Monday, April 24, 2017

ছায়াচ্ছন্ন -- কৃষ্ণাঞ্জন


শিয়ালদহ থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক। স্টেশনের নাম মথুরাপুর। সেখান থেকে অটো ধরে খটিরবাজার। তারপর ভ্যান-রিকশোতে সাতঘড়া গ্রামের তালপুকুর। আমার ছোট পিসির বাড়ি। গত পুজোয় একাদশীর দিন গিয়েছিলাম, প্রায় অনেক বছর পরে। না, আমাকে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরতে হয় না। আমার বাড়ি মথুরাপুরের তিনটি স্টেশন আগে। দক্ষিণ বারাশত। কিন্তু এই তালপুকুর গ্রামের অনেকে সেটাকেই শহর ভাবে।

দুপুর নাগাদ খটিরবাজারে পৌঁছে ভ্যানে চেপেছি। ইট বিছানো রাস্তা। রাস্তার পাশে ঘন বাঁশবন, ‘সবুজ হলুদ সর পড়া পুকুর’ ঝিম মেরে আছে। ছোটবেলায় মা-বাবার সাথে বেশ ঘটা করে আসতাম, রাস্তাগুলো সব আবছা মনে পড়ছে। অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে ফেরার মতো লাগছে। যেতে যেতে একটা কুমোর-পাড়া পড়ে, রোদে দেওয়া মাটির কলসি, মিষ্টির ভাঁড়। খুব মনোযোগ দিয়ে ছোটবেলায় এগুলো বানানো দেখতাম - বন বন করে চাকা ঘুরছে আর এক বুড়ো নিপুণ হাতে একটা কলসি বানিয়ে ফেলছে। একটা বড় মুসলিম-পাড়ার পরেই রাস্তার বাঁক, বাঁক পেরিয়ে ভ্যানটাকে দাঁড়াতে বললাম। পিসি দাঁড়িয়ে, পিসির ছেলেরা দাঁড়িয়ে, প্রতিবেশী আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে। ভ্যান থেকে নামতেই অর্ধেক-চেনা মুখে হাসি এক মহিলার- “কতো বড়ো হয়ে গেছিস বাবা... আমায় চিনতে পারিস?” কিছু বলার আগেই পিসির ছেলেরা এসে পড়লো। ওরাও বড়ো হয়ে গেছে। প্রায় হাত ধরে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। আগে মাটির বাড়ি ছিলো। দাদা চাকরি পেয়ে পাকা বানিয়ে নিয়েছে, ইলেক্ট্রিসিটিও এসেছে। প্লেট-ভর্তি খাবার সাজিয়ে নিয়ে এলো বৌদি, পিসি মাটির উনুনে রান্নায় ব্যস্ত, দেশি মোরগের ঝোল খাব আগেই বলে রেখেছিলাম।

কোনওমতে লুচিগুলো খেয়ে হাঁটতে বেরলাম সেজো ছেলেটির সাথে। অদ্ভুত ভাবে এই ভেতরের রাস্তাগুলোও মনে আছে আমার। মাটির রাস্তা, চারদিকে ঘন সবুজ গাছপালা, নিশ্চিন্দিপুরের থেকে একেবারেই আলাদা করা যায়না। হঠাৎ রাস্তা শেষ, বিশাল ধান-জমি। দাঁড়িয়ে পড়লাম ওখানেই। এটা-ওটা গল্পের মধ্যেই পাশের মুসলিম-পাড়ার কথা উঠলো, কারণ বাইরে তখন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। মুসলিম-পাড়ার সবাই নাকি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমর্থক।



গল্প এগিয়ে চলছে এদিক ওদিক। গ্রামের কাকে ভুতে ধরেছিল ক’দিন আগেই, গরমকালে ওরা সবাই রাত্রে ওই বাদায় বসে থাকে, লক্ষ্মী পুজো হবে বাড়িতে, আসাম কেমন জায়গা (এতক্ষণ বলা হয়নি, আমি গুয়াহাটিতে থাকি) ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশেই একটা মন্দির, লৌকিক দেব-দেবীর, প্রতিবছর ঘটা করে পুজো হয়। মন্দিরের ঠিক সামনের ছোট্ট জমিটায় দাঁড়িয়ে আছি দু’জন। ভীষণ শান্ত চারদিক। একটা বিশাল কিন্তু নিরীহ দাঁড়াশ সাপের দেখা মিললো। সাপটা দেখে পিসির ছেলে এক মজার গল্প শোনাল-

কয়েকমাস আগে গ্রামের একটি ছেলেকে একটি বিশাল কেউটে সাপে কাটে। সাপটি তারপর একটা তালগাছের নীচের গর্তে ঢুকে পড়ে। একদল লোক ছেলেটিকে প্রথমে গুনিনের কাছে ও পরে হাসপাতালে নিয়ে যায়। গ্রামের বাকিরা, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ওই তালগাছের চারদিকে জড়ো হয়। যারা একটু ভিতু, তারা খানিক দূরে পুকুর পাড়ে কিংবা আরেকটু দূরের কোনও বাড়ির দাওয়ায়, আর যারা সাহসী, তারা গাছটিকে ঘিরে প্রায় একটি চক্রব্যূহ তৈরি করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাপটির দেখা মেলেনা, কিন্তু কেউ জায়গা ছেড়ে নড়েনা। সবার বেশ ‘সাপের একদিন, কি আমার একদিন’ মনোভাব। নিজের ও প্রতিবেশী, উভয় রাষ্ট্রের সমর্থকেরা তখন মিলেমিশে সাপটিকে নিকেশ করার সমর্থক। অবশেষে প্রায় সন্ধের কাছাকাছি সাপটি গর্ত থেকে বেরনোর স্পর্ধা দেখায় এবং তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। সবাই প্রায় উৎসবের মেজাজে যে যার বাড়ি ফেরে। এসবের মধ্যে, যে ছেলেটিকে সাপে কেটেছিল, তার কথা মোটামুটি সবাই ভুলে যায়। পরদিন জানা যায় ছেলেটি এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে। 

পিসির রান্না হয়ে গেছে। আশ মিটিয়ে মোরগ খাওয়ার পর আরও খানিক গল্প। রোদ পড়ে আসছে। আমার আরেক জায়গায় যাওয়ার কথা, তাই বেরিয়ে পড়লাম। পিসির ছেলেরাই ভ্যান ডেকে দিলো, আবার সেই প্রতিবেশীর দল, “আবার আসিস বাবা... এবার একবার মাকে সঙ্গে নিয়ে আসিস...”। ভ্যান এগোতে থাকে বাইরের দিকে। মাটির কলসি, মিষ্টির ভাঁড় একই ভাবে রাস্তার পাশে সার দিয়ে রাখা, বাঁশবন প্রায় অন্ধকার, পুকুরের উপর হাল্কা হিম জমেছে। অল্প হলেও গলার কাছটা ভারী ভারী লাগছে... মথুরাপুর স্টেশন পৌঁছে গেলাম। ট্রেন এলো, উঠে বসলাম, দক্ষিণ বারাশত পেরিয়ে গেলো। ঘণ্টা খানেক পর নিউ গড়িয়া, মেট্রো, রবীন্দ্রসদন, অ্যাকাডেমি। বন্ধুরা দাঁড়িয়ে - নাটক দেখবো সবাই মিলে। মাটির ভাঁড়ে চা, সিগারেট, সামনে একদল ছেলেমেয়ে, একজন বমি করছে, টাটকা বিয়ারের গন্ধ। আরও লোকজন, গাড়ি, আলো দিয়ে সাজানো রাস্তা, পুজোর রেশ।

নাটক শেষ। অনেক রাতের ট্রেনে আবার বাড়ি ফেরা। জানালার পাশেই জায়গা পেয়ে গেলাম। ট্রেন ছুটছে আর জানালার বাইরে দৃশ্য আসছে একের পর এক-

তালগাছটাকে ঘিরে সারা গ্রাম জড়ো হয়েছে। 
একটা বাচ্চা ছেলে এক বুড়োকে নিপুণ হাতে মাটির কলসি বানাতে দেখছে। 
অনেক বছর আগের কথা- এক দম্পতি তাদের দুই ছেলেকে নিয়ে ভ্যান-রিকশোয় চেপেছে। ছেলে দুটো ছোট পিসির বাড়ি যাচ্ছে... বাঁশবন, সর পড়া পুকুর... 

“ছায়াচ্ছন্ন গ্রাম, ছায়াচ্ছন্ন বাড়ি, ছায়াচ্ছন্ন বয়স... জঙ্গলের মাথায় ভর দুপুর, জঙ্গলের ভিতর বিকেল, ছায়াচ্ছন্ন জঙ্গল, ছায়াচ্ছন্ন বাঁশঝাড়, ছায়াচ্ছন্ন বয়স...”



About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই