উৎস |
আমার যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন শিলুমাসি খুব আসত আমাদের বাসায়। আমাকে তেল মাখিয়ে চান করিয়ে, খাইয়ে দাইয়ে তারপর যেত। আর এর ফাঁকে ঝুড়ি ঝুড়ি গপ্পো শুনতাম আমি, মাসির মুখে। মাসি আমাদের কেমন একটা দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হয়। নানান গপ্পের মধ্যে একটি দু’টি আমার আজও মনে পড়লে গা কেমন শিউরে ওঠে...
যাযাবর এসেছিলো সেবার শীতে শিলুমাসিদের গ্রামে।
"যাযাবর কি মাসি?"
"ঘুরে বেড়ায় তারা দেশে বিদেশে, কখনো এক জায়গায় থাকে না, অনেক রকম জাদুটোনা জানে তারা..."
অল্পে আমার কৌতূহল ক্ষান্ত হয় না, মাসিও আমার সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে থাকে।
সন্ধ্যে বেলা তারা নানা রকম খেলা দেখাতো, পয়সাও পেত গ্রামের লোকদের কাছ থেকে। কামু খেলা দেখতে যেত প্রায়ই, দিনের বেলাতেও মাঝে মধ্যেই চলে যেত, ওই দলের লোকেদের সাথে গিয়ে ভিড়তো।
কামু গ্রামেরই মেয়ে। শিলুমাসি তখন পাঁচ, কামুর বয়স পনেরো কি ষোলো। সেদিনই শেষ দিন পৌষের। কামু ওর বাবার সাথে গেছিলো খেলা দেখতে, ওই যাযাবরদের কাছ থেকে একটা পাথরের লকেটও নিয়ে এসেছিলো। অদ্ভুত দেখতে বাদামি একটা পাথরের লকেট, ধরতে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।
পরদিন যাযাবরেরা চলে যাবার সময়, শীতলা মন্দিরের বুড়ো পুরুত দেখলো, কামুও চলেছে ওদের সাথে সাথে, মন্ত্র মুগ্ধের মতো। গলায় ঝুলছে সেই মায়াবী লকেট। ব্যস হৈ হৈ পড়ে গেল, গ্রামের লোক পিটিয়ে তাড়াতে বাকি রাখে যাযাবরদের আর কি!
"কামুদির চোখ তখন লাল লাল, গায়ে কেমন উত্তাপ, মুখে কোনও কথা নেই।"
সকলে বললো জাদু করেছে কামুর ওপর যাযাবরে।
"তুমি দেখেছিলে সব শিলুমাসি?"
"আমি তো ছোট, কিছু মনে আছে, বাকি শোনা কথা বড়দের মুখে।"
কামুর হাত পা বেঁধে ওঝা এনে ঝাড়ফুঁক শুরু হলো, দিন তিনেক বাদে তার বিপদ কাটল।
"তারপর ঠিক হয়ে গেল কামু?"
"সবাই তো বললো ঠিক হয়ে গেল, কিন্তু কামুদি আর বিশেষ কথা বলতো না তার পর থেকে, ওই লকেটটাও খুলতো না গলা থেকে। বাড়ির সবাই খুব জোর করে একদিন সেটাও কেড়ে নিলে।"
"তারপর?"
"তারপর আর কি, চুপচাপ থাকতো, বেশি কথা বলত না..."
"সে তো বললে, তোমার কি ঘুম পাচ্ছে শিলুমাসি?"
দুপুরে মাদুর পেতে আমাকে নিয়ে শুয়েছে মাসি, প্রায়ই গল্প বলতে বলতে এমনি সে ঘুমিয়ে পড়ে।
একবার তো ঘুমের ঘোরে কি একটা গল্প বলতে বলতে বলে ফেলেছিলো "মাছের ঝোলে ধইন্যাপাতা.."
আজও আমাদের বাড়ির সবাই শিলুমাসির কথা উঠলে ওই মাছের ঝোলের ব্যাপারটা বলে হাসাহাসি করে।
কামুর গল্পের শেষটা বিশেষ কিছু নয়, ওর লকেট টকেট কেড়ে নিয়ে, ওকে অন্য এক গ্রামে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই কামু অদ্ভুত ভাবে মারা যায়। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠে কেমন গোঙানি দিয়ে, সে বিশ্রী বর্ণনা... সেই যাযাবরের জাদুর বিষ নাকি রয়ে গেছিলো শরীরে।
যখন এই গল্প শুনি, আত্মহত্যা ব্যাপারটা বুঝতাম না। কামুর ভালো নাম ছিলো কমলিনী। এমন কি হতে পারে, যে সেই যাযাবরের দলে কাউকে কমলিনী তার মন দিয়েছিলো, বদলে অভিজ্ঞান হিসেবে পেয়েছিলো সেই লকেট? এমন কি হতে পারে, কমলিনীর মন আসলে ঘরে থাকবার নয়, যাযাবরের?
শিলুমাসি ছিলো অবিবাহিতা, ভাইঝি ভাগ্নিদের নিজের ছেলে মেয়ের মতো আদর করতো। শিলুমাসি কেন সারা জীবন একা রয়ে গেল সেটাও অমনই এক মাদুর পাতা দুপুর বেলায় গল্পের ছলে বোধহয় বলেছিলো আমায়, কিন্তু কমলিনীর গল্পের মতন সেই গল্পটাও সেদিন বুঝিনি।
এই কমলিনী, সুশীলারা বড় সামান্য সব মানুষ, এরা কেউ কোনও ঝড় তুলতে পারেনি কোথাও, অন্তত বৃহত্তর পরিধিতে। শুধু মাঝে মাঝে যখন আকাশ লাল হয়, পরীক্ষার খাতা দেখতে ইচ্ছে করে না, জীবনের অসংখ্য ভুলকে ঠিক বলে মনে হয়, তখন মনের ভেতর যে একটা বেয়ারা ঘোড়া রয়ে গেছে- ইচ্ছে করে ছুটিয়ে দি তাকে দুনিয়ার নিয়ম ও পদ্ধতির ওপর দিয়ে। কমলিনীর লাল চোখ আর উত্তপ্ত গালে জল বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তখন। মনে হয় নিজের গলার কাছে দলা পাকানো আর কিছু নয় - যেন একটা বাদামি লকেট, মায়াবী দেখতে আর ধরতে কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা।