উৎস |
কল্পনায় ভাবার চেষ্টা করেছি এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আমি কি করবো। ভেবেছি, যা হবে দেখা যাবে। যেভাবে হোক, বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমার এই ভাবনাটা সেদিন আর কল্পনার পর্যায়ে থাকলো না। কয়েকবছর আগের ঘটনা, যখন পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কার্যালয় থেকে একটি পেশাগত মিটিং সেরে বেরোচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরেই বাইরে থেকে একটা সম্মিলিত কোলাহল কানে আসছিলো। কনফারেন্স-রুমে থাকায় কিছুই বুঝিনি। মিটিং-শেষে বেরিয়ে দেখলাম, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের বিল্ডিং এর সামনে প্রায় হাজার খানেক ছেলেমেয়ে। কান পাততে জানা গেলো - এঁরা বেসিক-ট্রেনিং-প্রাপ্ত বেকার ছেলেমেয়ে, যাঁরা প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন, কিন্তু প্রাইমারি-টিচার্স-ট্রেনিং-ইন্সটিটিউট উত্তীর্ণ। সে কারণে এঁদের দাবি ছিলো এঁদেরকে চাকরির নিয়োগপত্র দিতে হবে। অনেকের এমনও দাবি, যে অনেক নেতা-মন্ত্রীই নাকি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এঁদের থেকে লাখ-লাখ টাকাও নিয়েছেন। এখন তাই তাঁরা বিক্ষোভে ‘মজা’ দেখাতে সম্মিলিত হয়েছেন আর প্রাথমিক শিক্ষা-পর্ষদের ভবন ঘেরাও করেছেন। এখন আর ভবন থেকে কাউকে বেরোতে দেওয়া হবেনা এবং ‘পজিটিভ রেসপন্স’ না পেলে তাঁরা বৃহত্তর আন্দোলন (অর্থাৎ ভাঙচুর, মারধোর, অগ্নিসংযোগ) শুরু করবেন।
প্রথমে ভাবলাম, গিয়ে যদি বুঝিয়ে বলা যায় আমরা এখানে কাজ করিনা, এখানে এসেছি মিটিং-এ, তাহলে হয়তো আমাদের ছেড়ে দেবে। আমাদের তরফ থেকে দু’জন প্রতিনিধি এগিয়ে গেলো কথা বলতে। সমস্বরে হইহই চিৎকার করে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হলো। ততক্ষণে পুলিশ এসেছে শুধুই ডাণ্ডা হাতে ঠাণ্ডা করতে। তারা আমাদের নির্দেশ দিচ্ছে ঘরে ঢুকে খিল আটকে বসে থাকতে। অনেকে তাই করলো। আমরা কয়েকজন ভেতরে না গিয়ে বিল্ডিং-ক্যাম্পাসেই ঘুরঘুর করতে থাকলাম - যদি ভেতরে থাকলে অফিসের লোক ভেবে পেটায়? অপেক্ষায় থাকলাম, যদি এক-ফাঁকে জনতার ভিড়ে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, বা পিছন দিক দিয়ে বেরোনোর পথ পাওয়া যায়।
ততক্ষণে দলের কিছু ষণ্ডাগুণ্ডা ছেলে, চেয়ারম্যানের সাথে আপোষ করতে ভেতরে ঢুকেছে শ্লোগান দিতে দিতে। তারা বেরিয়ে এলো হতাশ হয়ে – “ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও...” চিৎকার করতে করতে। বাকিরা ততক্ষণে প্রস্তুত হচ্ছে মেন-গেট ও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢোকার। গেটের বাইরে হাজার খানেক উন্মত্ত ছেলের চিৎকার-হাততালি-লাফালাফি। ভাবতে অবাক লাগছিলো এই তরুণেরা শিশুদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হতে চায়! এত ধ্বংসাত্মক মানুষগুলোর হাতে ন্যস্ত হবে অগুনতি কচিকাঁচার প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব! ভাবছিলাম, এটাই কি এদের আসল রূপ, নাকি বেকারত্বের গ্লানি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এই সুশিক্ষিত, সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েগুলোর ভদ্রতার আবরণ?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কেটে যাচ্ছিলো উদ্বেগের প্রহর। কি করণীয় বুঝতে পারছি না। এভাবে কতক্ষণ আটকে থাকবো? পুলিশ এতটুকু অভয় দিচ্ছে না। জেদ চেপে গেলো - যেভাবেই হোক এখান থেকে বেরোতে হবে। শুধু আমায় নয়, আমার মত অনেককে। পালাতে হবে। বিল্ডিঙের পিছন দিকে হাঁটা দিলাম, ঘন ঝোপ আর ঢাকা-নর্দমা ডিঙিয়ে। পুরো বিল্ডিংটা ঘিরে কাঁটা তারের পাঁচিল। একটা জায়গা ফাঁকা – একটা জল-ট্যাঙ্কের লাগোয়া পাঁচিলের অংশ। ট্যাঙ্কের উপরে উঠলাম। মহিলাদের গায়ে শাড়ি, কারোর কারোর বয়স চল্লিশের ওপর। তাদের টেনে তোলা হলো। ট্যাঙ্কের উপর থেকে পাঁচিলটায় উঠে ছেলেরা টপাটপ লাফ দিলো। মেয়েরা, যারা পারলো, পাঁচিলে চড়ে বসলো। আমিও। তারপর মাথা ঘুরে গেলো।
ওদিকে তো প্রায় দেড়-মানুষ লাফাতে হবে! শাড়ি পরে পারবো? হাল ছেড়ে দিলাম। ছেলেরা, যারা পাঁচিল টপকে গেছে, তারা বললো, “লাফ দিন, আমরা ধরবো”। কিন্তু শুধু নিজে লাফালে তো হবে না। সঙ্গী-সহকর্মীরা তো পাঁচিলে উঠতেই পারছে না। কিন্তু তারাও ছটফট করছে বেরোনোর জন্য। মনে পড়লো, একবার এক বন্ধু আমার মতোই মোটা একজন মানুষকে পাঁচিলে তুলেছিলো ঊরু পেতে। একই ভঙ্গিতে আমিও ট্যাঙ্কের ওপর বসে পড়লাম। আমার পায়ে ভর দিয়ে ওরা পাঁচিলের নাগাল পেয়ে গেলো। তারপর ঝাঁপ। ওদিকের উদ্ধারকারী-দল তখন অসাধারণ দক্ষতায় আর অদ্ভুত কায়দায় এক এক করে ক্যাচ ধরছে। কলিগদের পার করে দিয়ে ব্যাগ-জুতো-ফাইল রেখে, কোমরে আঁচল গুঁজে পাঁচিলে উঠলাম। এদিকে আমার আবার ভার্টিগো (সে গল্প আর একদিন হবে) - যদি পড়ে যাই! আমি পারবো না! ওরা বললো, “আমরা ধরবো - তুই ঝাঁপ দে”। দিলাম ঝাঁপ। প্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের মতো আনন্দ পেলাম। আমাদের কেউ বন্দী করতে পারেনি। আমরা পালিয়ে গেছি। বিপদ থেকে অনেক দূরে।
পুনশ্চ: এই ঘটনার পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক-নিয়োগ সবে সম্পূর্ণ হয়েছে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকে প্রাথমিক শিক্ষকতায় যোগদানও করেছে পরীক্ষায় সফল হয়ে, আবার পরিচিতদের মধ্যে অনেকে দুর্ভাগ্যবশত সেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে স্বচ্ছতার নিরিখে দোষারোপ ও পাল্টা-দোষারোপের পালা এখনো চলছে টেলিভিশনের পর্দা থেকে শুরু করে সর্বত্র। কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনার আলাদা করে কোনো গুরুত্ব আর নেই। শুধু আমার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে সেদিনের সেই হিংস্র মুখগুলো। জানিনা সেই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ক’জন শিশুশিক্ষার মত সংবেদনশীল কাজে যোগদান করেছে! আশা রাখি নবনিযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই গুরুভার পালন করবে।