Monday, March 6, 2017

মাশরুম -- তনুজিৎ

উৎস

ঘুম তখন ভাঙতে যাবে। খুব অল্প সময়ের জন্যে, তখনও আমি ঘুমের মধ্যে, মনে হলো কেউ খাটটা খুব জোরে নাড়াচ্ছে; আমি একটা খুব অদ্ভুত গোঙানির মত শব্দ করে জেগে উঠি, ধড়মড় করে। আচমকা খুব নড়ছে ঘরটা। প্রথম কয়েক মুহূর্তের জন্যে কিছু বুঝে উঠতে পারিনা যে কি হচ্ছে। অসময়ে ঘুম ভাঙলে আমার চোখ খুব জ্বলে আর জল বের হয়, দেখতে অসুবিধা হয়। বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে পা দিয়ে যখন দাঁড়াতে যাই তখন জোরালো ধাক্কার মতো পড়ে যাই। যখন প্রথম সাঁতার শিখেছিলাম, তখনো পায়ের তলায় যেরকম একটা অনুভূতি হয়েছিলো, যেটা ঠিক মাটির মতো নয়, সেরকম একটা ভূমিহীন অনুভূতি হলো। আমি কখনও ভুত দেখিনি, তবে মাঝেমাঝে যখন চেনা অন্ধকার কোনাটায় একটা অচেনা বস্তুর অবয়ব কয়েক মুহূর্তের জন্যে দেখি, তখন এক ধাক্কায় একটা ভয় আসে; মাথার ভিতর এক ধাক্কায় রক্ত আসে, গরম করে দেয়, বুকের ভিতর ধাক্কাটা খুব জোর শুরু হয়, হাত-পা বেশ অকেজো অসাড় হয়ে আসে। সেটাও কেটে যায়, যখন দেখি অচেনা বস্তুটা আসলে একটা চাদর বা অন্যকিছু। অল্প সময়ের জন্যে ওরকম একটা হঠাৎ ভয় এলো। কিছুক্ষণ মেঝেতে ওইভাবেই পড়ে রইলাম। আমি যে শহরে থাকি, সেখানে খুব বৃষ্টি হয়, আর দূষণটাও বেশি, তাই
আকাশটা রাতে প্রায়ই লাল থাকে, এখানকার পাহাড়ি মাটির মতোই। আমার চারতলার ঘরে যে দু’টো জানালা আছে, তাতে ঘরের আলো বন্ধ করলে রাতের আকাশের ওই লাল আভাটা বেশ ভালো করেই ঢুকতে পারে। কিন্তু আজ যেন লাল রঙটা অন্য রাতের চেয়ে বেশি মনে হলো। বিছানায় মাথার কাছে আমি মোবাইলটা রাখি প্রতিদিন, সকালে উঠে সময় দেখার জন্য। যখন একটু ধাতস্থ হতে পেরেছি ভূমিকম্পটার সাথে, তখন হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা তুলে নিই। ভোর সাড়ে চারটে - শুয়েছিলাম তিনটের দিকে, চোখ থেকে এখনও জল বেরিয়ে যাচ্ছে। মেঝের এই অনবরত কেঁপে ওঠার সাথে আস্তে আস্তে ধাতস্থ হচ্ছি। সিলিং থেকে ঝুরঝুর করে প্লাস্টার-অব্-প্যারিস ঝরে পড়ছে, ফ্যানের কাছে বড় বড় চারটে ফাটল ধরেছে, সিলিঙের কোনা অবধি গেছে। আমার ঘরটাও আবার চারতলায়। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বাইরে যেতে হবে। মেঝে থেকে তাড়াতাড়ি উঠলাম, ভয়েই অনেকটা হাঁপিয়ে গেছি। মেঝেতে একটা ব্যাগ পড়ে ছিলো, জরুরী কাগজপত্র আর সার্টিফিকেট রাখার তিনটে ফোল্ডার ছিলো আলমারিটায়, ওগুলো ভরে নিলাম, তারপর ল্যাপটপ, হার্ড ড্রাইভ, ক্যামেরা, চার্জর। একটা জিন্স আর জ্যাকেট পরে নিলাম; একটা বিছানার চাদর, কয়েকটা আণ্ডারওয়্যার, একটা জলের বোতল। সিলিংটার প্লাস্টার অনেকটাই খসে পড়েছে। মাথা-গা-হাত ধুলোয় ভরে গেছে। জুতোটা পরলাম, কিন্তু ফিতে বাঁধতে পারলাম না। ওই অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেছি - মেঝেতে একটা ক্র্যাক্। অদ্ভুত একটা ধাতব শব্দ হলো, আমি আবার পড়ে গেলাম। কিন্তু মেঝেটা পুরোপুরি ভেঙে নীচের তলায় পড়ে গেলাম না। পকেটে পার্সটা নিয়ে ছুটে ঘর থেকে বেরলাম, কিন্তু ঘরের দরজা আটকাতে পারলাম না। নীচ থেকে খুব চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার রো-তে কাউকেই দেখলাম না- সবাই বেরিয়ে গেছে আগেই। আমি হয়তো একটু দেরিই করে ফেলেছি। দৌড়ে খুব তাড়াতাড়ি নীচে নামছি। তিনতলায় তথাগত থাকে - জানিনা ও কি করছে - কিছুই মাথায় আসছে না তখন, ওকে কি ডাকবো? কিন্তু ও যদি ইতিমধ্যেই নীচে চলে গিয়ে থাকে? আমি নীচেই নামা শুরু করলাম আবার, নীচে গিয়ে ফোন করবো। অনেকেই নামছে, বিশাল হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে, অচেনা-রকম চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। এ সমস্ত চেনা মানুষকে আমি কখনও এত অচেনা হতে দেখিনি। সবার মুখে একটা অচেনা ভয়, অনেকে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যাচ্ছে। একতলার কাছে একটা ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে, গেটের কাছে বিশাল ভিড়। সবাই চিৎকার করছে, একে তাকে ডাকছে, অনেকে ভিড়টা ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু খুব বেশি কিছু ম্যানেজ হচ্ছে না। বেরোনোর গেটটা বেশ ছোট, খুব চাপাচাপি করে হয়তো পাঁচজন একসাথে বেরোতে পারে - এদিকে ভিড় জমেছে প্রায় হাজার জনের। আরও জমবে, আরও তাড়াতাড়ি। সবকিছু এতক্ষণ খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছিলো; আমি যখন প্রথম মোবাইলে সময় দেখি, তখন ঠিক ৪:৩২ বেজে ছিলো, এখন ৪:৪৫। ভেবে দেখলাম যে মাত্র তেরো মিনিটের মধ্যে আমি মেঝেতে পড়ে যাওয়া অবস্থা থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে প্রায় আশিটা সিঁড়ি নীচে নেমেছি আর এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
দরজা দিয়ে খুব আস্তে আস্তে ছেলেরা বেরোতে পারছে। আমাদের হোস্টেলের সামনে একটা ছোট গ্রাউন্ড আর তার ওপাশে আমাদের হোস্টেলের আরেকটা শাখা। অনুমান করা যায় যে সেখানেও একই অবস্থা। গ্রাউন্ড থেকে খুব চিৎকারের আওয়াজ আসছে, গ্রাউন্ড থেকে মূল রাস্তা দিয়ে সবাই বেরোচ্ছে - পুরো লিক্যুইফিকেশানের জন্যে সময় লাগছে। কেউ পড়ে যাচ্ছে, কেউ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, ভিড় জমছে আরও। আমরা যারা এখনও ভিতরে আটকে আছি, তারা গ্রাউন্ডটা দেখে বোঝার চেষ্টা করছি। জমাট একটা ভিড়, তেমন কিছু নড়ছে না। হোস্টেলের ভিতরে যে ফাঁকা জায়গাটা ছিলো - যেখানে অনেকে দাঁড়িয়েছিলো, ভেবেছিলো ভিড় কমলে বেরোবে - ওই ফাঁকা জায়গায় তেমন কিছু ভেঙে পড়ার মতো ছিলো বলে তাদের মনে হয়নি। আমরা একটা জোর শব্দ পেলাম, একটা কার্নিশ ভেঙে পড়েছে। নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ মনে হয় আহত হয়েছে। আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি তখন ভিড়ের ভিতরে অনেকটা ঢুকে গেছি। কয়েকটা চেনা চেনা মুখ চোখে পড়লো। কেউ তেমন কথা বলছে না, কেউ জানতে চাইছে না যে কি হয়েছে আসলে, সবাই এই মুহূর্তের জন্যে বাঁচতে চাইছে আর সবাই কেন যেন এটাই বিশ্বাস করে যে এই ভিড়ের মাথার ওপরের এই বিশাল ইমারতটা এবার ভেঙে পড়তে পারে। 

আর কোনো গেট নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে চাপে, নাকে দুম করে কার একটা হাত লাগে। নাকে লাগলে হঠাৎ ক’রে বেশ খানিকটা ব্যথা লাগে বলে আমি বেশ জোরে চিৎকার করে উঠলাম, কিন্তু দেখলাম যে তেমন কেউ তাকালো না। এমন কি আমার পাশের ছেলেগুলো কেমন অন্য দিকে তাকিয়ে। মনে হলো, হয়তো আমার আশেপাশেও অনেকেই এরকম চিৎকার করছে সাহায্যের জন্যে, আমিও তাদের কথা শুনতে পাচ্ছি না। চারদিক ঘুরে দেখলাম, তেমন কাউকে দেখতে পেলাম না। হয়তো আমি যেমন তাদের শুনতে পাচ্ছি না, তেমনই তাদের দেখতেও পাচ্ছি না। হয়তো ওই কার্নিশটা কারুর মাথায় পড়েছে আর মাথাটা প্রথমে ফেটে গেছে - যেভাবে একটা তরমুজ ফেটে যায়। তারপর কার্নিশটা মাধ্যাকর্ষণের টানে আরও নীচে নেমেছে - ছেলেটার শিরদাঁড়া বরাবর - আর এক একটা শিরদাঁড়ার হাড় আলগা হয়ে বেড়িয়ে এসেছে কার্তুজের মতো। ছেলেটা হাঁটু ভেঙে নীচে বসে পড়তে থাকে, কিন্তু তার আগেই কার্নিশটা মাটি ছোঁয় - ফলে পা-হাঁটু-কোমরের হাড়, সব একসাথে হামানদিস্তার মতো চাপে গুঁড়ো হয়ে যায়, লিভারটার ওপর একটা থান ইট এসে পড়ে আর সেটা একটা রক্তে ভেজা স্পঞ্জের মতো অনেকটা রক্ত ছিটকে বের করে দেয় চারদিকে। যারা এই সমগ্র ঘটনাটা দেখেছিলো তাদের অনেকের গায়ে টুকরো টুকরো হাড়-মাংস-রক্ত লেগে যায়।
ভিড়ের ভিতর থেকে বাইরের গ্রাউন্ডটা যতটা দেখা যায়, তাতে বোঝা যায় যে সবাই একটা লাল রঙের আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে খুব চিৎকার করছে। মনে হচ্ছে কাঠকয়লার আগুনের আঁচের মতো একটা রঙ, খুব উজ্জ্বল লাল নয়। তাপের মতো লাল, আলোর মতো না। খুব তাপ। ভীষণ তাপ লাগছে। এখনও আমরা ভিড়ের মধ্যে রয়েছি, সেখানে দাঁড়িয়ে আরও তাপ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে, মনে হচ্ছে মাথার ওপর হাজার-হাজার ইটের এই ইমারতটা ভেঙে পড়বে, মনে হচ্ছে পালিয়ে যাই, মনে হচ্ছে সবাইকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই। হঠাৎ একটু আলগা হলো দরজার একটা ধার, খুব তাড়াতাড়ি লিক্যুইফিকেশান শুরু হলো।

একদম মেইন-রোডের গাড়ি ঘোড়ার মধ্যে গিয়ে কোনো লাভ নেই। আমিও ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটা খুব স্রোত এলো, আমি সামলাতে পারলাম না। মনে হলো পিছনে আরেকটা কার্নিশ ভেঙে পড়লো, আমি স্রোতে মিশে গেলাম, লোকের চাপেই বেরিয়ে গেলাম দরজা দিয়ে, বেরোনোর সময় ব্যাগটা আটকে গেলো, তখন খেয়াল হলো যে অধিকাংশের কাছেই কোন ব্যাগ নেই। আমি নিজে বাইরে বেরিয়ে ব্যাগের ফিতে ধরে খুব জোরে টানলাম, যদি কোনোভাবে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এলো। একটা ফিতে ছিঁড়ে গেছে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা আখের ছিবড়ে, রস নিঙড়ানোর মেশিন থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে শরীরটা খুব খারাপ লাগলো। হড়হড় করে বমি করে ফেললাম, সামনে ভিড়ের মধ্যে। কারুর গায়ে, কারুর পায়ে লাগলো, কিন্তু কেউ ভ্রূক্ষেপ করলো না। আমি তখনও গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছাইনি। এর মধ্যে অনেকেই বমি করছে, বাইরে থেকে হোস্টেলের ভিতরকার কাঁপুনি বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে ভিতরে অনেকটা ভেঙে পড়েছে চোখের আড়ালে, মাটি থেকে বিশাল বড় বড় চিড় ধরে গেছে চারতলার ছাদ অবধি। এখনও একটাও ব্যালকনি ভাঙেনি। বমি করে মুখ ধোওয়া হয়নি, রুমাল দিয়ে মুছে নিলাম, মুখের ভিতরটা এখনও টক টক লাগছে - চারদিকে খুব বাজে গন্ধ। হয়তো টয়লেটের ট্যাঙ্কেও ফাটল ধরে গেছে। তাপের মতো লাল ভোর। সেরকম তাপের মতোই গরম। গ্রাউন্ডে পৌঁছাতে এখনও অনেকটা ভিড় ঠেলতে হবে। তবে এখানে ভিড়টা তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে। আকাশটা খুব লাল। বাজে একটা মেঘ - ধূসর, ঘন, কমলা আর অনেক নীচে। চেনা চেনা মুখ - অনেকের চোখে জল, ভয়, ভীষণ রকম একটা ভয়, সবার মুখ লাল। ৫:০৩।
গ্রাউন্ডে একটা ওপেনিং আছে, মাঝামাঝি জায়গায়। ওখানে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে, বলতে গেলে প্রায় সবাই। দরজা থেকে হুলস্থূল করে বেরিয়ে ওই ওপেনিং-এর কাছে এসে পুরো ভিড়টা জমছে। সবাই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে। হোস্টেলের ভিতরে যেরকম চিৎকার, দ্রুতি আর তোড়জোড় - বাইরে সব তুলনামূলক শান্ত আর গতিহীন, বিশেষ করে ওই ওপেনিং-টার কাছে। সবাই দাঁড়িয়ে কি দেখছে? বোঝা যাচ্ছে না। একটা রেড জায়েন্ট এলো নাকি মহাকাশে? নাকি বিশাল একটা উল্কা পড়েছে! আমি যতক্ষণে ওখানে পৌঁছেছি ততক্ষণ খেয়াল ক’রে দেখা হয়নি, কিন্তু ভূমিকম্প থেমে গেছে। তবে তাপটা অনেক বেশি মনে হয়। কেমন একটা ভেপে উঠছে সব। আমিও আকাশের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। সবাই থমকে গেছে। কেউ নড়তে পারছে না। কেউ মানতে পারছে না দৃশ্যটা। কিন্তু সবাই জানে যে ওটা কি। আমার চোখে আবার সমস্যাটা শুরু হলো। জল ঝরতে লাগলো, খুব জ্বলছে। আশেপাশের অনেকে এমনি তাকিয়ে আছে, চোখ দিয়ে জল ঝরছে, কিন্তু বোঝা যায় যে সেটা কান্না, ঠিক কম ঘুমের জন্য বা ধুলো ঢুকে যাওয়ার কারণে না। যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রায় সবারই ঠোঁট কাঁপছে, যেন একটা চিৎকার বের হতে চাইছে কিন্তু বেরোচ্ছে না - একটা হতাশার মতো ফোঁপানি শোনা যাচ্ছে।
আমি একবার গোয়েচা-লা ট্রেক-এ গেছিলাম, জংরি থেকে যখন থান্সিং যাচ্ছিলাম, তখন অনেক দূরে অনেক উঁচু এক পর্বত দেখি। পর্বতের মাথা তখনও মেঘে ঢাকা, অনেক নীচে খাতে জলের একটা রেখা কেবল বোঝা যাচ্ছিলো, আর দূরের পর্বতগুলো এত বড় মনে হচ্ছিলো, যে দেখে মনে শ্রদ্ধা হচ্ছিলো। নিজেকে একটা ক্ষুদ্র নশ্বর বিন্দু মনে হচ্ছিলো। আমাদের যে গাইড ছিলো, সে একটু অপেক্ষা করতে বললো। আমরাও হেঁটেছিলাম অনেকটা, তাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। মিনিট দশেক পরে ওই বিশাল উঁচু পর্বতশ্রেণীর মাথা থেকে মেঘ সরতে লাগলো, আর যে সমস্ত পর্বত দেখে আমার শ্রদ্ধা এসেছিলো কিছুক্ষণ আগে, তারও অনে-এ-এ-এক উঁচু থেকে একটা বিশাল, অতিকায় চূড়া উঁকি দিলো। কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমি কয়েক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম এত বড়, এত অতিকায় একটা কিছু দেখে। এখন আমার চোখের সামনে তার চেয়েও বড় একটা কিছু। অস্বাভাবিক। অতিকায়। কিন্তু বোঝা যায় যে অনেক দূরে আছে ওটা। 

উৎস
মেঘ মেঘ। ধুলো ধুলো। আগুন আগুন। আকাশে উঠে গেছে। উজ্জ্বল কমলা লাল তাপ। একটা কমলা রঙের মাশরুম মেঘ।

আশ-পাশের সব কাচ ভেঙে গেছে। আশ-পাশের সব দেওয়ালে ফাটল। আশ-পাশের সব গাছ অহেতুক তাপে নেতিয়ে গেছে। আশেপাশে সকলের চোখে ভয় আর জল। সব ভিড় থমকে গেছে, দাঁড়িয়ে দেখছে - ধুলো-মেঘের মতো একটা আস্ত সভ্যতা জ্বলে-পুড়ে-ক্ষয়ে-উড়ে-মিশে যাচ্ছে মেঘে, মিশে যাচ্ছে মহাকাশে, তাপ আর রেডিয়েশন হয়ে। নীরবে বজ্রপাত হচ্ছে অনেক-অনেক দূরে কোথাও, ওই মাশরুম বরাবর তা আকাশ থেকে মাটিতে নামছে, অজস্র, একটার পর একটা। যেন মেঘ বৃষ্টির কারখানা। শুনেছি এরপর বৃষ্টিও নামে, কালো। এখনও নামেনি যদিও। চারদিকে চিৎকার হচ্ছে, কিন্তু গ্রাউন্ডে যারা আছে - যারা দেখেছে কি হয়েছে, তারা চুপ আছে। আমি জানিনা কি করবো। এখনও যখন মরিনি তখন মনে হচ্ছে অনেক দূরে পড়েছে বোমটা, কার কি উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, কে বোম ফেলেছে, কোন রাজনৈতিক দল এর জন্যে দায়ী - কিছু জানি না। মোবাইল চেক করলাম, টাওয়ার নেই। অনেকে কানে ফোন নিয়ে হ্যালো হ্যালো করছে কিন্তু মনে হলো না কারুর কাছেই কোন সদুত্তর রয়েছে। এখনও কেউ দায়িত্ব নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেনি ‘প্যানিক করবেন না কেউ’। আমাকে একটা কিছু করতে হবে। হয় পালাতে হবে এখান থেকে, না হয় অন্যকিছু। কিন্তু এখান থেকে পালিয়ে কোথায় যাবো? বাড়ি এখান থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে, প্লেন বা ট্রেনের আশা এই মুহূর্তের জন্যে ছাড়ছি। এয়ারপোর্ট অনেক দূরে, ক্যাম্পাসের বাইরের অবস্থা এমনিই ক্যাম্পাসের ভিতরের থেকে খারাপ থাকে। বাইরে ভূমিকম্পে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। বাইরে এই মুহূর্তে না বেরনোই ঠিক হবে। মনে হল চেনা জানা কাউকে খোঁজার চেষ্টা করি। তথাগত বা সুমিত। একটু উঁচু কোথাও দাঁড়াতে হবে। একটু দূরে বেশ কিছুটা উঁচু একটা বেদি করা আছে। ওখানে অনেকে দাঁড়িয়ে আছে একই উদ্দেশ্যে। আমিও দাঁড়ালাম। ওখানে দাঁড়িয়ে আমার চারতলার ঘরটা দেখা যায়। ব্যালকনিটার মাঝখান বরাবর একটা বিশাল ফাটল মাটি থেকে ছাদ অবধি গেছে - ব্যালকনিটা ওই ফাটল বরাবর বেঁকে ঝুলে আছে নীচের দিকে। নীচে কেউ নেই তবে খুব ভিড়, যখন তখন যে কেউ নীচে চলে যেতে পারে। দরজার ভিড়টা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। তবে মনে হয় এখনও অনেকে বের হচ্ছে। আজ রাতে আমি বাইকটা বেসমেন্টের গ্যারেজে রেখেছি। কিন্তু এখন ওখান থেকে বাইকটা আনতে গেলে বেশ অনেকটা ভিড় ঠেলে যেতে হবে, তাও আবার প্রতিকূলে। বাইকটা নিয়ে বেরোনোর সময়ও বেশ কিছুটা রাস্তা যেতে হবে বেসমেন্টের মধ্যে দিয়ে। এখন ওই সমস্ত রাস্তার অবস্থা জানিনা কি রকম তবে মনে হয় খুব ভালো অবস্থায় নেই। বাইকটা এভাবে বিসর্জন দিয়ে দেবো? খুব দ্বিধায় পড়লাম। আমি ভাবছি, আর তথাগত আর সুমিতকে খুঁজছি। একবার মনে হলো, যাই, একটা চান্স নিয়েই দেখি। অনেক কষ্টে একটা বাইক কিনেছি। অনেক দূর থেকে মনে হলো অনেকে চিৎকার করছে একসাথে; যেন এগিয়ে আসছে একটা কিছু। গমগম শব্দ হচ্ছে। মনে হলো দূরে তথাগতকে দেখলাম। আমি নামার চেষ্টা করলাম বেদি থেকে। হঠাৎ কে যেন জোর ধাক্কা দিলো। বিশাল জোরে। ছিটকে পড়লাম উপর থেকে। যাদের ঘাড়ে-মাথায় গিয়ে পড়লাম, তারাও সবাই উল্টে ছিটকে পড়লো মাটিতে। থুতনিতে জোর ধাক্কা লেগেছে। কেটে গেছে। হাত দিয়ে দেখলাম রক্ত। বেশ জোরে লেগেছে। কোন সাড় নেই। অবশ। হাতটাও ছড়ে গেছে। যাদের গায়ে গিয়ে পড়েছি, তারা অনেকেই হয়তো রেগে গেছে। ভীষণ চিৎকার করছে সবাই। সবাই প্যানিক করছে। সবাই ছুটতে শুরু করেছে। এতক্ষণ অনেকে দাঁড়িয়ে কমলা মাশরুম দেখছিলো। সেই ভিড়টাও দিগ্বিদিক ছোটা শুরু করেছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়েছি যেই, অমনি আরেকটা জোরালো ধাক্কা এসে লাগলো। মাটিটা যেন হঠাৎ করে উঁচু হয়ে গেলো বেশ কিছুটা। ভীষণ জোরে একটা গড়মড় করে শব্দ হলো। একটু পাথুরে, একটু ধাতব। কান ফেটে যায় প্রায়। ভুশ্ করে হোস্টেলটা যেন গেঁথে গেল মাটিতে। বেসমেন্টটা চলে গেছে পুরোপুরি। হোস্টেলটার অবস্থাও ভালো না। আমি ততক্ষণে দৌড়ে বেশ কিছুটা পিছিয়ে এসেছি। এখনও গাছ ভেঙে পড়েনি। ছেলেরা সবাই যে যেদিকে পারছে, ছুটছে। তথাগত বা সুমিত কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। ভীষণ ধুলো বেরোচ্ছে এখন, বাড়িটা একবার ধসে পড়লে বিশাল বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে চোখের সামনে। এতগুলো মানুষ রক্তে চোবান স্পঞ্জের মত চিপসে যাবে ইট লোহার নীচে। বাইকটা গেছে। আর আশা নেই। ৫:৩০।
আজ মনে হয় সারাদিন এরকমই তাপের মতো লাল হয়ে থাকবে আলো। সবই কেমন ধুলো ধুলো, লাল লাল, আলো লাল, ছায়া লাল। ধুলোর মধ্যে তাকাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। পকেট থেকে রুমালটা বের করে নাকে মুখে বেঁধে নিলাম। চশমাটা ঘরে ফেলে এসেছি। ভীষণ একা লাগছে। খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এই তো রাতেই একটা কি সুন্দর সিনেমা দেখলাম। কাল সকালে একটা মিটিং ছিলো। ভাবলাম কম ঘুমিয়ে, সকালে ব্রেকফাস্ট করে সোজা মিটিং-টা সেরে আসবো। কাল রাতে একটা বার্গার খেলাম, চিকেন লেগ পিস আর অনেক ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। আমি, তথাগত আর সায়ন্তন কি একটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তিনজনে দু’টো বাইক নিয়ে বেরিয়েছিলাম। সব কেমন কয়েক ঘণ্টায় বদলে গেলো! আশ-পাশের কাউকে চিনতে পারছি না। কেউই হয়তো কাউকে চিনতে পারছে না। সব কেমন হতাশ মনে হলো। মিথ্যে মনে হলো। আমি দাঁড়িয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলাম হতাশায়। খুব দুঃখ হলো। খুব একা লাগলো। বাড়ির লোকজন কেমন আছে জানি না। তাদের সাথে হয়তো আর কোনোদিন দেখাই হবে না।

একটা সভ্যতা, পুরো প্রজন্মের পর প্রজন্ম, ধ্বংস হয়ে গেলো এক মুহূর্তে। ছাই হয়ে গেলো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। শূন্যের মতো একটা বোধ এলো। যেন সব অর্থহীন, যেন সব নশ্বর, যেন সব ক্ষুদ্র হয়ে গেছি। আমি জানি যে এরপর কি হবে। এরপর বহুদিন এখানে কোন ত্রাণ এসে পৌঁছবে না, সে সুযোগ নেই। মাশরুমের এত কাছাকাছি আসতে মানুষের সময় লাগবে। ততদিনে আমি আর আমার মতো অনেকেই তাদের এই চেনা জায়গাটা থেকে বেরোবে না কারণ আমরা সবাই ধরে নিয়েছি আমরা একটা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি তাই এখানেই কাটিয়ে দেবো বাকি সূর্যহীন দিনগুলো আর আকাশ থেকে ঝরে পড়বে কালো কালো অ্যাসিড ফোঁটা যাতে সাদা ধোঁয়া হয়ে পুড়ে লবণ হয়ে যাবে যাবতীয় ক্ষার আর মৃত্তিকার আদিম সঞ্চয়। অন্তত লক্ষ মৃত মানুষের-কুকুরের-মাছের শরীর পেট্রল হয়ে চলে যাবে আউস্উইতস্-এর মতো একটা পাতালে। টিন ড্রামের ঘণ্টা কোথায় যেন ডিডিং ডিডিং করে বাজছে! এরপর রেডিয়াম প্লুটোনিয়ামের রোগ আসে খাদ্য-জলহীন-অ্যাসিড পোড়া শরীরে। এর পরের কয়েক ঘণ্টায় আমরা হয়তো কয়েকজন মিলেমিশে ভাঙ্গা ইমারতের ইট-রড-কংক্রিট সরিয়ে খুঁজবো চেনা-অচেনা মানুষের ক্ষত বিক্ষত দেহ - ধুলোয় ধূসর আর চাপ-চাপ রক্তের কোলাজে একটা জোকারের মতো দেখতে, তারপর তাদের এক জায়গায় এনে আমরা হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখবো যে হাসপাতাল বলে আশেপাশে কিছু নেই, আর না আছে শবদাহ করার জায়গা। তাই দেহগুলো একটা প্রত্যন্ত গহ্বরে ফেলে রেখে আসা হবে। কয়েকটা কুকুর তাদের খিদে সামলাতে ততক্ষণে হায়নার মতো মৃতদেহে মুখ চুবিয়ে হৃৎপিণ্ড ফুসফুস আর পাঁজর খেয়ে মুখ লাল করে ফেলেছে - রাতে ওদের চোখ নিথর মোমবাতির মত জ্বলে জ্যান্ত মানুষ দেখে - আমাদেরও খিদে পায়, তৃষ্ণা পায় কিন্তু কিছু জোগাড় হয়ে ওঠে না। আশেপাশের দোকানে লুঠ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমরা তখন মড়া সরাতে ব্যস্ত ছিলাম। এর পর আর কেউ একসাথে থাকে না। খাবার ভাগ করে খেতে হয় বলে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মরদেহ ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয় বলে অনেক মতবিরোধ হয়। চাল-ডাল যা কাঁচা আনাজ জোগাড় করা গেছিলো, তাই নিয়েও ঝামেলা হয় ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে গিয়ে, শেষমেশ চুরি হয়ে যায়। আমি ততক্ষণে আমার ব্যাগটা ফেলে দিয়েছি। ওসবের আর দরকার নেই। শরীর থেকে শুধু রক্ত বের হয়। বমি-মল-মূত্র সবই রক্ত। খাদ্য জল সব আকাশে উড়ে গেছে। পুড়ে গেছে শস্য, খামার। বাতাসে-মাটিতে-আকাশে শুধু রক্ত।
খাটের ওপর একটা পৃষ্ঠা রেখে, যে পৃষ্ঠায় হয়তো দু’টো কবিতার লাইন লেখা ছিলো, প্রবল যক্ষ্মায় প্রথম রক্ত বমি করলেন জন্ কিটস্, পাশে রাখা প্রদীপের আলোয় সে রক্ত ভালো করে দেখে নিয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েন ২৫ বছরের কবি, সেই রক্তে তিনি তাঁর মৃত্যুর কথা দেখতে পান।

আজ থেকে আমাদের ছুটি। একশো কোটি মানুষের ছুটি। একশো বছর পরে কেউ বেঁচে থাকলে এই দিনটা তাদের ছুটির দিন হবে। একটা বাচ্চাও সেদিন স্কুলে যাবে না। একটাও রাস্তায় গাড়ি চলবে না বলে কয়েকটা ছেলে ক্রিকেট খেলবে। দু’জন বন্ধু সাইকেল নিয়ে ঘুরতে যাবে একটা ধানক্ষেত। একজন ছুটির দিনে বৃষ্টি ভিজবে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই