোর দুনিয়ায় আমাদের এক বন্ধু কদিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে শিশুদের পড়াতে গেছিল। তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাটুকু কেবল ভাগ করে নিতে চাই। একটা মাত্র ছোট্ট, এক রত্তি ঘর। তেলচিটে সস্তা পর্দা দিয়ে ভাগ করা। সেখানে এক পাশে বাচ্চাটির ‘অ আ’ পড়ার স্বরের সঙ্গে অন্যপারে রতির শীৎকারের স্বর মিশে যায়। বাড়তি পাওনা ছিলো রোজগারের বখরা নিয়ে ঝামেলা। বা কাস্টোমারের সোহাগের খিস্তি। পর্দার আড়াল থেকে শিশুটি বিস্ময়ে শুনেছে আর দেখেছে আরও কত কিছু।

এই শৈশব কি ওর প্রাপ্য!

আমেরিকান সিনেমা নির্মাতা জানা ব্রিক্সি ২০০৪ সালে এই শিশুদের ‘শৈশবের ভয়াবহতা’ নিয়ে বানিয়েছিলেন তাঁর ৮৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘বর্ন ইনটু ব্রথেলস’। বিপুল অর্থের সেই সিনেমার ভাগ্যে ২০০৫-এ ‘সেরা তথ্যচিত্র’ বিভাগে অস্কার-ও জুটেছিল। কিন্তু ধূসরতা ক্রমশ বেড়েছে।
একটুকরো শ্যামাঞ্জন ছায়া কি ওদের জীবনেও আসবেনা!
এই ভাবনা থেকে ড. স্মরজিৎ জানা এগিয়ে এসেছিলেন। ২০০১ সাল নাগাদ খুব সস্তায় শহরতলিতে জমি পাওয়া গেলো। মূলত যৌনকর্মীদের দেওয়া চাঁদার টাকায়, অনুদানে এবং ড. জানার উদ্যোগে গড়ে উঠলো ‘হোম’। সেখানে আকাশ অনেক বড়। সাদা কালোর জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহর থেকে দূরে, গড়ে উঠলো তাদের স্বপ্নের নীড়।


বারুইপুর হয়ে যে বড়রাস্তা ক্যানিং এর দিকে গেছে সেখান থেকে অনেকটা ভেতরে এই বাড়ি। জায়গাটার স্থানীয় নাম ‘রাহুল স্টপ’, সেখান থেকে বেশ খানিক হেঁটে পৌঁছে যাওয়া। মূল ফটকে নাম লেখা ‘রাহুল বিদ্যানিকেতন’।
ভেতরে ঢুকতেই বাঁ দিকে অফিস, তারপর গেস্ট হাউস তারপর আরও দুটো বাড়ি। ডান দিকে বাগান, বাগানের পাশে ধানক্ষেত। ওঁদের ভাবনা ছিল এই ক্ষেতে ফসল ফলিয়ে যেন খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাই একটু একটু করে ৫০ বিঘে জমি কিনেছেন ওঁরা। কিন্তু রাসায়নিক সার ব্যবহার করেননা। তার ফলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়।

একটু একটু করে অনুদান আর সাহায্যে এক দশক ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে এই ‘রাহুল বিদ্যানিকেতন’। ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম পণ্ডিত রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের নামে এই হোম।

এক চিলতে সুস্থ পরিবেশে শৈশব যাপনের আশায় এই হোমের সূত্রপাত। এই মুহূর্তে অন্তত সত্তর জন ছেলেমেয়ে রয়েছে এখানে। তারা ক্লাস টু থেকে টেন পর্যন্ত পড়ে। ছেলে ও মেয়েদের থাকার জন্যে দুটো আলাদা বাড়ি রয়েছে। কয়েকজন মহিলা এখানে ওদের দেখভাল করেন। আরও ভেঙে বলতে গেলে নিঃস্বার্থ ভাবে মায়ের মতো স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে দেন। গতবারে যারা মাধ্যমিক পাশ করেছে তাদের অনেকেই খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রতিটি বাচ্চার থাকা খাওয়ার খরচ মিলিয়ে তাদের মায়েদের কাছ থেকে মাসে ৮০০ টাকা করে নেওয়া হয়। যদিও এর থেকে অনেক বেশি খরচ হয়। ছুটির সময়গুলোতে ওরা মায়েদের কাছে যায়। কিন্তু এখন অনেকেই আর ঐ পরিবেশে ফিরে যেতে চায়না। তাই ওদের মায়েরা পালা করে বাচ্চার সঙ্গে থাকবে বলে আসেন।

এই গোটা কর্মকাণ্ডর ড. জানা একাই সামলে চলেছেন। ছিটেফোঁটা সরকারী অনুদান পাননা। পশ্চিমবঙ্গের ৬৫০০০ যৌনকর্মীদের সন্তান সংখ্যা কম নয়। বৃদ্ধাশ্রম তৈরির কাজও শুরু হবে। কিন্তু এই বিপুল খরচের বহর সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন দুর্বারের প্রাণ পুরুষ ড. জানা।

বাচ্চারা কাছের কয়েকটি স্কুলে পড়তে যায়। বিকেলে ফিরে পাশেই খেলার মাঠে স্বপ্ন রাজ্যের সন্ধানে দৌড়। উয়াড়ি ক্লাবের প্রাক্তন অধিনায়ক বিশ্বজিৎ মজুমদার, ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা আলাদা ভাবে খেলার প্রশিক্ষণ দেন। ফুটবল ঘিরে তাদের হুল্লোড়। এই বাচ্চাদের কয়েকজন অনূর্ধ্ব তেরো ভারতের দলে খেলেছে। একজন ছিল ভারতের অধিনায়ক। আই-এফ-এর নার্সারি লিগে খেলছে।

বিকেলের রং ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে। ওদের খেলা সাঙ্গ হবে। আকাশের পারে আলো। ওরা সবাই একসাথে অনেক গল্প বুনতে বসলো। ওদের দলে যোগ দিলাম। পড়াশোনা থেকে খেলা, কলকাতা থেকে এই দিকশূন্যপুর। হুস করে কোথা থেকে যেন সময় কেটে যেতে লাগলো। ওদের চোখে তখন অনেক স্বপ্নেরা ভিড় করছে। প্রত্যেকে বড় হয়ে অনেক ‘বড় হতে চায়’। চোখে দৃঢ় প্রত্যয়। ওদের চোখে মুখে আলোর ছটা। অপূর্ব সে আলো।

বিশাল ধানক্ষেত, পুকুরের নিস্তব্ধতা, একপাল হাঁসের সখ্য আর অনেক বড় আকাশের পারে ওদের বড় হওয়ার ঠিকানা। জন্ম বা অতীতের ছায়া থেকে অনেক-অনেক দূরে। ‘যেখানে সবার বরাতে জোটে / সকল খেলনাবাটি, দিনশেষে’। এর পরেও যদি কোনও কারণে ঐ নিষিদ্ধ গলির বাঁকের কোনও আধো অন্ধকার ঘরে ওদের ফিরে যেতে হয় সেদিন হয়তো লজ্জায় বা ভয়ে আমাদের মুখ লুকোবার জায়গার অভাব হবে।

Dr. Smarajit Jana - Talk # 2 from CHIPTS, UCLA on Vimeo.

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই