নিজের বিয়ে
আগতপ্রায়, তাই এই অবস্থায় বিয়ে নিয়ে বেশি বাঁদরামি করাটা মনে হয় না উচিত হবে তবু
সামান্য কিছু লেখার লোভ সামলাতে পারলুম না। কোথায় যেন পড়েছিলাম যে দেশে রাজনৈতিক
বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক এবং গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণই হল
ক্রম-বর্দ্ধমান বিয়ে।
নাহ্ লেখার
শুরুতেই গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীতে চলে যাওয়া উচিত নয়। তার চেয়ে বরং বাচ্চাদের দিয়েই
শুরু করি। যেকোন বিয়েতেই বাচ্চাদের খুব আনন্দ। বিয়েবাড়ি গেলেই দেখা যায় নানা
সাইজের বেশ কিছু বাচ্চা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ছুটছে, লাফাচ্ছে, রসগোল্লা খাচ্ছে,
নিমন্ত্রিতদের পা মাড়িয়ে বা মাথার চুল টেনে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, কখন আবার আছাড়
খেয়ে তারস্বরে কান্না জুড়ে সারা বিয়েবাড়ি মাথায় করছে! কিন্তু বাচ্চা ছাড়া বিয়েবাড়ি
ভাবাই যায় না।
ছবি: সুনন্দ |
এরকমই এক
নিষ্পাপ শিশুর পুরনো গল্পটা এই ফাঁকে বলে ফেলি। বাচ্চা মেয়েটি তার পুতুল নিয়ে
খেলছিল। ঘটনাচক্রে তার মা সেই একই ঘরে তাঁর বান্ধবীদের সঙ্গে পাড়ার একটি
সাম্প্রতিক বিয়ে নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। পাত্র-পাত্রী তাদের বাবা-মার কথা না শুনে
নিজেরাই আলাপ করে বিয়ে করেছে, এটাই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। হঠাৎ মেয়েটি তার মাকে
জিজ্ঞেস করল, “মা, তোমার কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল?”
মা বললেন,
“কেন? তোমার বাবার সঙ্গে!”
মেয়েটি চোখ বড়
বড় করে বলল, “ছি ছি! এত চেনাশোনার মধ্যে!”
বিয়ের আগের
পর্ব হল পছন্দের মানুষকে খুঁজে বের করা। যদিও আজকাল সব্বাই প্রেম করে বিয়ে করছে
দাবী করে তবু ঐ ঘটকালীর ওয়েবসাইটগুলোর এত রমরমা কিন্তু অন্য কথা বলে। আমার তো মনে
হয় বেশ কিছু মানুষের অবসর পরবর্তী জীবনের প্রধান কাজই হল তাঁর বিবাহযোগ্য ছেলে বা
মেয়ের জন্য ঐ সাইটগুলোতে একটা প্রোফাইল বানিয়ে প্রচুর লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা। আমার
রসিক ভাবী অর্ধাঙ্গিনী মাঝে একটি সাইটে নিজের প্রোফাইল বানিয়েছিল, সঙ্গে আমার ফোন
নম্বর দিয়ে। পরদিন ফোন পেলাম, “অমুক সাইট থেকে বলছি, শ্রেয়সী তালুকদারের নামে
একটা প্রোফাইল বানানো হয়েছে, উনি আপনার কে হন?”
গম্ভীর হয়ে
বললাম, “বউ।” শুনলাম ওপাশের লোকটি বিড়বিড় করে, “পাগল, ছিটগ্রস্ত, কোত্থেকে
জোটে...” এইসব বলতে বলতে ফোন রেখে দিল!
ছবি: সুনন্দ |
ঘটকালী করেই
হোক বা নিজে প্রেম করেই হোক, তাও অনেক অনেক বিয়ে হচ্ছে। বিশেষ করে
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি বা জুলাই-আগস্টের মত বিয়ের মরশুমের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এমন
অবস্থা যে আগে থেকে ঠিক করে না রাখলে বিয়েবাড়ি
পাওয়াই মুশকিল হবে। আর মুশকিল হল
বিয়ের ছুটি পাওয়া। ব্যঙ্গালরে এসে এতগুলো বন্ধুর বিয়ে মিস্ হয়ে গেছে যে এক সময়ে
সন্দেহ হচ্ছিল যে নিজের বিয়েতেও হয়তো ছুটি না পাওয়ার কারণে অনুপস্থিত থাকতে হবে।
শেষ পর্যন্ত ছুটি নিয়ে যাচ্ছি বিয়ে করতে, তবুও এই প্রসঙ্গে আর একটা পুরনো গল্প বলে
ফেলি,
একটি অফিসের এক
তরুণ কর্মচারী বড় সাহেবের কাছে ছুটির আবেদন পাঠিয়েছে। বড় সাহেব তাকে ডেকে পাঠিয়ে
বললেন, “কি ব্যাপার হে, পনেরো দিনের ছুটি চাও। কোথাও যাবে-টাবে নাকি?”
ছেলেটি মাথা
নিচু করে লাজুক কণ্ঠে বলল, “আমার এক বান্ধবীর বিয়ে স্যার।”
“বান্ধবীর
বিয়েতে পনেরো দিনের ছুটি, ইয়ার্কি পেয়েছ!” বড় সাহেব গর্জে উঠলেন!
ছেলেটি আরো
লাজুকভাবে প্রায় মাটিতে মিশে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে না স্যার। আমার বান্ধবীটি আমাকেই
বিয়ে করছে কিনা!”
(মূল গল্পে
ছেলেটি ‘বন্ধু’ই বলেছিল, তবে আমি ছেলেটিকে অকারণে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে
‘বান্ধবী’ লিখলাম যাতে কোন অস্পষ্টতা না থাকে!)
বিয়ের দিনের
কথা তো ছেড়েই দিলাম। নান্দীমুখ, গায়ে-হলুদ থেকে শুরু করে সিঁদুরদান, বাসর অবধি
মজার গল্পের অভাব নেই। মেয়েকে পিঁড়িতে করে ক পাক ঘোরানো হল সেই নিয়ে খুনসুটি থেকে,
নাপিতের ছাদনাতলায় ছড়া কাটা কিম্বা মালা বদলের সময় কোলে করা পাত্র-পাত্রীকে তুলে
ধরে ‘ছেলে বড় না মেয়ে বড়’ জাতীয় ইয়ার্কি-ঠাট্টা হয়েই থাকে। তবে আমার বন্ধুদের
ক্ষেত্রে একটা সুবিধা হয়েছিল। আমি যে পক্ষে থাকতাম, আমার উচ্চতার সুবাদে তারা সব
সময়ই ওপর পক্ষের এক ধাপ ওপরে থাকত।
তবে কোন কোন
বিয়েতে সেরকম নিয়মনিষ্ঠ পুরুত ঠাকুর থাকলে তাঁর নিয়মকানুন আর একঘেয়ে মন্ত্রপাঠের
চোটে বর-কনে থেকে শুরু করে অন্যান্য আমন্ত্রিতদের ও বিরক্ত করে তোলেন। চুপি চুপি
বলে রাখি, নিজের বিয়েতেও এই ব্যাপারটা নিয়ে চাপে আছি, ভাবছি বিয়েবাড়ি গিয়েই সামান্য
দক্ষিণা দিয়ে আমার বিয়ের পুরুত ঠাকুরটিকে হাত করে ফেলব।
বিয়েবাড়ির
খাবারের গল্প বলে শেষ করি। আমার কাছে তো বিয়েবাড়ি মানেই খাওয়া। প্রথমে ছোট ছোট
চিকেনের টুকরো ভাজা দিয়ে শুরু করে শেষ পাতের পান-আইসক্রিম অবধি কোনকিছুই আমি
পারতপক্ষে ছাড়ি না। আর আগে খাওয়ার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় লাগত বিয়েবাড়ির মেনুকার্ড! ঐ
ছোট্ট কাগজের টুকরোতেই ক্যাটারার কোম্পানি তাদের কেরামতি দেখাতেন। কখনো পদ্য, কখনো
খেলার ধারাবিবরণী আবার কখনো বা সংবাদপাঠের আড়ালে লেখা থাকত খাবারের নাম। সেই বুফের
আগের যুগে ঐ মেনু কার্ড দেখেই তো ঠিক করা হত পরের খাবারগুলোর জন্য কতটা জায়গা রাখা
হবে। তবে সেই নিয়ে গন্ডগোল ও কম হত না। বাবার কাছে এক বিয়েবাড়ির গল্প শুনেছিলাম।
সেখানে খেতে বসে বাবা দেখে যে মেনুকার্ডে নানাবিধ অজানা-অচেনা জিনিসের নাম আছে।
তারমধ্যে থেকে ফ্যাঁজা নামক একটি বস্তু বাবাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। বাবা ভেবেছিল,
ওটা হয়তো কোন ফরাসী রান্না, তাই সেটার আগের জিনিসগুলো কম করেই খেয়েছিল। আসল সময়ে
দেখা গেল ফ্যাঁজা আর কিছুই নয়, নানারকম সবজি মিশিয়ে একটা চচ্চড়ি! ক্যাটারার
কোম্পানি কায়দা করে সেটাকে ফ্যাঁজা বলে নামকরণ করেছিল!
ছবি: সুনন্দ |
যাই হোক, ভালোয়
ভালোয়ে নিজের বিয়েটা নামিয়ে ফেলতে পারলে বেঁচে যাই। তারপর তো অন্য অ্যাডভেঞ্চার!
কয়েক মাস পর আবার বিবাহ পরবর্তী কিছু মজার গল্প নিয়ে ফেরত আসব বলে আশা করছি।
শুরুতে
গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীদের কথা ছিল। তাদের নিয়ে একটা গল্প লিখেই শেষ করি। বলাবাহুল্য
এটাও টোকা আমার আর এক প্রিয় লেখকের গল্প থেকে।
সংক্ষেপেই
লিখি, হিমালয়ের পাদদেশের এক গুহায় পাঁচজন সন্ন্যাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
একটু পরেই তাঁদের ষষ্ঠ সঙ্গীটি গাঁজা কিনে ফিরে আসবেন। তা সেই ষষ্ঠ জন আসার পর
মিলে সবাই বসলেন গঞ্জিকাসেবনে। হঠাৎ তাঁদের মধ্যে একজনের চোখে পড়ল এক টুকরো খবরের
কাগজ, গাঁজা আনা হয়েছিল ঐ পুরনো খবরের কাগজে মুড়ে। তিনি সংসারী থাকার সময় পড়াশুনো
শিখেছিলেন। এতদিন পর বহির্জগতের খবর দেখে আকৃষ্ট হয়ে কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন, হঠাৎ
একটা খবর পড়ে বিকট কণ্ঠে, “মরেছে, মরেছে, লাইন ক্লিয়ার!” বলতে বলতে উদ্দাম নৃত্য
করতে লাগলেন। তারপর নিজের ঝুলি কাঁধে নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা হলেন। যে পাঁচজন পড়ে
রইলেন তাঁরা খবরের কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখলেন। তাঁদের ভাগ্য এখনও অতটা সুপ্রসন্ন
নয়।