Monday, January 23, 2017

একটি মৃত্যু সংক্রান্ত কাহিনী -- তপোব্রত

উৎস
ষোলই জানুয়ারি, সোমবার!

সকাল সকাল যমরাজ সভায় গিয়ে দেখলেন সন্তোষপুরের নিবারণ পাল একটা ছেঁড়া গেঞ্জি আর নীল চেক-চেক লুঙ্গি পরে শুকনো মুখে মোবাইলে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছেন। চিত্রগুপ্ত (মানে ঐ জহর রায় লুক-অ্যালাইক) তাক থেকে রোজকার হিসেব নিকেশের খাতাগুলো নামিয়ে ধুলো ঝাড়ছে আর দুটো যমদূত এক কোণে বসে গুলতানি মারছে।

“কি ব্যাপার? এটা কে?”- নিবারণবাবুকে দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন যমরাজ। “স্যার, এনার নাম নিবারণ পাল। কাল রাত্তিরে সিগনাল পেয়ে জোড়া-ব্রিজের পাশের গলি থেকে তুলে এনেছি। বাকি ডিটেল চিত্রবাবু জানেন।”- কান চুলকোতে চুলকোতে বললো এক যমদূত, “আমাদের নাম দু’টো মান্থলি পারফর্মেন্সের খাতায় লিখে নিন, তারপর যাই গিয়ে রেস্ট নিই। মেলা পরিশ্রম হয়েছে।”

আজকাল সিন্ডিকেটের বাজারে এইসব পাতি যমদূতরাও যমরাজকে ভয় পায় না। গম্ভীর মুখে মনে মনে ওদের বাপ-বাপান্ত করতে করতে চিত্রগুপ্ত নাম দু’টো লিখে নিয়ে দু’টোকে বিদায় করলেন। এই জানুয়ারি থেকেই শুরু হয়েছে, এবার ডিসেম্বর অবধি কে ক’জনকে নিয়ে এলো তার ভিত্তিতেই বছরের শেষে ‘যমালয়-শ্রী’, ‘মহাযমদূত’ এইসব পুরস্কার দিতে হবে।

নিবারণবাবু পিটপিট করে ব্যাপারটা দেখছিলেন। যমদূত দু’টো কেটে পড়ার পর গুটিগুটি যমরাজের সামনে এসে একটা সেলাম ঠুকলেন।



যমরাজ একটু হেসে বললেন, “নমস্কার! তা কীসে এলেন? লিভার? ক্যান্সার? নাকি মেট্রো রেল? দেখুন মশাই, আগেই বলে রাখছি, আত্মহত্যা মহাপাপ, নরকে গমন! ওটার ব্যাপারে আমি ভীষণ স্ট্রিক্ট!”

“আজ্ঞে ও’সব কিছু নয়। সামান্য ফুড পয়জনিং।”

“ফুড পয়জনিং! আহারে... কি খেয়েছিলেন?”

“বাসি বিরিয়ানি।”

“বিরিয়ানি? সে আবার বাসি হওয়ার চান্স পায় নাকি? সে জিনিস তো পাতে পড়লেই আলু-ডিম-মাংস শুদ্ধু উড়ে যায়। আপনি বাসি বিরিয়ানি পেলেন কোথায়?” সুড়ুৎ করে জিভের জলটা টেনে নিয়ে বললেন যমরাজ।

“আর বলবেন না, পাড়ার পিকনিক ছিলো শনিবার। ক্লাবের ছেলেরা হামলে পড়ে খাবে ভেবে গাঁতিয়ে বিরিয়ানি বানানো হয়েছিলো কিন্তু তারপর একদল লোক গঙ্গাসাগরে চলে গেলো। ব্যাস! লোক কম, বিরিয়ানি গেলো বেঁচে। আর বিরিয়ানিটাও সুবিধের ছিলো না। চিকেন তো, বুঝতেই পারছেন!”

“এ হে হে... চিকেন বিরিয়ানি! মাটন নয়! রাম রাম!” মুখ বাঁকালেন যমরাজ, “যাকগে গুপ্ত, বাকি হিসেবটা দেখে নাও তো।”

চিত্রগুপ্ত মন দিয়ে তাঁর হিসেবের খাতায় নিবারণবাবুর পাপ-পুণ্যের হিসেব করছিলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। বললেন, “মহারাজ, এই ব্যক্তি সঠিক কথা বলছে না। এর হিসেব নিশ্চিতভাবে বলছে যে এ আত্মহত্যা করেছে!”

“সে কি কথা!” যমরাজও একটু গম্ভীর হলেন।

নিবারণবাবু হাত জোড় করে বললেন, “না হুজুর! কোথাও একটা ভুল হচ্ছে! আপনাদের রেকর্ড সব আপ-টু-ডেট তো? ডেটাবেসে কোন গণ্ডগোল নেই তো?”

চিত্রগুপ্ত খিঁচিয়ে উঠলেন, “রেকর্ড সব ঠিক আছে। এগুলো কম্পুটারাইজড নয়। ঐ বিষয়ে আমরা পশ্চিমবঙ্গের পুরোনো শাসকদলের সঙ্গে ঐক্য বজায় রেখেছি!”

যমরাজ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিই বলুন আপনার মৃত্যুর দিন কি হয়েছিলো?”

“মহারাজ, ক্লাবে ঐ বিরিয়ানিটা পড়েছিলো, কেউ নিতে চাইছিলো না। আমার আর সতীশের মধ্যে তো ঝগড়াই হয়ে গেলো। তো, আমরা বাজি ধরলাম, যে বাজি হারবে তাকে ঐ বিরিয়ানি নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে হবে। বাজিতে হেরে গেছিলাম হুজুর, তারপর অতটা বিরিয়ানি ফেলে দিতে গিয়ে লোভ সামলাতে না পেরে খেয়ে নিলাম। তার একটু পর থেকেই বুকে-পেটে কি যন্তন্না, একা লোক, কাউকে ডাকার আগেই শেষ। উঠে বসে দেখি আপনাদের যমদূত দু’টো খাটের মাথার কাছে বসে হটস্টারে ‘কফি উইথ করণ’ দেখছে। সেটা শেষ হওয়ার পর আমায় নিয়ে চলে এলো।”

ডিউটির সময় ‘কফি উইথ করণ’! যমরাজ আবার তেড়ে উঠতে গিয়ে সামলে নিলেন! বাইরের লোকের সামনে যমদূতদের গাফিলতি নিয়ে হইচই করা ঠিক নয়। তাছাড়া হইচই করেই বা লাভ কি! সবই তো সিন্ডিকেটের হাতে!

তিনি চিত্রগুপ্তকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হে গুপ্ত? আত্মহত্যার কেসটা কোত্থেকে আসছে? এতো নিতান্তই বিরিয়ানি-প্রেম!”

উৎস
“তাহলে শুনুন মহারাজ! রবিবার ভারতীয় এবং ইংরেজদের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচ ছিলো। সেই খেলায়, ভারত পরে ব্যাট করে ফ্লাডলাইটের আলোয় সাড়ে তিনশো রান তাড়া করবে জেনেও এই নরাধম বিরতির সময় বিরাট কোহলির শতরানের বিপক্ষে বাজি ধরেছিলো মহারাজ! এটা কি আত্মহত্যা নয়? আপনিই বলুন?”

“একশোবার!” রবি শাস্ত্রীর চেয়েও জোরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন যমরাজ। হুকুম দিলেন, “এই ব্যক্তির অপরাধ গুরুতর। তাই এর শাস্তি আগামী হাজার বছর ধরে নরকবাস। আর শুধু তাই নয়, এই ব্যক্তি যখনই ভারতের খেলা দেখতে বসবে, বিরাট কোহলি ব্যাটিং করতে নামলেই একে খেলা না দেখিয়ে বিনোদ কাম্বলির নাচ দেখানো হোক!”

নিবারণবাবুর ফ্যাঁচফ্যাঁচ বা কুঁইকুঁই কান্নাও যমরাজের মন গলাতে পারলো না। তাঁকে ঝটপট নরকে চালান করে যমরাজ নিজের মোবাইল বের করলেন। কালকের খেলার হাইলাইটসটা আর একবার না দেখা পাপ!

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই