Wednesday, May 24, 2017

বসন্ত পঞ্চম -- শ্রীমন্তী


তুমি বলেছিলে, তোমার সবচেয়ে প্রিয় রাগ বসন্ত পঞ্চম। পরে জেনেছিলাম তোমার সব আসরে প্রিয়তম রাগ বলে সরোদে বাজাও ইমনকল্যাণ। বলেছিলে, প্রিয় কবি শক্তি চাটুজ্যে। অথচ তোমার বাড়িতে বইয়ের তাক দখল করে আছে সার সার সুনীল গাঙ্গুলির কবিতাগুচ্ছ। বলেছিলে, আমার গান শুনে নাকি প্রথম পছন্দ হয়েছিলো আমায় – বিয়ের পর একদিনও এক কলি শুনতে চাওনি। একদিন তুমুল ঝগড়ার শেষে মিটমাট হয়ে গেলে আদর করে তোমার নাম দিয়েছিলাম 'উলটপুরাণ'।
তুমি শুনে শুধু সংক্ষেপে বলেছিলে, "আদিখ্যেতা"। তোমার কথার তুমি আর আসল তুমির মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসি - এই বুঝতে বুঝতেই পনেরোটা বছর কেটে গেলো আমার। তোমার দেশি বিদেশী বহু অনুরাগিণীর ফ্যান মেল পড়তে পড়তে আমার হিংসে হলে বলতে পজেসিভনেস তোমার একদম পোষায় না। অথচ কুশলের সাথে আমি কোনোদিন বেরোলেই তোমার চোখে মুখে যেটা ফুটে উঠতো, সেটা পজেসিভনেস ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি আমার। এই নিয়ে কথা কাটাকাটিও কম হয়নি আমাদের। ওর সাথে আমার যে ভাইফোঁটার সম্পর্ক, সেটা কোনোদিনই বুঝতে চাইলে না তুমি। সব ভালোবাসার সম্পর্ক যে এক গণ্ডিতে বাঁধা যায় না, এটা তোমার সুরের ভাষাও তোমায় শেখাতে পারল না। বিয়ের আগে বলতে সরোদে আমার জন্য তৈরি করবে নতুন একটা রাগ, যেটা কেউ কখনো শোনেনি আগে। বলা বাহুল্য, শুধু আমার জন্য তোমার সরোদটা একদিনও বাজেনি। একদিন বাজানোর জন্য খুব আবদার করলে বলেছিলে, সুন্দরী মুগ্ধ শ্রোতার অভাব নেই তোমার - বরং অভাব একজন দক্ষ ম্যানেজারের। ব্যাস, এক রাতের মধ্যে আমার ভূমিকা-বদল হয়ে গেলো তোমার ওই একটুকরো কথায়। ফ্যান মেলের লেখিকা বিয়ের পর হয়ে গেলো তার উত্তরদাতা।

ইদানীং তুমি বড্ড দূরে সরে যাচ্ছিলে আমার থেকে। রোজই রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হতো, আমরা দুটো ভাসমান হিমশৈলের মতো শুধু ঠেকে আছি পাশাপাশি। পরশুদিন রাতে যখন হঠাৎ অনুভব করলাম তোমার শরীর ঘন হয়ে আসছে আমার খুব কাছে, তখন নিজেকে দেখে বুঝতে পারছিলাম আমাদের মধ্যে জমে আছে এক যুগের অভিমানের পাহাড়। ইচ্ছে করেই হয়তো সেই পাহাড়টা ডিঙোতে চাইনি আমি - যদিও তুমি অভিমান ভাঙানোর কম চেষ্টা করনি। তবে প্রতিবারের মতোই যেটা বলতে চাও তার উল্টোটা বলে ফেলেছিলে - একগাদা তেতো কথা কাটাকাটিতে রাতের ঘুমটাই কেটে গেছিলো আমার। পরেরদিন ভোরে পাশে শোয়া তোমার মুখের দিকে হঠাৎ চোখ চলে যাওয়ায় দেখেছিলাম চোখের কোলে কয়েকফোঁটা জল। আজ সকালে শ্মশানে তোমার মুখটা দেখে হঠাৎ মনে হলো কতদিন পর ঘুমোতে দেখলাম তোমায়! মনে পড়ছিলো বিয়ের ঠিক পরপর এক রাতের কথা.... আমার কিছুতেই ঘুম আসছিলো না, সারারাত তোমার মাথার কাছে বসে দেখেছিলাম তোমায়। কখনো তোমার চোখ একটু কুঁচকে যাচ্ছিল, কখনো ঠোঁটে ফুটে উঠছিলো হালকা হাসি, আবার কখনো ভাঁজ পড়ছিলো কপালে। আজও ঠিক সেদিনের মতো টানটান হয়ে শুয়েছিলে হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে, শুধু মুখের ওই অভিব্যক্তিগুলো ছিলো না। আজ দেখলাম শোকস্তব্ধ তোমার অনুরাগীরা ভিড় করে এসেছে শ্মশানে তোমায় শেষ দেখা দেখতে... সবার মুখেই শুধু তোমার হঠাৎ চলে যাওয়ার কথা, সবার চোখে জল। আমার কিন্তু একটুও কান্না পায়নি, জানো! সারাদিন শুধু একের পর এক স্মৃতি ভেসে আসছিলো মনে সেলুলয়েডের দৃশ্যের মতো... খুব কম দৃশ্যেই অবশ্য ছিলাম শুধু আমরা দু’জন। সারাজীবন তোমার অসংখ্য অনুরাগীর সাথে ভাগ করে নিতে নিতে তোমায় একলা পাওয়ার অভ্যেসটা যে কখন পেছনে ফেলে এসেছি, নিজেও বুঝতে পারিনি। তাই আজ সবাইকে তোমার জন্য কাঁদতে দেখে আলাদা করে কিছু মনে হয়নি আমার... কেবল আমার কান্নাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছিলো। একবার মজা করে বলেছিলে, তুমি মারা যাওয়ার পর স্মরণসভায় যখন তোমার মাস্টারপিস ইমনকল্যাণ বাজানো হবে, তখন নাকি আমি প্রথম কাঁদবো। আজ সন্ধ্যেয় নজরুল মঞ্চের সভায় যখন চোখে জল আসলো প্রথমবার, তখন এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো, এই বুঝি প্রথম আমার উলটপূরাণের কোনো কথা সত্যি হলো। কিন্তু পরের মুহূর্তেই ভুলটা বুঝতে পেরে পাশে বসে থাকা বিশিষ্ট সাংবাদিককে বেশ চমকে দিয়ে হেসে ফেললাম একটু.... সারা অডিটোরিয়ামে তখন গমগম করে বাজছে সরোদে তোমার বসন্ত পঞ্চমের সুর।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই