Wednesday, August 2, 2017

ডেডবডি -- আকাশ

সকাল হয়েছে। নিঃস্পন্দন শেষ তিমিরের পর নির্জন ভিজে মাটি জুড়ে কম্পন শুরু হয়। হিমেল সুন্দর এক হাওয়ায়, পাতলা দুধেল সরের মতো অবসন্নতা কেটে যাওয়ায় নবীন ঘাসফড়িঙের দল মৃত অবয়বের খবর নিতে ছোটে। থকথকে নীলের নীচে, প্রবীণ ছাতিমগাছে ছাতিম ফুলের যৌন গন্ধ লেগে থাকে। নিঃসঙ্গ জড়দের ঘুম ভাঙে ওই গন্ধে। পারস্পরিক আড়মোড়া ভেঙে তারা প্রত্যক্ষ করে একটা ডেডবডি পড়ে আছে। আশেপাশে ডেঁয়োপিঁপড়ে ভিড় করছে। চোখমুখে প্রশান্তি। লোকটার শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। অদূর থেকে একটা লোক উঠে আসছে- ছেঁড়া খাটো ধুতি, ভিজে গা। মুখে পোড়া বিড়ি, হাতে নিভিয়ে দেওয়া হ্যারিকেন। লোকটা মৃতদেহের কাছে আসে- বিড়িটা পায়ে ফেলে চেপে দেয়। খানিক চুপচাপ দাঁড়ায়। তারপর খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে থাকে। আচমকা যাবতীয় কূজন পেরিয়ে জমাট বিদ্রূপ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে। হাসি শেষে লোকটা, নিজের হ্যারিকেনটা একবার তুলে ধরে, তারপর সজোরে সেটা মাটিতে আঘাত করে। ডেঁয়োপিঁপড়ের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ঝনঝন কাচের শব্দের সাথে শোনা যায়- 'ঈশ্বর, ঈশ্বর-মৃত, মৃত'। প্রতিধ্বনি হয় কয়েকবার। তারপর সযত্নে কাচগুলো তুলে লোকটা ফিরে যায় যেখান থেকে সে এসেছিলো।

(২)
নির্মাল্য হালদারের বয়স ত্রিশ। পেশায় সরকারী চাকুরে, একটি দু'কামরার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। ত্রিশ বছর বয়সে, বা এই বয়সে উত্তরণের পর্যায়কালে তাঁর যা যা করা উচিত ছিলো, নির্মাল্য তার কিছুই করেননি। নির্মাল্য নেশা করেননি, জীবনে ক্লাবে যাননি, হই-হুল্লোড় অথবা পার্টি করেননি, লুকিয়ে চুমু খাননি এবং ত্রিশ বছর অবধি নিজের কৌমার্য অক্ষত রেখেছেন। জীবনের স্তরবিন্যাসে তাঁর সঙ্গী বলতে ছিলো- ছাঁচে ঢালা, নিপুণভাবে ঢালাই করা মধ্যবিত্ত নির্লিপ্তি। যেভাবে
সর্দির পর বুকে কফ জমে জমে শারীরিক ক্ষত তৈরি হয়, নির্মাল্যর হৃদয়ে নির্লিপ্তি সেভাবেই একাকীত্বের যন্ত্রণা তৈরি করেছিলো। বস্তুত নির্মাল্য কারুর সাথে মিশতেন না। দশটায় বেরনো এবং ছ'টায় ফেরা ব্যতিরেকে তাকে কেউ বিশেষ দেখতে পেতো না। পুজোআচ্চার দিনেও বাড়িতে থাকতেন। বস্তুত তাঁর মধ্যবিত্ততা তাঁর ভিতরেই নিষিদ্ধ আবডাল তৈরি করে দিয়েছিলো। ফলত নির্মাল্যর অস্তিত্ব তার পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্ত নির্লিপ্ততা কুড়িয়ে বাঁচিয়ে নিয়েই ছিলো।


(৩)
এহেন নির্মাল্য হালদারকে একদিন অনিদ্রা রোগে পেলো। এ বেশ অপ্রত্যাশিত। কারণ নির্মাল্যর আপাত নিশ্চিত জীবনে শ্রেণীচরিত্রগত নিশ্চিত বিলাসিতা ছিলো, এক- কাঁটায় কাঁটায় দশটায় ভাত মেখে খেয়ে অফিস যাওয়া, এবং দুই- রাতের ঘুম। নিশ্চয়তার প্রছন্ন ঘেরাটোপে বন্দী যে বিলাসিতা, নির্মাল্যর কাছে তার দ্বিতীয় কোনো পরিপূরক ছিলো না। যাবতীয় লড়াই ও ক্লান্তির শেষে যে স্বস্তিটুকু, আজ নতুন করে তার জন্য লড়তে হলে মানসিক ক্লান্তিরই নতুন করে উদ্রেক হয়। নির্মাল্য পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। প্রথমে তিনি অহেতুক কিছু ছটফট করলেন, লাভ হলো না। দ্বিতীয় দিন শোওয়ার আগে স্বমেহন করলেন বারদু'য়েক, ফল দিলো না যথারীতি। অবশেষে নির্মাল্য ভাবতে বসলেন, এ সমস্যা যথেষ্ট মধ্যবিত্ত কিনা? নির্মাল্যর যে ধারণা ছিলো - তাঁর নির্লিপ্ত নিশ্চিত মধ্যবিত্ততার থেকে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না - অনিদ্রা রোগ তাকেই সংকটে ফেলে দিয়েছিলো। অতঃপর নির্মাল্য কয়েক সপ্তাহ পর ডাক্তারের কাছে গেলেন -  বাড়ি ফিরলেন লো ডোজের কিছু ঘুমের ওষুধ নিয়ে। কিন্তু সে ওষুধ তিনি খেতে পারলেন না। তাঁর একান্ত যাপনে যে নতুন অতিথি থাবা বসিয়েছে, নির্মাল্য তাকে অভ্যেস করে ফেলেছিলেন। মধ্যবিত্ত - অভ্যেস ও ভালোবাসায় পার্থক্য করতে শেখেনি বিশেষ। 


(৪)
নির্মাল্য উঠে পড়ে। ঘুমের জন্য অহেতুক ছটফটানি আস্তে আস্তে ছেড়ে দিচ্ছে সে। নিজের রুম পেরিয়ে- বাথরুমের দিকে যায় নির্মাল্য। স্লিপিং পিলগুলো কমোডে ফেলে দু'বার ফ্ল্যাশ করে। চোখে-মুখে ঠাণ্ডা জল দ্যায়। তারপর আস্তে আস্তে জানলার পাশে এসে বসে। বাইরে আলতো নরম হাওয়া দিচ্ছে। কিছু আরাম বোধের পর নির্মাল্য উঠে ঘরে আসে। তার এগিয়ে চলার মধ্যে দেখা যায় অনিশ্চয়তা। এ ঘরটা বেডরুমের পাশে। নির্মাল্য আস্তে আস্তে টুলের ওপর উঠে দাঁড়ায়। আলতো টানে খুলে ফেলে ওপরের শো-কেস। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে, ধুলোর আবরণের ভেতর চাপা পড়ে থাকা বেশ কিছু বই। বহু দিনের পুরনো- পাতা ঝুরঝুরে হলুদ হয়ে এসেছে। অধিকাংশই ইংরেজি, কিছু বাংলাও রয়েছে অবশ্য। বইগুলো হাতে নিয়ে নির্মাল্য বেশ অবাক হয়। একসময়কার ভালোবাসা- তারপর হঠাৎ করে প্রায় অকারণে ছেড়ে দেওয়া এবং আজ হঠাৎ করে আবার বের করে আনা, এই সবকিছুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা যে খামখেয়ালীপনা তা একদমই তার শ্রেণীচরিত্রগত উপাদান নয়। অবাক হবার রেশ বজায় থাকে- তবে কি ভাঙছে?
(৫)
বিগত পাঁচদিন নির্মাল্য অফিস যায়নি। বিগত পাঁচদিন নির্মাল্যর ফোন আউট অফ অর্ডার। গত পাঁচদিন যাবতীয় আবডাল আবরণের ভেতর দিয়ে এক অন্য কম্পন দেখা দিয়েছে। আস্তে আস্তে ভেঙে চুরে যাচ্ছে তার সবকিছু। নির্মাল্য পড়ছে। তাকে ক্রমশ ঘিরে ফেলছে অন্য শব্দছক। প্রতিক্ষণে, প্রতিমূহূর্তে নতুন শব্দবন্ধ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে নির্মাল্য উপলব্ধি করছে কিরিলভকে। মৃত্যু সম্পর্কিত যাবতীয় অনৈকট্য মুছে গিয়ে ক্রমশ নিকটে আসছে অতীন্দ্রীয় কিছু নিস্তব্ধতা। মৃত্যু আসলে এক সমাধান। যাবতীয় যান্ত্রিক কোলাহল, অবসন্নতা পেরিয়ে টুকরো টুকরো একান্ত শান্ত কিছু কোলাজ। নির্মাল্যর চোখ বুজে আসছে ক্রমশ। তার চোখের সামনে চেকভের বিষণ্ণ অথচ একান্ত সুন্দর মানবশোক ফুটে ওঠে। আজীবন নির্লিপ্ত নির্মাল্য এবার ছুটে যাবে। ছুঁয়ে দেখবে সূক্ষতা। ছুঁয়ে দেখবে শিল্প।
(৬)
শেষরাত। নির্মাল্য ধীর পায়ে উঠে আসে ছাদে। গোটা ছাদ জুড়ে জড়িয়ে থাকা জমাট কালো শূন্যতার মাঝে নির্মাল্য বসে থাকে। চুপচাপ। যাবতীয় শূন্যের মাঝে, সারা শরীর জুড়ে এক ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যায়। মৃত্যু আর কয়েকপদ মাত্র। নির্মাল্য উঠে দাঁড়ায়, এক নির্জন গহীন গিরিখাতের খুব কাছাকাছি- এক নির্ভীক সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের মুখোমুখি, নির্মাল্য এগিয়ে যায়। সে পেরিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতি পদক্ষেপের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে তার আজন্ম পরিচিত ফুটবল, চেনা মাঠ, কানাগলি। মুখের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে কুয়াশা... আহ্‌! ভোর হচ্ছে। থকথকে নীলের নীচে হাওয়া দেয়। নির্মাল্য রেল পাঁচিলের ওপর উঠে দাঁড়ায়। ভোরের প্রথম বাতাস তার চোখেমুখে। একে একে মিলিয়ে যায়, ব্যক্তি-রাষ্ট্র-পরিবার, যাবতীয় সুখস্মৃতি। সরে যাচ্ছে আবছায়া, চেনা মুখ। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছে নিস্তব্ধ দম্পতি। আর কয়েক মুহূর্ত। চোখ বুজে আসে নিমার্ল্যর- এক, দুই, তিন-ধপ। যাবতীয় স্তব্ধতা ভেদ করে একটা আওয়াজ- ধ অ অ অ প। পিছনে পড়ে থাকে ব্যক্তি, পুজো, সমাজ, সবেগ অথবা আধুনিকতা।

(৭)
পুলিশ এসেছে। সারা এপার্টমেন্টের লোক ভিড় করে এসেছে, পিছনের লনের দিকটায়। নির্মাল্য হালদার সুইসাইড করেছে। আজীবন নির্লিপ্ত-সাদামাটা নির্মাল্য আত্মহত্যা করেছে। থিকথিকে ভিড় থেকে অনুসন্ধিৎসু মনন ঘুরে বেড়ায়। নির্মাল্যর প্রেমিকা ছিলো? চাকরি চলে গেছিলো? কী বীভৎস এই মৃত্যু... পুলিশ বডি নিয়ে যায়। চকের দাগ পড়ে থাকে লন জুড়ে। একটি সাত আট বছরের বাচ্চা কেবল মুচকি মুচকি হাসে। গোধুলিবেলা সিঁদুরে আকাশের বুক জুড়ে কিছু চিল উড়ে বেড়ায়। ক্রমশ অন্ধকার হচ্ছে। পৃথিবীর যাবতীয় ভার আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে। এপার্টমেন্ট জুড়ে ব্যস্ততা নেমে আসে, নৈমিত্তিক। মৃত্যু নাকি জীবন? জীবন নাকি কেবল দায়িত্ব-কর্তব্য-ব্যস্ততা? উত্তর মেলে না। শুধু দেখা যায় খাটো ধুতির একলোক যাবতীয় অন্ধকার পেরিয়ে উঠে আসছে। চোখে মুখে পরিহাস। আস্তে আস্তে চক আঁকা জায়গাটার কাছে চলে আসে লোকটা। তারপর যাবতীয় নীরবতা পেরিয়ে শোনা যায় সেই খনখনে গলার হাসি। সেই হাসি- যার প্রতিধ্বনিতে প্রবল বিদ্রূপ আর পরিহাস উঠে আসে। সেই হাসি যার উত্তর কেউ দিতে পারে না। সভ্যতার আলোকবর্তিকা নয়- ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ, বিপ্লব কেউ নয়। হাসি থামিয়ে লোকটা আবার চিৎকার করে ওঠে- 'ঈশ্বর, ঈশ্বর-মৃত, মৃত'।

[পুনশ্চ: ক্লু হিসাবে পুলিশ মাত্র দু'টি জিনিস খুঁজে পায়। এক নির্মাল্যর হাতের কাগজ। যাতে লেখা ছিলো- “There is but one truly serious philosophical problem, and that is suicide.”এবং দুই- ছাদের ওপর পেজমার্কার দিয়ে রাখা একটি বই। যাতে লেখা ছিল- “Gods also decompose. God is dead. God will always stay dead. And we have killed him.” পুলিশ তদন্তের খাতিরে এই দু'টিকে বাজেয়াপ্ত করে]

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই