Wednesday, July 19, 2017

পঞ্জিকা -- দিদিমণি

উৎস
আমি মফঃস্বলের মেয়ে। কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছি তিনবছর হল। এখন থাকি দক্ষিণ কলকাতায়। উত্তর কলকাতায় যাতায়াত খুব কম। কালে-ভদ্রে দাদুর-বাড়ি বেলগাছিয়া আর প্রয়োজন হলে কলেজ-স্ট্রীট ছাড়া উত্তর কলকাতায় আমার যাওয়ার আর কোনও জায়গা নেই। আজকে সহকর্মী বন্ধুর সাথে বইপাড়া রওনা হলাম হাতে বেশ কয়েকটা কাজ ও অকাজ নিয়ে--এই যেমন দু-চারটে বই কেনা, কলেজ-স্কোয়ারে কিছুক্ষণ বসে থাকা, প্যারা-মাউন্টে সরবত ও পুঁটিরামে মিষ্টি খাওয়া। সময় হাতে যা ছিল, তাতে কফি হাউসটা আজকের রুটিন থেকে বাদ দিতে হয়েছিল। আরেকটা বিশেষ কাজ ছিল হাতে, যেটা আসলে নেহাতই অকাজ। বাংলা-পঞ্জিকা প্রকাশক গুপ্ত-প্রেস খুঁজে বের করা। না তিথি-নক্ষত্র-কাল কিছুই আমি পালন করি না। তবে আমার ভাই আগামী বাংলা বছরে বিয়ে করবে পাঁজি-পুথি মেনে পাত্রীপক্ষের অনুরোধে। তাই কলকাতাবাসী একমাত্র দিদির কাছে তার আবদার, গুপ্ত-প্রেস থেকে আগামী বাংলা বছরের অপ্রকাশিত পঞ্জিকা এনে দিতে হবে যাতে মহারাজ নির্ঝঞ্ঝাটে বেস্ট লজটা এখুনি বুক করে ফেলতে পারেন। দেরি করলে নাকি এই একই উপায়ে অন্য কেউ সেটা দখল করে নিতে পারে।
নেহাত হাতে অপচয় করার মত সময় না থাকলে হয়তো আমি এ কাজ করার চেষ্টাই করতাম না। কিন্তু কাজটা না করলে আজকের এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাটা কোনদিন হতোনা নিঃসন্দেহে।

মা-ঠাকুমার কল্যাণে গুপ্ত-প্রেসের পঞ্জিকা আমরা সবাই বাড়িতে দেখেছি। আর সেখান থেকে তাঁদের দিনক্ষণ বিচার করে চলতেও দেখেছি। আমার অবশ্য ওই বইয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হত তার বিজ্ঞাপনগুলো। একসাথে এতো নিষিদ্ধ লেখা পড়ার আর সুযোগ ছিলনা। সে যাই হোক,  গুপ্ত-প্রেসে গিয়ে যে আমাকে শুভ দিন-ক্ষণ সংগ্রহ করে আনতে হবে তা আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। গুগল-সার্চ দিয়ে ঠিকানাটা ভাই আগেই বলে দিয়েছিল - ৩৭/৭, বেনিয়া-টোলা লেন, আর্মহাস্ট-স্ট্রীট রো, কলকাতা। উত্তর-কলকাতাবাসী এক সহকর্মীর মৌখিক পথ-বিবরণী অনুযায়ী আমি ও আমার সঙ্গী আর্মহাস্ট-স্ট্রীটে সিটি-কলেজের সামনে উপস্থিত হলাম। অলি-গলির কোন গুপ্ত জায়গায় গুপ্ত-প্রেস আছে, তার সঠিক সন্ধান উর্দিধারী ট্রাফিক পুলিশ দিতে পারলেন না। আমার কাছে স্মার্ট-ফোন নেই, যে তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাবো। তাই লোকজনকে জিজ্ঞেস করা ছাড়া আর গতি ছিল না। এক পানের দোকানীর কথা অনুযায়ী একটি দু’ফিট চওড়া গলিতে ঢুকে পারলাম। তখন সবে সন্ধ্যে হয়েছে। গলিটা নির্জন ও অন্ধকার। দূরে একটা পোলে আলো জ্বলছে। কলকাতা শহরের এমন গলির কথা  আমি লেখায় পড়েছি, সিনেমাতেও দেখেছি, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা এই প্রথম। দু’জনে যথেষ্ট সাবধানে এগোতে থাকলাম। গলিটা যেখানে শেষ হল, সেই জায়গাটা বেশ প্রশস্ত, কয়েকটা দোকান-পাট আছে। এবার এক পথচারীর নির্দেশে যে গলিতে ঢুকলাম, তার দু’দিকে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার অফিস ও প্রেস। বুঝলাম ঠিক দিকেই এগোচ্ছিরাস্তার দু’ধারের বাড়িগুলো পুরনো কলকাতার স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই বেনিয়া-টোলা লেন। পাওয়া গেল ৩৭/৭।
 বাড়িটি অত্যন্ত প্রাচীন। বাইরে থেকে দেখে মনে হল ভেতরে কেউ নেইখোলা দরজায় হাঁকডাক করতে একজন লোক বেরিয়ে এলেন। আমাদের দেখে তিনি বললেন, "বিয়ের তারিখ চান?  সোজা দোতলায় চলে যান।" কি আশ্চর্য! গোদা বাংলায় তো আমরা বিয়ের তারিখ কিনতেই এসেছি। লোকটা যে এরকম খদ্দের আগেও সামলেছে তাতে আর সন্দেহ থাকলো না। তাঁর কথা মত এবার আমরা বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠলো। আমরা দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে এগিয়ে গেলাম। এর মধ্যে বিয়ের তারিখ জোগাড়ের তাগিদ যত না ছিল তার থেকে বেশী ছিল প্রাচীন, ইট-খসে যাওয়া, নির্জন, আলো-আঁধারি বাড়িতে ঢোকার রোমাঞ্চ। যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বলেছিলেন ভদ্রলোক, তাতে একটি  বাল্‌ব জ্বলছে টিমটিম করে।  সিঁড়িটা শেষ হয়েছে একটি অন্ধকার ছাদে। কোথাও কোন জনপ্রাণী নেই। ছাদে উঠে কোথায় যেতে হবে বুঝলাম না। আদৌ এখানে আসাটা কতটা সুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাজ হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ হল। যা থাকে কপালে এই ভেবে একটি ভেজানো দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। ঘরে ছিলেন দু’জন বয়স্ক ভদ্রলোকঘরটা কাগজপত্রে ঠাসা। এটাই গুপ্ত-প্রেসের অফিস। জানিনা কেন ঘরটায় এত কম আলো। হ্যাঁ, বেশী আলো থাকলে হয়তো দেড়শ’ বছরের পুরনো জায়গাটা তার প্রাচীনত্বের গন্ধটা হারিয়ে ফেলতোওঁরা বললেন, যে তাঁদের প্রকাশিত সমস্ত পঞ্জিকা সুরক্ষিত আছে এখানে। ভাবা যায়?  আমার গত চার-পুরুষের জীবদ্দশার পুরো সময়টার দিনগুলোর বার-কাল-তিথি-নক্ষত্র এখানে খুঁজলে পাওয়া যাবে! দিনের পর দিন বছরের পর বছর এখান থেকে ছাপা হওয়া লেখা গুলোকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন কত মানুষ! কত বাড়ির ইতিহাস নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এই জায়গা। বিজ্ঞানের যুগে হয়তো বাংলা পঞ্জিকা গুরুত্ব হারিয়েছে, কিন্তু অবলুপ্ত হয়নিবাংলা তারিখই তো এখন অচল পয়সা। বাংলা পঞ্জিকারও এখন দিন শেষের পথে। তাই বুঝেই হয়তো এই অফিস-বাড়ি স্থানান্তরিত হচ্ছে অন্যত্র,  এই বিশাল বাড়ির ভাগ্য প্রমোটারের হাতে দিয়ে।
যখন বেরিয়ে আসছি, তখন যাদুঘর থেকে বেরনোর মত অনুভূতি হচ্ছিলোএকদিকে বিষাদ ও অন্যদিকে প্রাচীন কিছুকে কাছ থেকে দেখার আনন্দ। এতো পুরনো প্রেস! কত ইতিহাসের সাক্ষী কতই না ইতিহাস রচনার কারিগর! অতীতের আড়ম্বর হারিয়ে যেভাবে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে শুধু কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য, তাতে সে যেন নিজেই নিজের এতদিনের কাজকে পরিহাস করে চলেছে বলে মনে হলো।
………………………………………………
(এই ঘটনা বেশ কিছুদিন আগের। হয়তো গুপ্ত-প্রেসের সেই বাড়ি এখন আর নেই। আমার সেই খবর জানা নেই। কারোর জানা থাকলে বলবেন।)
সম্পাদকের সংযোজন: গুপ্ত-প্রেসের এখনকার ঠিকানা কালীঘাট, পুরনো অফিস আর ছাপাখানা দিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য সংবাদপত্রকে। বিস্তারিত লেখা বেরিয়েছে scroll.in এ। লিঙ্ক এখানে

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই