Wednesday, June 14, 2017

ক্র্যাকপট বা পাগলা জগাই -- অনির্বাণ কুণ্ডু

    
   ক্র্যাকপটের বাংলা করা মুশকিল। আমার নিজের পছন্দ পাগলা জগাই। অর্থাৎ সোজা কথায়, কিঞ্চিৎ ছিটেল। এঁদের দেখা সর্বত্র পাওয়া যায়। আমার কাছে বেশি আসেন বৈজ্ঞানিক ক্র্যাকপটরা, নিজেদের তত্ত্ব শোনাবার জন্যে। এটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর অকুপেশনাল হ্যাজার্ড। এঁদের কথা বিশ্বাস করলে, কয়েক শতাব্দীতে যত জিনিয়াসের আবির্ভাব হবার কথা, আমি এই কয়েক বছরে তার চেয়ে বেশি জিনিয়াস দেখে ফেলেছি।

       পাগলা জগাই বিভিন্ন রকমের আছেন। কেউ খুব গোবেচারা নিরীহ টাইপ, কেউ জেদি, কেউ কিঞ্চিৎ উগ্র, কেউ বিশ্বসংসারের ওপর বেজায় খাপ্পা। এঁদের একমাত্র মিল হলো এঁরা সকলেই কিছু নতুন তত্ত্ব বা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, যার ফলে বিজ্ঞানের বাজারচলতি ধ্যানধারণা সব বদলে যাওয়া উচিত। মুশকিল হলো কেউ এঁদের পাত্তা দিচ্ছে না, ভাগ্য ভালো হলে বাড়িতে বউ ছেলেমেয়ে একটু মন দিয়ে শোনে আর ভাবে, আহা ইনি কি প্রতিভাবান, আর ভাগ্য ভালো না হলে পাড়ার চায়ের দোকানদার বা বাজারের মাছওয়ালাকে শোনাতে হয়, কেউ কেউ সামনে বা পেছনে আওয়াজও খান। তাই এঁরা আরেকটু পড়াশোনা করা লোকজনের কাছ থেকে স্বীকৃতির আশায় ঘোরেন।

       বাঙালির স্বাভাবিক দুর্বলতা নিষ্ফলের এবং হতাশের দলে থাকাদের দিকে, তাই এই পর্যন্ত পড়েই কেউ কেউ বলে উঠবেন, তার মানে কি প্রচলিত তত্ত্বকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, গুরুবাক্য বলে মেনে নিতে হবে? আর মেনে নিলে কি বিজ্ঞান এগোবে?

নতুন চিন্তাভাবনা করলে বিদ্রূপ বা বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়, তার উদাহরণ কি কম পড়িয়াছে? তাহলে, আর এগোনোর আগে এখানে একটা কথা বলে নেওয়া উচিত। বিজ্ঞান কোনো গুরুবাদ নয় যে চলতি তত্ত্বকে প্রশ্ন করা যাবে না, বা করলে গর্দান যাবে। যত বড়ো বিজ্ঞানীই হোন না কেন, কড়া থেকে আরো কড়া পরীক্ষার মুখে পড়তেই হবে, সমকাল এবং ভবিষ্যৎকালের বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলবেন, দরকার হলে তত্ত্বের সংশোধন করবেন, বা পুরো বাতিলও করে দিতে পারেন। এইভাবেই বিজ্ঞান এগোয়। অনেক বিজ্ঞানীর তত্ত্ব সমকালে প্রায় কেউই মেনে নেননি – যেমন ওয়েজেনারের প্লেট টেকটোনিক্স, অর্থাৎ পৃথিবীর পিঠ অনেকগুলো চলমান প্লেট দিয়ে তৈরি – কিন্তু পরে তা স্বীকৃত হয়েছে। গ্যালিলিও বা ডারউইনকে চার্চের বিরোধিতা সহ্য করতে হয়েছে, এখনো আমেরিকার বিরাট সংখ্যক মানুষ ডারউইনের তত্ত্ব মানেন না, বাইবেলের বিরোধী বলে। আপাতভাবে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সংশোধনের চেষ্টাও চলে। মূল কথাটা এক রেখেও ডারউইনের তত্ত্বও তো কত সংশোধনের মধ্যে দিয়ে গেছে। নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের কিছু সংশোধন (আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি নয়) মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে দরকার হতে পারে কি না -- যাকে modified Newtonian dynamics বা MOND বলে – তা নিয়েও অনেকে চিন্তাভাবনা করছেন। এঁরা ক্র্যাকপট নন। কেন নন, সেটা বুঝতে গেলে বিজ্ঞানের মূল ধর্মটা ভালো করে বুঝতে হবে।

       বিজ্ঞানের কাজ হলো প্রকৃতিকে জানা। সেটা শুধু ঘরে বসে মস্তিষ্ক সঞ্চালন করে হয় না। তার জন্যে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হয়। অথবা যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, তাদের সঙ্গে পরিচিত থাকতে হয়। তার ফলে, কোনো বক্তব্য ঠিক না ভুল, সে ব্যাপারে বিজ্ঞান বেশির ভাগ সময়েই সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারে; পরীক্ষার সঙ্গে মিললে ঠিক, না হলে ভুল। ইলেকট্রন প্রোটনের চেয়ে হালকা না ভারি, এ প্রশ্নের একটাই উত্তর হয়। এখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের তফাৎ -- চার্বাক দর্শন ঠিক না শঙ্কর দর্শন, এ প্রশ্নের কোনো জবাব হয় না, যার যেটা ভালো লাগে। ইতিহাস চর্চা এই দুটোর মাঝখানে পড়ে, কারণ ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর তথ্যের বিচার নির্ভর করে। কলকাতার দাঙ্গা কত সালে হয়েছিলো, সে নিয়ে সবাই একমত, কিন্তু তাতে হিন্দু ও মুসলমানের সমান দায়িত্ব ছিলো কি না, তা নিয়ে একেবারেই নন।

       তাহলে, মূল কথাটা হলো পরীক্ষা। মিললে পাশ, না মিললে ফেল। আপনি যদি কোনো নতুন তত্ত্ব বের করতে চান, প্রথমেই দেখতে হবে যে এখনো পর্যন্ত হওয়া সব পরীক্ষায় আপনার তত্ত্ব পাশ করতে পারলো কি না। না পারলে তত্ত্ব সংশোধন করুন, ভুলত্রুটি কোথায় আছে খুঁজে বের করুন, আর সংশোধনের অতীত হলে তত্ত্ব ফেলে দিন। প্রকৃত বিজ্ঞানীরা নিজেদের তত্ত্বকে সবসময় প্রশ্ন করেন, কোথাও বিচ্যুতি আছে কি না দেখেন, এবং সংশোধন সম্ভব না হলে ফেলে দেবার আগে দু'বার ভাবেন না। ক্র্যাকপটরা ঠিক উলটো কাজ করে থাকেন। নিজেদের তত্ত্বের ওপর এঁদের এতই বিশ্বাস, যে কোনো সমালোচনা তো সহ্য করেনই না, পরীক্ষার মধ্যেও যান না, কারণ গেলেই তো তত্ত্বের উদ্ভটত্ব প্রমাণ হয়ে যাবে। একটু পরেই উদাহরণ দেবো। তার আগে ক্র্যাকপট বা ক্র্যাঙ্ক সম্বন্ধে নেচার পত্রিকায় দেওয়া সংজ্ঞাটা আর একবার বলে নেওয়া যাক: A crank is defined as a man who cannot be turned (এখনকার দিন হলে person লিখতে হতো, কিন্তু ১৯০৬ সালে man বললে সব মানুষকেই বোঝাতো)।

       শুধু পরীক্ষা পাশ করলেই হলো না। যে তত্ত্বকে আপনি বাতিল করতে চাইছেন, তার চেয়ে আপনার তত্ত্ব কেন উৎকৃষ্ট সেটাও বোঝাতে হবে। অর্থাৎ এমন কোনো পরীক্ষালব্ধ ফল ব্যাখ্যা করতে হবে, যা বাজারচলতি তত্ত্বে ভালো করে ব্যাখ্যা করা যায় না। এখানে মধ্যযুগের ইংরেজ দার্শনিক উইলিয়াম অফ অকহ্যামের (আপনি যদি উমবের্তো একোর নেম অফ রোজ পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই এঁর নামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে) একটা খুব ভালো নিয়ম আছে যা বিজ্ঞানীরা মেনে চলেন, তার নাম Ockham’s বা Occam’s razor। মোদ্দা নিয়মটা হলো, একই জিনিস ব্যাখ্যা করার জন্যে একাধিক তত্ত্ব থাকলে সবসময় সবচেয়ে সহজ তত্ত্বটা গ্রহণ করতে হবে। যদি তাতে কাজ না হয়, তাহলে আরো জটিল তত্ত্বে যেতে হবে, কিন্তু তা না হলে অহেতুক জীবন জটিল করে লাভ নেই। এটাও বেশির ভাগ ক্র্যাকপটের মগজে ঢোকে না।

       উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুলজীবনে কলকাতার বিখ্যাত ক্র্যাকপট ছিলেন কে সি পাল। বিভিন্ন বাড়ির বা ফ্লাইওভারের গায়ে এঁর সদর্প বাণী লেখা থাকতো – সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। ইনি নাকি গড়িয়াহাটের ফুটপাথে থাকতেন এবং এই সব লিখে বেড়াতেন। একটা পুস্তিকাও ছিলো – তাতে নানা রকম যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা ছিলো কেন তিনি টলেমির আধুনিক অবতার। একবার আমাদের কিছু বন্ধু এঁর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো, জাস্ট মজা করার জন্যে, কিন্তু তাতে ওই পুস্তিকা একটা লাভ হয়েছিলো। একটা যুক্তি এখনো মনে আছে। পৃথিবী যদি একটা নির্দিষ্ট দিকে ঘুরতো, তাহলে সমস্ত তাল বা নারকেল গাছ একই দিকে হেলে পড়তো, ঘোরার উলটো দিকে। কিন্তু তা তো আর হয় না, অতএব প্রমাণ হলো পৃথিবী ঘোরে না। পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্যে আকাশে নক্ষত্রদের আপাত অবস্থান ছ’মাস পর একটু পালটে যায়, একে প্যারালাক্স বলে। কে সি পাল বলতেন, এই সব পর্যবেক্ষণ ভুল। এটাও ক্র্যাকপটদের একটা চেনা কৌশল – যা তত্ত্বের সঙ্গে মিলবে না, তাকে ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া। তথ্যের সঙ্গে তত্ত্বকে মেলাতে হয়, জোর করে তথ্যকে বাঁকিয়ে তত্ত্বের খাপে ঢোকাতে গেলেই বিপদ, এটা শার্লক হোমসও বলতেন।

       ক্র্যাকপটরা আমার আপনার মতো বিজ্ঞানীদের পাত্তা দেন না। ছোটখাটো বিজ্ঞানীদের ভুল তো হবেই, তা ধরে তো আর অমর হওয়া যাবে না, টেক্সট বইয়ে নামও উঠবে না। এঁরা মারি তো গণ্ডার নীতিতে বিশ্বাস করেন – ভুল ধরতে হলে একেবারে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন এঁদের ভুল ধরাই ভালো, আর একটু বেশি নাম জানলে ডিরাক বা হাইসেনবার্গ। (তার মানে এই নয় যে এই সব বিজ্ঞানীদের কখনো কোনো ভুল হয়নি। নিশ্চয়ই হয়েছে। সে সব ভুলত্রুটি যে কোনো বিজ্ঞানীরই হয়ে থাকে। কিন্তু তার সংশোধনও বহুদিন হয়েছে, সবাই তা জানেনও। ওখানে নতুন করে খাপ খোলা খুব বুদ্ধিমানের পরিচয় না। যেখানে দেবদূতেরাও পা ফেলতে ভয় পায় ইত্যাদি।) ক্র্যাকপট চেনার এটা একটা ভালো উপায় – কাকে ধরে টান মারছেন সেটা দেখুন।

       টান মারার মধ্যে বেশির ভাগ ক্র্যাকপটের প্রথম পছন্দ আইনস্টাইন – সে তো হবেই, একশো বছর ধরে এই মানুষটির নাম ফিজিক্সের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গেছে। তিনটে জিনিসের ওপর নজর বেশি – প্রথম হলো বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ বা স্পেশাল রিলেটিভিটি, দ্বিতীয় মহাকর্ষ তত্ত্ব বা জেনারেল রিলেটিভিটি, অ্যার তৃতীয় একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্ব বা ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরিস্পেশাল রিলেটিভিটির ওপর অত্যাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে, কারণ অনেকের ধারণা একবিন্দু ফিজিক্স না পড়েও ওই জিনিসটার মূলকথা খবরের কাগজ থেকেই জেনে নেওয়া যায়। আর E=mc2 তো সকলেই জানে। বাহরাম কাটিরাইয়ের মতো কেউ কেউ মনে করেন স্পেশাল রিলেটিভিটি পুরোটাই জোচ্চুরি, ইথার আছে এবং থাকবে, আইনস্টাইন জোর করে অসৎভাবে ইথারের অস্তিত্ব চেপে দিয়েছেন, ভালো করে পরীক্ষা করলেই সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। আবার জন নর্ডবার্গের মতো কেউ কেউ মনে করেন ওই তত্ত্বের মধ্যে লজিকাল ফ্যালাসি আছে, বরং এঁদের নতুন তত্ত্বে সেই সব ফ্যালাসি দূর করে দেওয়া গেছে। কেউ আইনস্টাইনের চেয়েও অনেক সোজা উপায়ে স্পেশাল রিলেটিভিটির মূল সূত্রগুলোকে প্রমাণ করতে চান। সব লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। উৎসাহীরা ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখতে পারেন। তবে হাসি থামাতে না পারলে আমার দোষ নয়। জেনারেল রিলেটিভিটি নিয়ে টানাটানি তুলনায় একটু কম কারণ অঙ্কটা শক্ত। তাও কেউ কেউ মনে করেন পুরো তত্ত্বটাই ধাপ্পা। তৃতীয় জিনিসটা, অর্থাৎ ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি, সেটা আইনস্টাইন প্রমাণ করতে পারেননি, সুতরাং ওখানে কিছু করতে পারলে অমরত্ব গ্যারান্টেড, কাজেই জগাইদের নজরও বেশি। তবে ওটা সাধারণ জগাইদের কর্ম নয়, একটু অঙ্ক শিখতে হয়। এইরকম একজন বড়ো জগাই হলেন মায়রন ইভান্স, এঁর কথা পরে বলবো।

       তত্ত্ব নিয়ে যে সব ক্র্যাকপটরা অত মাথা ঘামান না, তাঁরা নানা রকম উদ্ভট আবিষ্কারের নেশায় মেতে থাকেন। অতীতে এঁরা অ্যালকেমির চর্চা করতেন, কমদামি ধাতু থেকে সোনা বানাবার চেষ্টা বা অমরত্বের ওষুধ আবিষ্কার। এঁদের অবদান বিজ্ঞানের ইতিহাসে একেবারে শূন্য বলা যায় না, কারণ আধুনিক কেমিস্ট্রি এঁদের হাতেই জন্ম নিয়েছিলো। এমনকি স্বয়ং নিউটন সাহেবও অ্যালকেমি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। আজকাল এঁদের প্রথম পছন্দ অনন্ত গতিযন্ত্র বা perpetual motion machine, যাতে বাইরে থেকে কোনো শক্তির জোগান না দিলেও কাজ পাওয়া যায়। এটা যে বাস্তবে করা যায় না, বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী মাত্রেই জানেন। জগাইরা জানেন না, বা জানলেও মানতে চান না – প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে এঁদের বানানো যন্ত্রে মুফতে কাজ পাওয়া যায়। সমস্ত প্ল্যানিংএর মধ্যেই কোনো একটা জায়গায় গোলমালটা লুকিয়ে থাকে।

       আমরা যারা ফিজিক্স নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করি, আমাদের মাঝে মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান পত্রিকা বা জার্নালে প্রবন্ধ ছাপাতে হয়। কিন্তু পত্রিকায় ছাপতে দেবার আগে আমাদের সহকর্মী বন্ধুরা কি ভাবছেন, সেটা জানাও দরকার। অনেক সময় এই বন্ধুরা কোনো ভুল থাকলে ধরিয়ে দেন, বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের উল্লেখ বাদ পড়লে জানান। তাই অনলাইনে এই প্রবন্ধগুলো জমা করার একটা জায়গা আছে, তার ঠিকানা হলো http://arxiv.org – সংক্ষেপে আর্কাইভ। প্রতিদিন এখানে ফিজিক্সের বিভিন্ন বিষয়ের অনেক প্রবন্ধ জমা পড়ে, উৎসাহীরা বিনা খরচে ডাউনলোড করে পড়তে পারেন। ক্র্যাকপটদের প্রবন্ধ জমা করারও এরকম একটা জায়গা আছে, arxiv এর ঠিক উলটো, বোধ হয় প্রচলিত বিজ্ঞানের বিরোধী বলেই – তার ঠিকানা vixra.org। ক্র্যাকপট থেকে নানা রকম উদ্ভট অর্থহীন কাজ এখানে জমা পড়ে। আজকাল বাজারে কিছু পত্রিকা এসেছে যারা টাকা নিয়ে প্রবন্ধ ছাপে, প্রবন্ধের গুণমান যাই হোক না কেন, সেই সব জার্নালে হয়তো ছাপাও হয়। সাধু সাবধান।

       কোনো প্রবন্ধ এইরকম জগাইদের কলম থেকে বেরোলো কিনা কি করে বুঝবেন? এর জন্যে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইডের অধ্যাপক জন বাইজ প্রায় ২৫ বছর আগে ক্র্যাকপট ইন্ডেক্স বলে একটা তালিকা বের করেছিলেন। প্রায় সবরকম পাগলামি এর মধ্যে পড়ে, তাই বাইজের তালিকাটা একটু বলি – বিস্তৃত তালিকা পেতে হলে ইন্টারনেটে Crackpot Index সার্চ করুন। (ক্র্যাকপট বিষয়ে আর একটি বিখ্যাত পেজ হলো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জেরার্ড এট হুফটের “How to be a bad physicist” – এটাও খুঁজে দেখতে পারেন, এট হুফট আরো নির্মম এবং স্পষ্টবাদী।)

১। আপনি শুরু করবেন ৫ পয়েন্ট নিয়ে। শেষ পর্যন্ত যদি নেগেটিভ পয়েন্টে থাকেন, তাহলে আপনি ক্র্যাকপট নন।
২। প্রতিটি সর্বজনস্বীকৃত ভুল বক্তব্য ঠিক বলে চালালে ১ পয়েন্ট। যেমন, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে।
৩। প্রতিটি শূন্যগর্ভ বক্তব্যের জন্যে ২ পয়েন্ট। যেমন, অক্সিজেন জ্বলন সহায়ক কারণ তা কোনো জিনিসকে জ্বলতে সাহায্য করে।
৪। প্রতিটি লজিক্যালি ভুল বক্তব্যের জন্যে ৩ পয়েন্ট। রবীন্দ্রনাথ ও রামছাগলের দাড়ি বিষয়ক কথার মতো। আরেকটা ভালো উদাহরণ হলো উনিশ শতকের জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি যা ক্র্যাকপটেরা কথায় কথায় কোট করেনঃ যে কোনো মহৎ সত্য তিনটে ধাপের মধ্য দিয়ে যায়, প্রথমে বিদ্রূপ, তারপর তীব্র বিরোধিতা, শেষে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেওয়া। এই উক্তিটাকে সত্যি বলে মেনে নিলেও – বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা সবসময় সত্যি নয়, গ্যালিলিও, নিউটন, ডারউইন বা আইনস্টাইন কাউকেই বিদ্রূপের মুখে পড়তে হয়নি – তার মানে এই নয় যে যা কিছু বিদ্রূপের মুখে পড়ে তার সবই মহৎ সত্য।
৫। লোকে সংশোধন করে দেবার পরেও ভুল বক্তব্য আঁকড়ে থাকলে ৫ পয়েন্ট, প্রতিটি বক্তব্যের জন্যে। কোনো কাল্পনিক পরীক্ষা বাস্তব পরীক্ষার উলটো ফল দিলেও সেই কাল্পনিক পরীক্ষা ব্যবহার করলে আরো ৫। কোনো শব্দ পুরো বড়ো হাতের হরফে লিখলে প্রতি শব্দের জন্যে ৫ (এটা অসভ্যতা বলে গণ্য)।
৬। আইনস্টাইন, হকিং বা ফাইনম্যানের নামের বানান ভুল করে Einstien, Hawkins বা Feynmann লিখলে আরো ৫। (এক বাংলার শিক্ষকের কথা মনে পড়লো, যিনি বলেছিলেন খাতায় রবিন্দ্রনাথ, মধুসুধন বা বিদ্দাসাগর দেখলে খাতা আর না দেখেই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। আমি অবশ্য খাতায় নিলস বোর সাহেবের বানান Bore পেয়েছি – সেটা মনে হয় ছাত্রের মানসিক অবস্থার জন্যে।)
৭। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে ভুল বললে ১০ পয়েন্ট। নিজের বিদ্যার বর্ণনা দিলে (যেমন কোথায় পড়েছেন ইত্যাদি) আরো ১০। কতদিন ধরে এই তত্ত্বের পেছনে আপনি লেগে আছেন, তা উল্লেখ করলেও ১০।
৮। অচেনা লোকজনকে ইমেল বা চিঠি লিখে বিরক্ত করলে ১০। (কেউ কেউ আবার অনুরোধ করেন অন্য কাউকে এই মেলের কথা না বলতে, পাছে দুষ্টু লোকেরা অসাধারণ গবেষণাটি ঝেড়ে দেয়।) আপনার তত্ত্বের ভুল প্রমাণ করলে পুরস্কার দেবেন, এমন ঘোষণা করলেও ১০।
এইরকম আরো চলবে, আর কয়েকটা মাত্র বলবো।
৯। আইনস্টাইনকে ধরে টানাটানি করলেই ১০। বিশেষ করে স্পেশাল বা জেনারাল রিলেটিভিটি হলে তো বটেই। নিউটনের বলবিদ্যার সূত্র তিনটেকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করলে একেবারে ২০।
১০। নিজেই নিজেকে নোবেল প্রাইজের ক্যান্ডিডেট বললে ২০ পয়েন্ট।
১১। পুরাণ, নানা রকম মিথ, বা কল্পবিজ্ঞানকে সত্যি বলে চালাবার চেষ্টা করলেও ২০। এ ব্যাপারে প্রাচীন ভারতে বিমান নিয়ে (এবং আরো অনেক জিনিস যা নাকি সবই ব্যাদে আছে, না থাকলে মুসলমানেরা লোপ করে দিয়েছে) আধুনিক গবেষণার কথা ভাবুন।
১২। নিজের নামেই নিজের তত্ত্বের বা সমীকরণের নাম দিলে ২০। এটাও অসভ্যতা বলে গণ্য। বিজ্ঞানীরা নিজেদের নাম জড়িয়ে আছে এমন সমীকরণ বা তত্ত্বের উল্লেখ করতে হলেও অন্যভাবে ঘুরিয়ে করেন, ভদ্রতার খাতিরে। আপনার নাম হরিদাস পাল, আর আপনি একখানা সমীকরণ লিখে তার নাম দিলেন পাল সমীকরণ, তাহলে আপনার ২০ পয়েন্ট কেউ ঠেকাতে পারবে না, সমীকরণটা ঠিক ভুল যাই হোক না কেন।
১৩। নিজে নিজের পিঠ চাপড়ালে ২০, প্রতিপক্ষকে গালি দিলেও ২০। বিশেষ করে, কায়েমি স্বার্থের গোলাম, প্রতিক্রিয়াশীল বা বুর্জোয়া বিজ্ঞানী, প্রতিপক্ষকে এরকম কথা বললে তো ২০ বটেই, প্রতিবারের জন্যে।
১৪। আপনি আইনস্টাইনের অধরা স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছেন, এরকম কথা পেপারে থাকলেই ৩০।
১৫। বাকি সবাই ষড়যন্ত্র করে আপনার তত্ত্ব বা আবিষ্কার চেপে দেবার চেষ্টা করছে, এরকম দাবি করলে একেবারে ৪০ পয়েন্ট। নিজেকে ব্রুনোর মতো শহীদ বা গ্যালিলিওর মতো অত্যাচারিত দাবি করলেও আরো ৪০। (এই দ্বিতীয়টা বিদেশি জগাইদের জন্যে, দিশি জগাইরা এসব করেন না।)
১৬। সবার শেষে, আপনি যদি দাবি করেন আপনার তত্ত্ব বৈপ্লবিক, প্রচলিত বিজ্ঞানের সব ধ্যানধারণা চুরমার করে দেবে, কিন্তু কিভাবে পরীক্ষা করে দেখা যাবে তার কোনো উপায় বলতে পারবেন না, তাহলে এক স্ট্রোকেই পুরো ৫০। এবার সব যোগ করে দেখুন কত হলো, অর্থাৎ আপনি কোন শ্রেণীর জগাই। অনেকটা পুরোনো কলকাতার গাঁজা টানিয়ে পক্ষীদের সঙ্গে মিল আছে না?



*** 

       গত শতাব্দীর শেষ দিকে ক্র্যাকপট সম্রাট ছিলেন মায়রন ইভান্স। ইনি আইনস্টাইনের স্বপ্ন ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরি বা একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্ব প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। নিজে একটি তত্ত্ব বানিয়েছিলেন যা একইসঙ্গে জেনারেল রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর তড়িৎচুম্বকীয় তত্ত্বকে মেলায়, আর নিজেই এর নাম দিয়েছিলেন আইনস্টাইন-কার্তান-ইভান্স বা ECE থিওরি (নিজের তত্ত্বে নিজের নাম ঢোকানো – বাইজের ইনডেক্স দেখুন)। এই থিওরির কি কি নতুন দিক, প্রচলিত বিজ্ঞানকে কিভাবে এই থিওরি উপড়ে ফেলে দেয়, সব ব্যাখ্যা করে ইনি প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখলেন, বইও লিখলেন। মুশকিল হলো থিওরিটা আগাগোড়াই ভুল, যাকে বলে একদম বিসমিল্লায় গলদ। তার ফলে অন্য বিজ্ঞানীরা আর ইভান্সকে পাত্তা দিলেন না, কিন্তু পাগলা জগাইয়ের লড়াই কে কবে থামায়? ইনি নিজেই ওয়েলসে একটি ইউনিভার্সিটি বানালেন, তার নাম দিলেন মায়রন ইভান্স ইউনিভার্সিটি, নিজেই তার প্রেসিডেন্ট, আর সব মিলিয়ে মোট সাতজন লোক। এই ইউনিভার্সিটির একমাত্র কাজই হলো ওই থিওরির চর্চা করা। ওয়েলশ সরকার অবিলম্বে এই ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দিলেন, কিন্তু ইভান্স অদম্য। এখন তিনি আমেরিকায় একটি গবেষণাকেন্দ্র খুলেছেন, তার নাম আলফা ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, প্রিন্সটনের অনুকরণে আর কি। আমেরিকার সুবিধে হলো বাকস্বাধীনতার নামে যে যা ইচ্ছে বলে যেতে পারে, আর সবারই কিছু অনুগামী জুটে যায় – ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন। এখন কেউ আর ইভান্সের প্রবন্ধ ছাপে না, তাই ইন্টারনেটই ভরসা। ইভান্সের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসন বর্তমানে দখল করেছেন হাঙ্গেরির গাবোর ফেকেটে। ইনি আরো উচ্চস্তরের জগাই। ইনি ইন্টারনেটে নিজের তত্ত্ব প্রচার করতে ভালোবাসেন। ইউরোপ জুড়ে এঁর কিছু বন্ধুবান্ধব আছেন, অথবা ইনি নিজেই ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে অন্যদের নামে মেল করেন। এই সব বন্ধুদের কেউ কেউ মাঝেমধ্যে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মেল পাঠান (এই অধমও পেয়েছে এবং পত্রপাঠ স্প্যাম ফোল্ডারে পাঠিয়ে দিয়েছে)। চিঠির বক্তব্য, পৃথিবী জুড়ে বিজ্ঞানের নামে জোচ্চুরি চলছে, আর সবাই চোখ বুজে সেটাকেই বিজ্ঞান বলে মেনে নিচ্ছে, কারণ এতে সবার কায়েমি স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কিছু কিছু জোচ্চোর নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়ে গেছে। এদের এতো টাকা পাবার কোনো অধিকারই নেই, কারণ এরা আপাদমস্তক জোচ্চোর। উদাহরণও হাতের কাছেই মজুত। যেমন গাইম আর নভোসেলভ, গ্রাফিন আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পেয়েছিলেন। ফেকেটের বক্তব্য, গ্রাফিন তো গ্রাফাইটের একটা মাত্র স্তর, তাহলে তা দিয়ে কিভাবে ট্রানজিস্টর তৈরি হবে, যেখানে গাইম-নভোসেলভ গ্রাফিন ট্রানজিস্টরের কথা বলেছেন? সবাই জানে গ্রাফাইট তড়িতের সুপরিবাহী, আর ট্রানজিস্টর কেবলমাত্র সিলিকনের মতো অর্ধপরিবাহী দিয়েই তৈরি হয়। সুতরাং এঁরা ধাপ্পা দিয়েছেন। আরো আছে। সম্প্রতি কাজিতা ম্যাকডোনাল্ড নামে দুই বিজ্ঞানী নিউট্রিনো বলে এক রকম ভুতুড়ে কণার কিছু ধর্ম আবিষ্কারের জন্যে নোবেল পেয়েছেন। নিউট্রিনোকে ধরা খুব শক্ত। সাধারণ পদার্থের মধ্যে দিয়ে সে বহুদূর চলে যেতে পারে। মোটামুটি একটা হিসেব হলো যে একটা নিউট্রিনোকে থামাতে গেলে প্রায় এক আলোকবর্ষ পরিমাণ সিসের মধ্যে দিয়ে পাঠাতে হবে – এক আলোকবর্ষ হলো এক বছরে আলো যতটা রাস্তা পাড়ি দেয়। ফেকেটের বক্তব্য, অত সিসে তো আর কারো কাছে থাকতে পারে না, কাজেই কাজিতা ও ম্যাকডোনাল্ড পুরোটাই মিথ্যে বলে ও ধাপ্পা মেরে নোবেল হাতিয়েছেন। (তাহলে আমরা নিউট্রিনো ধরি কি করে? এর উত্তর হলো মানুষের গড় আয়ু ৭৫ বছর হলে শিশুমৃত্যু কেন হয়? পুরোটাই গড়ের ব্যাপার, খুব অল্প সংখ্যক কিছু নিউট্রিনো এক চৌবাচ্চা জলের মধ্যেও আটকে যেতে পারে।) এতসব বুঝলে আর জগাই বলবো কেন? মোদ্দা কথা হলো, নোবেল আমার পাওয়ার কথা, অন্যেরা জোচ্চুরি করে মেরে নিয়েছে, এর প্রতিকার চাই, তাই ইনি এবং এঁর সমর্থকরা নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে মামলা করতেও উস্কানি দেন।

       আমাদের দেশেও জগাইদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আমি নিজেই তো কত দেখে ফেললাম। তবে এঁরা পাশ্চাত্য জগাইদের তুলনায় কিঞ্চিৎ নিরেস। বেশির ভাগই অন্য পেশার মানুষ, যেমন ব্যাঙ্কের কেরানি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, বা বাংলার মাস্টার। অনেকে আবার রিটায়ার্ডও। এককালে হয়তো বিজ্ঞান ভালো লাগতো, তাই অবসরজীবনে দাগ রেখে যাবার ইচ্ছে হয়েছে। আইনস্টাইন যথারীতি এঁদের প্রথম টার্গেট। একজন যেমন এই দাবি নিয়ে এসেছিলেন যে স্পেশাল রিলেটিভিটির সমীকরণগুলো আসলে পিথাগোরাসের উপপাদ্য একটু ঘুরিয়ে লেখা ছাড়া অ্যার কিছু নয়। একজন বলতে চেয়েছিলেন যে স্পেশাল রিলেটিভিটি ভুল কারণ গতির সঙ্গে ঘড়ি আস্তে চললে সময় মাপতেই গোলমাল হয়ে যাবে, পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনরা তো গতিশীল, আর তাদের বর্ণালী থেকেই তো আমরা অ্যাটমিক ক্লক বানাই সময় মাপার জন্যে। আরেকজন বললেন তিনি নিউটনের সূত্র ভুল প্রমাণ করেছেন, কারণ বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগ না করলেও পরমাণুর ইলেকট্রন নিজে নিজেই ওপরের শক্তিস্তর থেকে নিচের শক্তিস্তরে নেমে আসে আর আলো বিকিরণ করে। এরকম আরো আছে। দুর্গাপুরের এক ভদ্রলোক পুরো বই লিখে ফেলেছিলেন একখানা, নিজের উদ্ভট তত্ত্বের ওপর। আবার হার্ডকভার ছাপিয়ে আমাদের সবাইকে দু’কপি করে দান করেছিলেন। এঁদের উৎসাহ দেখার মতো। কিছুদিন আগে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন, অনেক বড়ো বড়ো চার্ট নিয়ে, ইনি কোপার্নিকাসের থিওরি ভুল প্রমাণ করেছেন, আধা কোপার্নিকাস আর আধা টলেমি মার্কা এক বিচিত্র খিচুড়ি বানিয়েছেন। অনেক কষ্ট করে বুঝলাম ইনি কিছুতেই গ্রহদের উপবৃত্তাকার পথে ঘোরা মানতে পারেন না, এঁর ধারণা পৃথিবী বৃত্তাকার পথে না ঘুরলে ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প এইসব সারাক্ষণই লেগে থাকবে।

       আমি জানি আপনি এরকম জগাই নন, কিন্তু কোনো জগাইকে চিনলে এবং আক্রমণের শিকার হলে, এইটুকু অন্তত বলবেন যে বড়ো বড়ো বিজ্ঞানীরা কিন্তু আসলে বেশ স্মার্ট লোক, তাঁরা এতো সহজ ভুল করবেন এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। আরো বলবেন যে তালিম বস্তুটি গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেট খেলতে গেলেও লাগে, সেতার বাজাতে গেলেও, আর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স করতে গেলে আরো অনেক বেশি লাগে। ওটা ছাড়া মাঠে নেমে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাতেও কাজ না হলে বাইজের লিস্টটা ধরিয়ে দিতে পারেন। একদিক থেকে দেখলে আমরা সকলেই জগাই, একটু নাম হোক এ আর কে না চায়? আমাদের জগাইরা কেন নিউটন বা আইনস্টাইনকে মূর্খ বা জোচ্চোর ভাবেন সেটা হয়তো মনস্তাত্ত্বিকরা ভালো বলতে পারবেন। শুধু খ্যাতির মোহ থাকতে পারে, সারাজীবন অন্যদের থেকে অবহেলিত হবার ক্ষোভও থাকতে পারে, এমনকি প্যারানয়েড হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। এট হুফটের কথা ধার করে বলা যায়ঃ পূর্বসূরীরা সবাই বোকা, এটা ভাবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করলে ভালো হয়।

জগাইদের নিয়ে আর কথা বাড়াবো না, কিন্তু এঁদের বাইরে আরো তিন শ্রেণীর লোক আছেন যাঁদের জগাই বললে জগাইরা অপমানিত হবেন। তাঁরা একটু পৃথক উল্লেখের দাবি রাখেন। এঁরা হলেন: 

১) কাকদন্তগবেষক – এঁরা সম্পূর্ণ অর্থহীন গবেষণা করেন, কাকের কতগুলো দাঁত আছে তা নিয়ে চর্চা করার মতো (ঋণ: পরশুরাম)। এঁদের জন্যে Ig Nobel বলে একটা প্রাইজ আছে, পরে কখনো তা নিয়ে লিখবো। যেমন সম্প্রতি দেখলাম চার আলজিরিয়ান একখানা পেপার লিখেছেন, আল্লার নাম নিয়ে বা না নিয়ে মুরগি কাটলে কি তফাৎ হতে পারে তাই নিয়ে – কাটা মুরগিগুলো কার পেটে গেলো সেটা অবশ্য খুঁজে পাইনি। জগাইরা এরকম তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না।

২) ধান্দাবাজ – কোল্ড ফিউশনের কথা মনে আছে? সেই যে পন্স আর ফ্লিশমানের ঐতিহাসিক ধাপ্পা। এঁরা দাবি করেছিলেন ল্যাবরেটরিতে সাধারণ উষ্ণতায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ফিউশন ঘটাতে পেরেছেন, যেটা স্বাভাবিক বুদ্ধিতে অসম্ভব। তখন এই দাবিতে বেশ হইহই পড়েছিলো, লোকে মনে করতে শুরু করেছিলো বিজ্ঞান যুক্তির বদলে ম্যাজিক দিয়ে হয়, আর তেল গরম পেলে লুচি ভেজে নেওয়া ধান্দাবাজদের স্বভাব। আমাদের দেশেও বেশ কিছু লোক কোল্ড ফিউশন দেখতে পেয়েছেন বলে হাওয়া তুললেন, কি পরীক্ষা করে কিভাবে পেয়েছিলেন সে তাঁরাই জানেন। জোচ্চুরি ধরা পড়ার পর এঁরাই আবার আমারো ছিলো মনে বলে আওয়াজ ওঠালেন। আরেক ধরনের ধান্দাবাজ আছেন যারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেকনজর পেতে মুখিয়ে থাকেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে লাইসেঙ্কোর কেলেঙ্কারি এইরকম এক ধান্দাবাজি। আমাদের দেশে যে সব লোক দাবি করেন, রামায়ণের সময় এরোপ্লেন ছিলো আর তা মহাকাশেও যেতে পারতো, বা ব্যাক গিয়ার দিতে পারতো, তাঁরাও একই দলে পড়েন।

৩) পণ্ডিতমূর্খ – এঁরা নিজেদের বিষয়ে পণ্ডিত কিন্তু বিজ্ঞানের একবর্ণ না জেনে কথা বলে ফেলেন, আর না জেনে মুখ খোলার আরেক নামই মূর্খতা। আসলে আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ না পড়লে লোকে অশিক্ষিত বলে কিন্তু নিউটন বা ডারউইনের নাম না শুনলেও শিক্ষিত সমাজে কল্কে পাওয়া আটকায় না। আমাদের এক শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই একটা গল্প বলেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে একটা সেমিনার শুনতে গেছেন, সমাজতত্ত্বের এক তথাকথিত পণ্ডিত বক্তৃতা করতে উঠে বললেন – বিজ্ঞানের সূত্রের সত্যতা দেশ কাল সমাজের ওপরেও নির্ভর করে, যেমন ইউরোপে বসে আইনস্টাইন লিখেছিলেন E = mc2, ওখানের পরিস্থিতিতে ওটাই সত্য, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় বসে লিখলে হয়তো লিখতেন E=mc3, আর সেটাই সত্যি হতো। দ্বিতীয়টা যে কেন সত্যি হতে পারে না তা জগাইরাও বোঝেন, তাঁরা সরল হতে পারেন কিন্তু মূর্খ তো নন!

ক্র্যাকপট নিয়ে আরেকটু জানতে চাইলে এই সব ওয়েবসাইট দেখতে পারেন:

 
http://math.ucr.edu/home/baez/crackpot.html
http://www.physics.smu.edu/scalise/www/misc/crackpot/
http://www.staff.science.uu.nl/~hooft101/theoristbad.html




অনির্বাণ কুণ্ডু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, স্বনামধন্য কণা-পদার্থবিদ (Particle Physicist)। আন্তর্জাল ঠিকানা এখানে: Website। লেখাটি সদ্য "সৃষ্টির একুশ শতক" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে প্রকাশিত হলো।
প্রকাশিত হল সৃষ্টির একুশশতক, জুন ২০১৭ সংখ্যা। ভিন্ন স্বাদের নানা অনবদ্য রচনা সম্ভারে সমৃদ্ধ এবারের এই সংখ্যা, নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য।
Posted by Krishnendu Deb on Monday, June 12, 2017



About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই