ইতিহাসে কর্মবিরতি বা হরতালের প্রথম নথিটি বেশ পুরনো। ১১৫২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরীয় ফ্যারাও তৃতীয় রামোসিস এর রাজত্বকালে প্রথম কর্মীবিক্ষোভ ও হরতালের নথিবদ্ধ ইতিহাস আছে। রাজ-সমাধিস্থলের কর্মীরা বর্শার ধারালো মুখের আগায় স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন “ইনকিলাব জিন্দাবাদ, আমরা কাজে যাচ্ছি না”। আধুনিক উদাহরণটি তুলনায় নতুন। ১৭৬৮ সালে লন্ডনের বন্দরে ধর্মঘট। তখনই ইংরাজি শব্দভাণ্ডারে “Strike” কথাটি হরতালের সমার্থক হয়। তারপর টেমস ও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, নীলনদও বসে নেই- সবাই অনেকগুলি ছোট-বড়, মাঝারী বিভিন্ন ধরণের বনধের সাক্ষী।
কাজ না করার অধিকার, সচেতন আন্দোলনের অধিকার নিয়ে
আন্তর্জাতিক বিতর্ক আজও বহাল। সাধারণতঃ পশ্চিমী বিশ্ব কর্মীদের আন্দোলনের অংশ
হিসেবে কাজ না করার অধিকারকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। সবচেয়ে মজার একটা কথা
এখানে না বললেই নয়, সাধারণত এই জাতীয় আন্দোলনের monopoly যারা দাবি করে থাকেন, সেই কমিউনিস্ট পার্টির স্বর্গধাম চীন কিন্তু ধর্মঘট নিষিদ্ধই করে দিয়েছিল। চেয়ারম্যানের যুক্তিটি বেশ মনোরম- যেহেতু চীন সরকার আসলে শ্রমিকের সরকার, কাজেই এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনরকম আন্দোলন ও বিক্ষোভ আসলে শ্রমিক বিরোধী এবং “বিপ্লব-বিরোধী” (Counter revolutionary)। ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নেরও দাবি একই। হুঁ হুঁ বাবা, কেমন কথার ফাঁদ পেতেছি দেকেচো, আন্দোলনের সংজ্ঞাটাই বদলে দিলুম। নে, কি করবি কর। তা, কি করা যায়, এই চিন্তায় ঘুম আসছিল না ওয়াশিংটনের। নিজেদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে মাত্রাছাড়া অহংকার করতে গেলে আন্দোলনকে, বন্ধ-কে স্বীকৃতি না দিলেই নয়, আবার এই সুযোগে ওরা প্রতিদিন কাজকর্ম চালিয়ে কয়েক মাইল এগিয়ে যাচ্ছে! বোঝ ঠ্যালা। উপায় বার হল। আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭৬ সালে শেষমেশ চীন সই করল এক চুক্তি, যাতে করে খাতায় কলমে চীনারা ফেরত পেলেন ধর্মঘটের অধিকার। যদিও চীনের প্রাচীর আজও বেশ উঁচু, সেখানে কে কবে এই অধিকার ফলাতে গিয়ে কি ফল পেলেন, তা বাইরে থেকে বলা নিতান্তই অসম্ভব। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু পরিষেবা ক্ষেত্রে বন্ধ অবৈধ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সংবিধানসিদ্ধ। একদা যে সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হত না এবং বর্তমানে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রে পরিণত সেই ব্রিটেনে বন্ধ নিয়ে একাধিকবার পরস্পরবিরোধী আইন পাশ হয়েছে। শ্রমিকেরা বারবার “চাক্কা জ্যামের” অধিকার পেয়েছেন এবং খুইয়েছেন। বর্তমান অবস্থা খানিকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতই। ফরাসী সংবিধান ধর্মঘটের অধিকার দিয়েছে। কানাডা আবার হুকুম দিয়েছে – বন্ধ অবৈধ। তবে আন্তর্জাতিকভাবে এই ব্যাপারটা এখনও ঘোলাটে এবং ঘোলা জলে মাছ ধরার সুবিধে সম্পর্কে সকলেই বেশ ওয়াকিবহাল।
এখানে না বললেই নয়, সাধারণত এই জাতীয় আন্দোলনের monopoly যারা দাবি করে থাকেন, সেই কমিউনিস্ট পার্টির স্বর্গধাম চীন কিন্তু ধর্মঘট নিষিদ্ধই করে দিয়েছিল। চেয়ারম্যানের যুক্তিটি বেশ মনোরম- যেহেতু চীন সরকার আসলে শ্রমিকের সরকার, কাজেই এই সরকারের বিরুদ্ধে কোনরকম আন্দোলন ও বিক্ষোভ আসলে শ্রমিক বিরোধী এবং “বিপ্লব-বিরোধী” (Counter revolutionary)। ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নেরও দাবি একই। হুঁ হুঁ বাবা, কেমন কথার ফাঁদ পেতেছি দেকেচো, আন্দোলনের সংজ্ঞাটাই বদলে দিলুম। নে, কি করবি কর। তা, কি করা যায়, এই চিন্তায় ঘুম আসছিল না ওয়াশিংটনের। নিজেদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে মাত্রাছাড়া অহংকার করতে গেলে আন্দোলনকে, বন্ধ-কে স্বীকৃতি না দিলেই নয়, আবার এই সুযোগে ওরা প্রতিদিন কাজকর্ম চালিয়ে কয়েক মাইল এগিয়ে যাচ্ছে! বোঝ ঠ্যালা। উপায় বার হল। আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭৬ সালে শেষমেশ চীন সই করল এক চুক্তি, যাতে করে খাতায় কলমে চীনারা ফেরত পেলেন ধর্মঘটের অধিকার। যদিও চীনের প্রাচীর আজও বেশ উঁচু, সেখানে কে কবে এই অধিকার ফলাতে গিয়ে কি ফল পেলেন, তা বাইরে থেকে বলা নিতান্তই অসম্ভব। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু পরিষেবা ক্ষেত্রে বন্ধ অবৈধ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সংবিধানসিদ্ধ। একদা যে সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হত না এবং বর্তমানে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রে পরিণত সেই ব্রিটেনে বন্ধ নিয়ে একাধিকবার পরস্পরবিরোধী আইন পাশ হয়েছে। শ্রমিকেরা বারবার “চাক্কা জ্যামের” অধিকার পেয়েছেন এবং খুইয়েছেন। বর্তমান অবস্থা খানিকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতই। ফরাসী সংবিধান ধর্মঘটের অধিকার দিয়েছে। কানাডা আবার হুকুম দিয়েছে – বন্ধ অবৈধ। তবে আন্তর্জাতিকভাবে এই ব্যাপারটা এখনও ঘোলাটে এবং ঘোলা জলে মাছ ধরার সুবিধে সম্পর্কে সকলেই বেশ ওয়াকিবহাল।
এ তো গেল উন্নত পশ্চিম বিশ্বের কথা। অনুন্নত বা
উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বন্ধের পরিস্থিতি কেমন? এই বিষয়ে একটি রাকাটার আগেই বলে নিতে
হয় যে এই ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক দেশগুলির চাইতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা
অনেক বেশি। গণতন্ত্রের নামে সেইসব দেশে কর্মসংস্কৃতির যত বারোটা বাজবে ওয়াশিংটনের
ওপর তাদের নির্ভরতা ততটাই বাড়বে। তার লক্ষ্মীর ভাঁড়ার ততই ফুলে ফেঁপে ওঠার
সম্ভাবনা। কাজেই কর্মবিরতি এবং অন্যান্য নেতিবাচক আন্দোলনের অধিকার যাতে এইসব দেশে
বহাল থাকে, সে বিষয়ে হোয়াইট হাউস সদা যত্নবান। যাক,পরনিন্দায় কাজ নেই। প্রতিবেশীর
অভিজ্ঞতা কিরকম দেখা যাক। বাংলাদেশ এই বিষয়ে চূড়ান্ত ভুক্তভোগী। বি এন পি এবং
আওয়ামী লীগ, যে যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই অপর পক্ষ ঢাকাকে অচল করে রাখার ব্যবস্থা করে ফেলে। এর দরুন
আর্থিক ক্ষতির বোঝা সামলাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে সেখানকার বাঙালিদের। তবে খুব
সম্প্রতি একটা আশার আলো দেখা গিয়েছে সেখানে। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে সেখানে
শুরু হয়েছে জমায়েত ও অবরোধ- এবং সেই আন্দোলন চলছে, কোনমতেই কাজে ফাঁকি দিয়ে নয়,
উপরন্তু সারা দিনের কাজ সেরে বিকেল বেলা জড়ো হচ্ছেন প্রতিবাদীরা। ধর্মান্ধ জামাত
এই প্রবণতা আটকাতে যথারীতি বন্ধের ডাক দিয়েছিল, প্রত্যাখ্যান করেছেন মানুষ-
সত্যিই আশার আলো।
তবে হরতাল ও বন্ধের প্রতিযোগিতায় যদি প্রথম
স্থানের দাবিদার কেউ থেকে থাকে, সেটি অবশ্যই আমাদের দেশ। মন্দির-মসজিদ ভাঙ্গা, বা
ভাঙ্গতে না দেওয়া, বা আবার গড়ে দেওয়া ইত্যাদির প্রতিবাদে, জ্বালানীর দাম বাড়া,
বাসের ভাড়া বেড়ে যাওয়া বা মোটেই না বাড়া, মাইনে না বাড়া, কিংবা ড্রেনে জল জমা,
পাড়ার ভ্যাট সাফ না হওয়া ইত্যাদি বহুবিধ প্রতিবাদে সহজ ও সফলতম অস্ত্র – বন্ধ।
আমাদের সংবিধান যেহেতু ব্রিটিশ সংবিধানের একটা অন্য সংস্করণ, কাজেই এই সংক্রান্ত
ভারতীয় আইন অত্যন্ত জটিল। হরতাল এমনিতে ভারতে বৈধ, কিন্তু অতীতে বহুবার উচ্চ
আদালতে কাজীরা বিভিন্ন প্রস্তাবিত বন্ধকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু মানসিকতার
কারণে অধিকাংশ বন্ধই সফল হয়েছে। তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ পাহাড়প্রমাণ,তবে এতে
আহ্বানকারীদের কিছু এসে যায় না। বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী ও
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের বেসরকারীকরণের নীতির পরিপ্রেক্ষিতে যত
বেসরকারি কর্মক্ষেত্র বেড়েছে,ততই কমে এসেছে বন্ধের প্রবণতা। তার কারণটি খুবই সহজ।
বেসরকারি সংস্থা হয়ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বন্ধ সমর্থক কর্মীকে তক্ষুনি
ঘাড়ধাক্কা দেবে না (যদিও আজকাল প্রায়ই দিচ্ছে) কিন্তু পরবর্তী কালে তার পদন্নোতি,
ক্ষমতা ও দায়িত্বভার ইত্যাদি বিষয়ে তার Track record এর ব্যাপারে সরকারের মত
বর্মসম সহনশীলও হবে না। এবং এই বিষয়ে ইউনিয়নের সাহায্য করার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত।
কাজেই সোনামুখ করে কাজে যাওয়া ছাড়া “নান্যং পন্থা বিদ্যতে”।
তবে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের কথা এখানে একই সাথে
বলার মত নয়। তারা পৃথক অনুচ্ছেদ দাবি করে। দেশের সাংস্কৃতিক জ্যাঠা, যার নাম
পশ্চিমবঙ্গ, সেখানে বন্ধের প্রেক্ষিতটাই আলাদা। আগেই উল্লিখিত হরতালগুলি ছাড়াও
অন্যান্য মহৎ উদ্দেশ্যে কর্মবিরতি পালন করে থাকেন বাঙালিরা। ফি বচ্ছর কেন্দ্রীয়
সরকারের বঞ্চনার প্রতিবাদে একটি, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে একটি করে বন্ধ বাঁধা
পাওনা এখানে। বাঙালি মোটেই স্বার্থপর নয়, তার কাছে “বসুধৈব কুটুম্বকম্”। কাজেই এই সেদিন অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সাম্রাজ্যবাদী নীতি, ইরাক আক্রমণ, ইত্যাদির প্রতিবাদেও অবরোধ ও বন্ধের আয়োজন
হয়েছে সাড়ম্বরে। কিমাশ্চর্যম্, তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিন্দুমাত্র
পরিবর্তন হয় নি! এমনকি দিল্লীরও বিভিন্ন নীতি অপরিবর্তিত! এনারাও কম যান না।
এমনিতেই ‘পরিবর্তন’ শব্দটিতেই
এখানকার তাত্বিক বাম নেতাদের ভয়ানক অ্যালার্জি, কাজেই তাঁরাও নিজেদের বস্তাপচা বন্ধের
নীতি অপরিবর্তিতই রেখেছেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হরতালের আয়োজনও বোধহয় এই
বঙ্গভূমিতেই একমাত্র সম্ভব। একটি বন্ধে কাজ না হলে (কাজ না হওয়াটাই স্বাভাবিক,
কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় যেভাবে চলতে হয়, তা বাংলার অজানা, কাজেই তার
উন্নতির পথও দিল্লির অজানা) উপর্যুপরি দু’টি বন্ধ ডাকতেও এরা সাহস দেখান। তার পোশাকি নাম হয় “ভারত বন্ধ”। অবশ্য ভারত বলতে বিশাল কিছু ধারণা করা এদের
পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব বলে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং কিছুটা কেরল, এই তিনের
সমষ্টিকেই ‘ভারত’ বলে
ভাবার ভুল করে থাকেন তারা। সেই সময়ে মুম্বই, চেন্নাই, আমেদাবাদ ইত্যাদিরা আরও একটু
এগিয়ে যায়। অতএব নিতান্ত বাধ্য হয়েই আবার কেন্দ্রীয় বঞ্চনার তত্ত্বটি খাড়া করতে হয়
এখানে এবং আরও একটি ভারত (অর্থাৎ বাংলা) বন্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। চক্রটি সত্যিই
বেশ মনোহর। বেসরকারি সংস্থাগুলিও এখানে অসহায়। সরকারি যন্ত্র ধর্মের ঘটটি বসালে
পুলিশি সহায়তার আশা থাকে না। সংস্থা নিজে ব্যবস্থা নিলে জঙ্গি কর্মী আন্দোলন- এবং
তা প্রতিরোধেও যথারীতি পুলিশি সাহায্য দুরাশামাত্র। অতএব পাততাড়ি গোটানো ছাড়া আর
কোন রাস্তা বাকি থাকে না। সুযোগ বুঝে গাঁধীনগরের আমন্ত্রণ এবং পুঁজি হাওয়া। যাকগে,
গেছে তো সেই সাম্প্রদায়িক মোদীর রাজ্যে- তাকে নিয়ে আবার চিন্তা, ফুঃ। খ্যাপা ছুঁড়ে
ফেলে পরশপাথর। তবে সফটওয়্যার শিল্প এর একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম আরও আছে,
এখন আরও বাড়ছে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী খুব কড়া অবস্থান নেওয়ায় “লাল”চক্ষু উপেক্ষা করে বন্ধের দিনেও কাজে যাওয়ার
অভ্যাস করতে হচ্ছে কর্মীদের। আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের প্রতি সহানুভূতি শিকেয় তুলে
পবিত্র ধর্মঘটের দিনেও নিতান্ত মাইনে কাটা যাওয়া আটকাতে গোমড়া মুখে চড়ে বসতে হচ্ছে
সরকারি যানে। এহেন অপমানে কবে বন্ধ সমর্থকেরা লজ্জা পাবেন বোঝা যাচ্ছে না। তবে
এমনটা চলতে পারে না, সেটা বিগত ২০-২১ ফেব্রুয়ারি বুঝেছে বাঙালি। যত তাড়াতাড়ি সবাই
বোঝে, ততই মঙ্গল।