এই প্রশ্নটা টিভির বিজ্ঞাপনে সব নায়িকাকেই কোনো
সাংবাদিক বা আবহভাষ্যকার বা ঈর্ষাতুরা বালিকা করে থাকে, এবং উত্তরটা হয় কিছু একটা
কেশতৈলের নাম। কিন্তু ও সব মিছে... শ্যামের যে চাঁচরকেশের জন্য বৃন্দাবনের
গোপিনীদের হুতাশে মরে যাওয়া নিয়ে বৈষ্ণব পদাবলী ছয়লাপ, তার বেলা? রবিঠাকুর যেসব
বাঙালি যুবতীদের ছায়াময় এলোকেশ আকাশে-বাতাসে দেখে বেড়াতেন, সেসবই বা এল
কোত্থেকে?
এর উত্তর পেতে গেলে, হে পাঠক, আপনাকে অর্ধেক
পৃথিবী পেরিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় যেতে হবে। দুটো কারণ। প্রথমটা এই, যে আমি আপাতত
তাদের লোকজনদের নিয়েই কাজ করছি যে! আমার প্রফেসর কলাম্বিয়ান, ল্যাবও ল্যাটিন
লোকজনে পরিপূর্ণ – এই যেমন মাসকয়েক আগে আসা একটি খুকিকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম
ল্যাবে মোর এল এক নবীনা ল্যাটিনা
নাম তার আনা কারেনিনা।
তারপর কী হইল
জানে শ্যামলাল – মানে সেখানে কারা কারা কতপরিমাণ হুতাশ এবং চিত্তচঞ্চলতা প্রকাশ করে গেছিলেন সে কথা নাহয় না-ই বললাম, আস্ত একটা চলচিত্তচঞ্চরি লেখা হয়ে যাবে তাহলে। মোদ্দা কথা হল, ওদিককার নানা দেশে নানা ইউনিভার্সিটির লোকজন আমাদের ইউনির সঙ্গে কোলাবরেশনে অনেক অনেক লোকেদের ডেটা সংগ্রহ করছে। ডেটা বলতে জুতোর মাপ, গায়ের রঙ, কান কটকট করে কি না, জীবিত কি মৃত, ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিবরণ তো আছেই, তার সঙ্গে একটুখানি রক্ত নিয়ে সেটা থেকে ডিএনএ বের করে তার থেকে জিনটিন বের করাও আছে।
জানে শ্যামলাল – মানে সেখানে কারা কারা কতপরিমাণ হুতাশ এবং চিত্তচঞ্চলতা প্রকাশ করে গেছিলেন সে কথা নাহয় না-ই বললাম, আস্ত একটা চলচিত্তচঞ্চরি লেখা হয়ে যাবে তাহলে। মোদ্দা কথা হল, ওদিককার নানা দেশে নানা ইউনিভার্সিটির লোকজন আমাদের ইউনির সঙ্গে কোলাবরেশনে অনেক অনেক লোকেদের ডেটা সংগ্রহ করছে। ডেটা বলতে জুতোর মাপ, গায়ের রঙ, কান কটকট করে কি না, জীবিত কি মৃত, ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিবরণ তো আছেই, তার সঙ্গে একটুখানি রক্ত নিয়ে সেটা থেকে ডিএনএ বের করে তার থেকে জিনটিন বের করাও আছে।
***************************
আমাদের ছোটোবেলায় টিভিতে ‘ক্যাপ্টেন ব্যোম’ বলে
একটা আন্তঃগ্যালাক্টিক কল্পবিজ্ঞান সিরিয়াল হত, যেটায় চকচকে লেদারসুট আর শোলার
বিশাল বন্দুক হাতে সুপারমডেল মিলিন্দ সোমান দৌড়াদৌড়ি মারপিট আর প্রেমটেম করত। তো
যথারীতি সেইটায় নায়ক হচ্ছে এক পাগলা বৈজ্ঞানিকের একমাত্র সন্তান যে কিনা তার বাবার
পরিচয় জানে না। ভিনগ্রহে এক বিধ্বস্ত স্পেসস্টেশনে অভিযান চালাবার সময় সে ওই
বৈজ্ঞানিকের একখানা চুল পায়, তারপর সেখানেই ইলেকট্রিক চাটু’র মত একটা যন্তরে
নিজেরও মাথা থেকে ছিঁড়ে একখানা চুল রাখতেই মনিটারের স্ক্রিনে ‘পোলা! পোলা!’ বলে
ম্যাচিংয়ের ফল ভেসে ওঠে।
ব্যাপারটা ঠিক অতখানি সহজ না হলেও আজকালকার দিনে
ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পিতৃত্ব বের করা রুটিন পদ্ধতি হয়ে গেছে। আর আমাদের কাজের
ব্যাপারটাও অনেকটা ওইরকমই, কেবল পিতার বদলে জাতি খোঁজা। তা সেসব বলার আগে একটু
জিন-ক্রোমোজোম ইত্যাদির ব্যাপারগুলো একবার চট করে মনে করিয়ে দিই।
যদিও ডিএনএ জিনিসটা জোড়ায় জোড়ায় থাকে, মইয়ের মতন,
পড়বার সময় একটা দিক পড়লেই চলে, অন্যদিকটা এটার প্রতিবিম্ব বলতে পারেন। তো
টাইম-লাইফ বুকস’য়ের একটা চমৎকার সিরিজ আছে, ‘ফুডস অফ দি ওয়ার্ল্ড’ বলে,
রেসিপিরাশি, তেইশ ভলিউমের। আমাদের প্রতিটা দেহকোষের নিউক্লিয়াসেও ডিএনএ-তন্তুর উপর
জিনগুলো অমনই তেইশটা খন্ডে সাজানো আছে, যেগুলোকে বলে ক্রোমোজম। বইগুলোর মধ্যে
একেকটা জিনকে একটা পূর্ণাঙ্গ রেসিপি ধরতে পারেন, যারা প্রস্তুত করে একটা আস্ত
প্রোটিন। আর জানেন বোধহয়, ডিএনএ-তে সব তথ্য লেখা থাকে মাত্র চারটে অক্ষর দিয়ে, A T
G C।
তো মানবদেহের এই বইগুলো পড়ার দরকার এই জন্য, যে
সবার শরীর-মন তো একরকম হয় না, যার অর্থ রেসিপিতে নিশ্চয়ই ছোটখাট হেরফের থাকে।
মুদ্রণপ্রমাদে যেমন বীরাঙ্গনা বারাঙ্গনা হয়ে অর্থ পুরো বদলে যেতে পারে, সেই রকম।
এখন ছাপার ভুল তো অনেক রকমের হয়, একটা অক্ষরে ভুলচুক হওয়া যদিও সবচেয়ে সাধারণ
গণ্ডগোল, একটা গোটা শব্দ হাপিস হয়ে যাওয়া বা ভুল শব্দ ছাপা এসবও হতে পারে। তো
আমাদের এখনকার কাজ হচ্ছে প্রথম ধরনের মানে সবচেয়ে প্রচলিত ভুলগুলোকেই দেখা, যেখানে
ডিএনএ-র সুতোয় একটা মাত্র জায়গা বদলে গিয়ে থাকে। এটার পোশাকি নাম SNP, আমরা ডাকি
স্নিপ।
ডাক্তাররা নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায় এইসব
জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই নোটবুক থুড়ি রেসিপিবুকেই তদন্ত চালান; ক্যান্সার
কোন কোন জিনে মুদ্রণপ্রমাদ হলে হতে পারে তাও কিছু কিছু খুঁজে বের করা গেছে।
তবে জিনে হেরফের হলে যে কেবল রোগবালাই-ই হয় তা না।
প্রোটিন তো অনেক রকমেরই হয়, ধরেন হরমোনও একরকমের প্রোটিন, তো যাদের গ্রোথ হরমোন
একটু কম তৈরি হয় তারা একটু কম লম্বা হবে, এইরকম।
একই রকম ভাবে গায়ের রঙ, চোখের রঙ ইত্যাদি অনেক
প্রকট লক্ষণের পেছনেও জিন খুঁজে পাওয়া গেছে এইভাবে। উপায়টা এইরকম, যে একশজন লোককে
নিন যাদের চোখের রঙ কালো, আর একশজন লোককে নিন যাদের চোখের মণি নীল। এবার এদের সবার
জন্য ওই তিন বিলিয়ন অক্ষর লম্বা বইখানা পড়ে ফেলুন তাদের একটুখানি স্যাম্পল মেশিনের
মধ্যে ঢুকিয়ে। তারপর কম্পিউটারকে খুঁজতে দিয়ে দিন, এর মধ্যে কোন খণ্ডের কোন
রেসিপিটায় এদের দুদলের মধ্যে তফাত দেখা যাচ্ছে?
(অবশ্য ব্যাপার কি, মোট তিন বিলিয়ন অক্ষরের মধ্যে
৯৯%এর বেশিই সব মানুষের সমান, তা না হলে, মানে আবশ্যক প্রোটিন তৈরির রেসিপিগুলো
সবার মধ্যে সমান না হলে তো রাণীর পেটে ব্যাঙ জন্মাতো। তাই হিউম্যান জিনোম
প্রোজেক্ট কয়েক মিলিয়ন অক্ষরের একটা তালিকা করে দিয়েছে, যে কোন কোন বইয়ের কোন কোন
রেসিপির কোন কোন জায়গায় মানুষদের মধ্যে সচরাচর হেরফের দেখা যায়। যন্তরগুলো শুধু ওই
জায়গাগুলোই পড়ে।)
***************************
এইবার ল্যাটিন আমেরিকা নিয়ে কাজ করার দ্বিতীয়
সুবিধাটায় আসি। সাম্বানৃত্যপটিয়সী ব্রাজিলিয়ান ললনা যারা অধিকাংশই পূর্ণ ইউরোপীয়
বংশের, তাদের দেখে যেমন মনে হতে পারে সেটাই কিন্তু পুরো কাহিনী নয়। লাতিন লোকেদের
মধ্যে গায়ের রঙ মুখের গড়ন ইত্যাদির অনেক হেরফের আছে, মায় পুরো আফ্রিকান বংশীয় লোকজনও আছে; এবং আমার
অভিজ্ঞতা বলে তাদের অনেককেই পুরো ভারতীয়দের মত দেখতে, না বলে দিলে বোঝার যো নেই!
এটার কারণ বুঝতে গেলে আমাদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ যাদের
বলা হত সেই নেটিভ আমেরিকানদের আবির্ভাবের ইতিহাস জানা দরকার। উপরের পৃথিবীর
ম্যাপটা দেখলে আদিযুগ থেকে মানুষের বিস্তারের একটা ধারণা পাবেন, যদি হলুদ-সবুজ
চাকতিগুলোকে ভুলে গিয়ে আপাতত নীল তীরগুলোর উপর নজর করেন। আফ্রিকায় মানুষের পূর্বসূরিদের থেকে প্রথম আধুনিক মানুষ মানে হোমো স্যাপিয়েনসের উৎপত্তি হবার পর,
প্রায় লাখখানেক বছর আগে (যখন আরবের উপকূল ছিল অনেক শস্যশ্যামল) তারা ওই পথ ধরে
ভারতে আসে – এরাই ছিল দ্রাবিড় সভ্যতার পূর্বসূরি, এবং এসব জনজাতির অবশিষ্টাংশ এখন
আন্দামান-নিকোবরের দ্বীপগুলোতে পাওয়া যায়। এরাই আরো এগিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে
অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যায় চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। এই গতিপথটাকে প্রত্নতত্ত্ব
দিয়ে স্টাডি করার সমস্যা এই যে, তখন সমুদ্রের জলস্তর ছিল কম, গোটা দ্বীপময়
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল একটা বিশাল স্থলভাগ – এখন সেসব অংশ এবং আরবের উপকূল
বেশিরভাগই সমুদ্রের তলায়।
ওটা ছিল নিচের তীরটা; উপরের তীরটা হচ্ছে পরের দিকে
যারা এসে এশিয়া-মাইনর অঞ্চলে বসতি করেছিল তাদের পথনির্দেশ। এখানেই ফর্সা রঙের
‘আর্য’দের উদ্ভব, যারা একদিকে ইউরোপে অন্যদিকে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এক অংশ আবার মধ্য
এশিয়া হয়ে চীনে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে চৈনিক চেহারা বলতে আমরা যে রকমটার কথা বুঝি
সেটার উৎপত্তি। তারা শীতলতর অঞ্চলে বসবাসের জন্য বিবর্তিত হয়, চ্যাপ্টা মুখ খাটো
উচ্চতা ইত্যাদি। এরা ক্রমে উত্তরদিকে ছড়িয়ে সাইবেরিয়াতেও বসবাস করা শুরু করা,
সেইসব চুকচি ইয়াকুৎ উপজাতি যাদের গল্প আমরা রুশ উপকথার বইগুলোয় পড়েছিলাম।
তারপর ১৫-২০ হাজার বছর আগে আইস এজের শেষদিকটায়,
যখন সমুদ্রস্তর ছিল নিচু, এরা বেরিং প্রণালী সহজে পেরিয়ে উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ
করে। সেখানে এস্কিমো ইনুইট উপজাতিদের আবির্ভাব এভাবে। এরা ক্রমেই দক্ষিণ দিকে এগোতে
থাকে, যেখানে আবহাওয়া ছিল গরম আর তাই নদীনালা বনজঙ্গল চাষবাস জীবজন্তু সবেরই
সুবিধা ছিল। সেই সঙ্গে আবার খানিক উল্টো বিবর্তনও হতে থাকে, যেমন এদের গায়ের রঙ
একটু গাঢ় হতে শুরু করে আবার। এরা একেবারে চিলির দক্ষিণ প্রান্ত অবধিও পৌঁছে
গিয়েছিল। এরাই মায়া আজটেক ইনকা ইত্যাদি বিখ্যাত সভ্যতাদের পূর্বপুরুষ।
তারপরে ওই যে, ১৪৯২তে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের
পরে হুড়মুড়িয়ে স্প্যানিশ লোকজন ঢুকতে লাগল সেখানে, তারা মেরেকেটে রোগবালাই ছড়িয়ে
কত যে লোক হাপিস করে দিল তার ইয়ত্তা নেই। সেই সঙ্গেই তারা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দাস
আনাও শুরু করল। এইভাবে তিনটে জনজাতির মিশ্রণ হয়ে একেবারে সুপের হাঁড়ির মত অবস্থা
হল সে দেশের জিন পুলের, সব ঘেঁটে ঘ।
এখন একটু ভাবলেই দেখতে পাবেন, ভারতের অবস্থাটাও
খুব অন্যরকম না। আফ্রিকার উত্তরসূরি দ্রাবিড় জনজাতি, ইউরোপীয়দের পূর্বসূরি আর্য
জাতি তো আছেই, আর চীনাদের প্রতিনিধি মোঙ্গল থেকে বার্মিজ এরাও নিয়মিত হাজিরা
দিয়েছে, রবিবাবু স্মর্তব্য।
এই প্রোজেক্টে প্রাথমিক ধাপ হিসেবে সব
ভলান্টিয়ারদের তাদের অ্যানসেস্ট্রি রিপোর্ট উপহার দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
তাদের কত % আমেরিকান রক্ত, কত % ইউরোপিয়ান আর কতটা আফ্রিকান, এই হিসাবটা। এটা করা
বেশ সোজা। মনে করে দেখুন, স্নিপ হচ্ছে বা/বী(রাঙ্গনা) এই একটা অক্ষরের হেরফের।
আমরা আন্তর্জাতিক ডেটাবেস থেকে যেসব প্রচলিত মুদ্রণপ্রমাদ দুনিয়াজুড়ে ভালরকম
স্টাডি করা হয়েছে তাদের একটা তালিকা নিলাম, আর তার থেকে ৪০টা স্নিপ বেছে নিলাম এই
দেখে যে তারা এই জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে স্পষ্টভাবে আলাদা।
সহজে বুঝতে গেলে আসুন দুটো স্নিপ নিই। এক্ষেত্রে
হিসেবটা এইরকম - ১ নম্বরটা সম্পর্কে আমরা জানি যে ‘বী’ শুধু ইউরোপে দেখা যায়,
আফ্রিকায় ‘বা’। ২ নম্বরটার ইউরোপে দেখা যায় ম(রু) আর আফ্রিকাতে গ(রু)। এইবার একটা
লোকের এই দুটো ঘরে কোন কোন অক্ষর আছে গুনে নিয়ে, কোনটা কোন জাতির সেই অনুপাতটা কষে
নিলেই হিসাব রেডি। যে বী+ম সে ১০০% ইউরোপিয়ান, যে বা+গ সে ১০০% আফ্রিকান, আর বাকি
দুটো কম্বিনেশনে ফিফটি-ফিফটি।
(চল্লিশটা নেওয়া হয়েছিল কারণ যত কম নেব তত কম খরচ,
অথচ মোটামুটি প্রিসিশন পাওয়া চাই। এর সঙ্গে আলিবাবার কোনো সম্পর্ক নাই।)
একই ভাবে পিতৃত্বর হিসাবটাও করা যায়। যদি কারো
বাবার আর মায়ের দুজনেরই ‘বা’ থাকে, কিন্তু তার নিজের থাকে ‘বী’, তার মানে এইখানা
সে অন্য কোনো উৎস থেকে পেয়েছে – হয় সে দুজনের দত্তক নেওয়া সন্তান, নয়ত সে তার
সামাজিক পিতার বায়োলজিকাল চাইল্ড নয়।
(কেবল দুয়েকটা জায়গায় হেরফের হলে সেটা স্বতন্ত্র
মিউটেশন, বা স্রেফ ডেটা এরর বলেও ধরে নেওয়া যেত, কিন্তু যেহেতু আমাদের হাতে এখন
কয়েক মিলিয়ন ঘর মেলানোর উপায় আছে, অনেকটা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। এবং কাজ করতে করতে
যদি এরকম অপ্রত্যাশিত কিছু চোখে পড়েই যায়, সেটা ভলান্টিয়ারদের না জানানোর জন্য কড়া
প্রোটোকল থাকে।)
***************************
তো আমরা যখন সব ভলান্টিয়ারদের জন্য এই ডেটাগুলো
নেড়েচেড়ে দেখছিলাম, তখন দেখতে পেলাম যে দুনম্বর ক্রোমোজমে দুটো স্নিপ হাইলি
সাসপিশাস – তারা চুলের প্রকারভেদের সঙ্গে খুব স্পষ্টভাবে জড়িত (চোখের রঙের গল্পটা
মনে করুন)। চুলের রকমফের জিনিসটা খুব সহজেই চোখে পড়ে – চীনাদের চুল কালো, নিপাট
সোজা এবং পুরুষ্টু তাই স্বাস্থ্যবান, আমেরিকায় দেখেছি চীনা যুবতীদের চুল নিয়ে
শ্বেতাঙ্গী যুবতীদের কত ঈর্ষা। ইউরোপের দিকে ব্লন্ড ব্রুনেট ইত্যাদি হালকা রঙের
ঢেউখেলানো চুলের হার বেশি, আর আফ্রিকার কালো কোঁকড়া চুল তো সবাই চেনেনই। এরকম
প্রকট একটা জেনেটিক লক্ষণের উপর ন্যাচারাল সিলেকশনও বেশি হবার সম্ভাবনা।
নিচের ছবিটায় চল্লিশটা স্নিপের জন্য সিগনাল
স্ট্রেংথের গ্রাফ দেখতে পাবেন; তলার অক্ষে কোনটা কত নম্বর ক্রোমোজমের মধ্যে বসে
সেই সংখ্যা। ওই দুটোর নাম দিলাম S1, S2.
আমরা ঠিক করলাম, এটা আরো ভাল করে তদন্ত করা দরকার।
যেহেতু যত ডিটেলে পড়া হয় তত খরচা বেশি, বেছে অল্প কিছু লোকের স্যাম্পল বিশদ জিন
পাঠের জন্য পাঠানো হল, যাতে প্রায় আধা মিলিয়ন SNP এর তথ্য আসবে।
সেখান থেকে দেখলাম ওই দুটো স্নিপ ‘ইডার’ নামে একটা
জিনের মধ্যে বসা, এবং ওই জিনের বাকি অনেকগুলো স্নিপের সঙ্গেও সিগনাল স্ট্রেংথ বেশ
বেশি। এই জিনের মধ্যে থাকা সবকটা স্নিপের জন্য সিগনাল স্ট্রেংথের গ্রাফ পরের
ছবিটায়।
সবচেয়ে বেশি যে স্নিপটার সঙ্গে (নাম দিই S*),
প্রকাশিত পেপারটেপার ঘেঁটে দেখা গেল যে এটা ভালমতই জানা সেটা একটা বড় প্রোটিনকে
বদলে দেয়, যার ফলে চুলের গঠনের পরিবর্তন হয়; দেখা গেছে ইঁদুরের উপর এক্সপেরিমেন্ট
করে – যেসব ইঁদুরকে ধরে ওটা বদলে দেওয়া হয়, তাদের শজারুর মত খাড়া খাড়া রোম হয়ে
ওঠে!
তাহলে ইঁদুরের চুল যদি মোটা আর শক্ত হয়ে যায়,
তেমনটাই মানুষের হওয়াও বিচিত্র নয়। ওই S* স্নিপটার দুরকম ছাপার প্রকারভেদ – নাম
যদি দিই A আর B, তাহলে A দেখা যায় ইউরোপ আর আফ্রিকায়, ওদিকে B দেখা যায় চীনে,
স্পষ্টতই সেখান থেকে আমেরিকায় এসেছে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জনগোষ্ঠীর পথ ধরে। আমাদের
লোকেদের মধ্যে দেখা গেল, যত আমেরিকান রক্তের অনুপাত বাড়ে ততই B-র অনুপাতও বাড়ে, আর
সেই সঙ্গে বাড়ে সোজা চুলের অনুপাত।
এর পরের কাজ ছিল আরেকটা আন্তর্জাতিক ডেটাবেস থেকে
দুনিয়ার কোন জনজাতিতে A/B কোনটার অনুপাত কেমন সেটা খুঁজে বের করে আমাদের ওই
অনুমানকে প্রতিষ্ঠিত করা। উপরে ম্যাপটায় সেটাই দেখানো হয়েছে, হলুদ দিয়ে A আর সবুজ
দিয়ে B – হলুদটাকে আদিম বলা হচ্ছে কারণ ওটাই প্রথমে সবার মধ্যে ছিল, মানে সব
আফ্রিকান আদিম মানুষের মধ্যে কেবলমাত্র A টাইপটাই ছিল। সত্যি বলতে ওটা তখন স্নিপ-ও
ছিল না কারণ কোনো মুদ্রণপ্রমাদ তখনও শুরুই হয় নি। সেভাবেই ইউরোপেও গেল। কিন্তু
পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার পথে কোনো এক সময় মিউটেশন হয়ে ওখানে B-এর আবির্ভাব হয়, এবং
সেটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ওই দিকে।
সবুজ-হলুদ চাকতিগুলো সরল পাই চার্ট – কোন
জনগোষ্ঠীতে A/B দুটোর অনুপাত কেমন তাই দেখায়। আফ্রিকা, ইউরোপ এবং ভারতে প্রায় সবাই
হলুদ, অন্যদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত সবুজ, এবং সেই অনুযায়ী পুরো
উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকাতেও। (পাই-গুলোর উপরে জনগোষ্ঠীর নাম, এই যেমন Isrl. = Israel,
JPT = Japanese from Tokyo, Mel. = Melanesian ইত্যাদি।)
অতএব আমাদের তদন্ত এখানেই সমাপ্ত করা গেল, একাধিক
তথ্যপ্রমাণ দ্বারা ইডার জিনের ওই বিশেষ স্নিপটিকে অভিযুক্ত সাব্যস্ত করা গেছে, এবং
তার (বিবর্তনীয়) গতিবিধি-কর্মপন্থা সবই ধরে ফেলা গেছে। এরপর কবিদল কোনো সুন্দরীর
অলকদাম নিয়ে উচ্ছ্বাসগাথা রচনা করার সময় তার মধ্যে ইডারের জন্যও দুয়েকটা
প্রশস্তিবাক্য রাখবেন আশা করি!
***************************
মুদ্রণপ্রমাদ যে কতদূর সব ঘেঁটেঘুঁটে দিতে পারে তা
নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ে গেল, সেটা বলেই শেষ করি। সেটা মধ্যযুগের কথা, ছাপাখানা
তখনও বহুদূর, চার্চে চার্চে রাখা থাকত বাইবেল ইত্যাদি পুরোনো পুঁথি আর নবীন
সন্ন্যাসীরা কষ্ট করে সেসব হাতে হাতে কপি করত। তা সদ্য চার্চে যোগ দেওয়া এক উৎসাহী
যুবকের মনে হল, আমরা কপি করছি গত প্রজন্মের লিপিকারদের থেকে, তারা করেছে তার আগের
প্রজন্মের থেকে, এইভাবে চলে এসেছে; মূল পুঁথিগুলো ডেলিকেট তাই সেগুলো কেউ নাড়াচাড়া
করে না – কিন্তু যদি কেউ একবার কপি করতে কোনো ভুল করে, সেই ভুলটাই তো তার পর থেকে
প্রচলিত হয়ে যেতে থাকবে? কেন না আমি একটু কষ্ট করে চার্চের মূল ভল্টে গিয়ে মূল
পুঁথিটার থেকেই কপি করি?
তাকে নিয়মিত ভল্টে যেতে দেখে একদিন প্রধান পাদ্রীর
কৌতূহল হল, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন ব্যাপার কি। ব্যাখ্যা শুনে বৃদ্ধের মনে হল,
আরে তাই তো, এমনভাবে কেউ এতদিন ভাবে নি কেন? এরপর তিনিও সারাদিন কাজের শেষে
রাত্রিবেলা পড়াশুনা করতে ভল্টে যাওয়া আরম্ভ করলেন।
একদিন মাঝরাত্রে তিনি ভল্ট থেকে “ইউরেকা, ইউরেকা”
বলে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এলেন। শোরগোল শুনে সবাই চার্চ ইয়ার্ডে দৌড়ে এল। তিনি
উত্তেজিত গলায় বললেন, “এতদিন আমরা সবাই একটা r মিস করে চলেছিলাম!” কেউ কিছু বুঝতে
না পেরে হাঁ করে চেয়ে আছে দেখে তিনি বললেন, “আমাদের প্রতি অধ্যাদেশের শব্দটা ছিল
celebrate!”
এই লেখা আগে সচলায়তনে লেখকের নিজের ব্লগে প্রকাশিত। এখানে আবার লেখকের অনুমতিক্রমে প্রকাশ করা হলো।