উৎস |
২০১৫ সালে প্যারিসে গোটা পৃথিবীর ১৯৫টি দেশের প্রধান ও প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে, ইতিহাসে প্রথম চুক্তিবদ্ধ হয়, যে মানুষের কীর্তিকলাপের ফলে এই গ্রহের গড় তাপমাত্রা এমনভাবে বাড়তে চলেছে, যে এখুনি ব্যবস্থা না নিলে ব্যাপার বিচ্ছিরি দিকে (পড়ুন পৃথিবীব্যাপী বন্যা, খরা, খাদ্যসঙ্কটে মানবজাতির অবলুপ্তি) যাবে। এই ‘ব্যবস্থা’ প্রতিটি দেশ নিজে নেবে এবং কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বা সম্ভব, তা তারা নিজেরাই নিজেদের বিচারবুদ্ধি মতে ঠিক করবে। মাত্র দু’টি দেশ – সিরিয়া এবং নিকারাগুয়া এই চুক্তিতে সই করেনি। প্রথম দেশটির এখন ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ (দেশটা আগে নিজে টিকুক, তারপর না হয় পরিবেশ নিয়ে ভাববে’খন)। দ্বিতীয় দেশটির সই না করার কারণ – চুক্তির বয়ান আরও কড়া এবং পরিবেশ-বান্ধব হওয়া উচিত ছিল (একদম ঠিক পড়েছেন – নিকারাগুয়া পরিবেশ বিষয়ে দেশেদের মধ্যে নকশাল)। তা, এমতাবস্থায়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (মনশ্চক্ষে যাকে দেখতে পেয়ে নজরুল “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে” লিখে ফেলেছিলেন) সদ্য ইউরোপ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে দেখলেন গোটা পৃথিবীর রাষ্ট্রনেতারা তাঁকে নিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক খিল্লি করছেন। এতে বেজায় খচে গিয়ে ওঁর মনে কি হলো জানা যায়না, তবে পরের দিনই ঘোষণা করলেন -–আমেরিকা ওইসব চুক্তি-ফুক্তি পাত্তা দেয় না। স্বপ্নে পেয়েছেন, যে ওইসব মানতে গেলে আমেরিকার নাকি বিশ্শ্শ্শাল ক্ষতি হবে, আর তাই আমেরিকা ওতে আর নেই। মানে, আমি তোদের সঙ্গে নেকুপুশু খেলায় আর নেই - নেকাপড়ায় গোল্লা পেলেও আমার পকেট ভারী। যা, ভাগ্!
ভাল, খুব ভাল। কিন্তু এতে আমার, আপনার, বুলাদির বা ভুতোর মায়ের কি যায় আসে? কি হবে এই জাহাজের খবর রেখে? উত্তর হ’লো, খুব খুব খুব যায় আসে। খবর রাখা শুধু নয়, এ নিয়ে রীতিমতো চর্চা করতে হবে আমাদের। শুধু কলেজি পড়ায় না, পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকানে, খবরের কাগজে, চিল্লানোসরাস খবর-পড়িয়ের খবরে, মায় মুখ্যমন্ত্রীর ছড়াতেও চলে আসা উচিত এই প্রসঙ্গ। কেন, কবে, কোথায়, কিভাবে – সে সব নিয়েই এই লেখা। জানতে গেলে পড়ে ফেলতে হবে।
“বুড়ো বলল, ‘তাহলে লিখে নাও- উষ্ণতা একষট্টি ফারেনহাইট, বয়স সাড়ে চার (বিলিয়ন)।’ আমি বললাম, ‘দুৎ! আমার উষ্ণতা হল ষোল (ডিগ্রি সেলসিয়াস), বলে কিনা একষট্টি।’পৃথিবীর উষ্ণতা গত একশো বছরে কি হারে বদলেছে সেটা নিচের ছবিতে বোঝা যাবে –
বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাড়তি না কমতি?’ আমি বললাম, ‘সে আবার কি?’”
উৎস |
সোজা ভাষায়, গত একশো বছরে এই ভেজা, পাথুরে গোলকটির উপরের তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের একটু বেশি। মাত্তর! ছোঃ! এইটুক জ্বর আসলে লোকে প্যারাসিটামলও খায়না। ঠিক। তবে কিনা, ব্যাপারটা একটু বেশি গুরুতর। আন্টার্কটিকার ভস্তক স্টেশনে এখনো অবধি মাপা সবচেয়ে কম তাপমাত্রা হলো: -৮৯.২˚ সে.। ইরানের ‘লুৎ’ মরুভূমির এখনো অবধি মাপা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা: ৭০.৭˚ সে.। সুতরাং, এভাবে ঠিক পৃথিবীর ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব নয়। কি করে বোঝা যায়? সেটা বলার আগে, একটু দেখে নেওয়া যাক, এই ‘বাড়তি’টা ঠিক কত হতে পারে ভবিষ্যতে।
উৎস |
সঙ্গের ছবির মোদ্দা বক্তব্য – ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা মানবসভ্যতার জীবাশ্ম-জ্বালানির(পেট্রোলিয়াম, কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস) চাহিদা যদি এই হারেই চলতে থাকে, তবে চলতি শতকের শেষের আগেই পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ৪˚ সে. এর থেকেও বেশি। যদি আমাদের কপাল ভাল হতো, আর সবাই মিলে এই এক্ষুনি সব বদলে ফেলতে পারতাম, তাহ’লে উষ্ণতা আগামী আশি বছরে বাড়তো ২˚ সে. এর কিছু কম। যদি এখনো, প্যারিসে হওয়া চুক্তি সক্কলে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে, তবে সেটা গিয়ে দাঁড়াতো ৩˚ সে. এর কিছু কমে। আর এখন?
কি হবে ৪˚ তাপমাত্রা বাড়লে? একটা হিসেব দিলে বোঝা যাবে ভাল। গত ১০ হাজার বছর ধরে এই গ্রহের তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়া-কমা করেনি(খুব বেশি হলেও ১ ডিগ্রির কম)। এই ঝিমোনো ১০ হাজার বছরের শেষে হঠাৎ গোটা প্রজাতি তেড়েমেড়ে তেল পোড়াতে শুরু করায় এক ধাক্কায় ১ ডিগ্রির থেকে বেশি উষ্ণতা বেড়ে গেছে মাত্র একশো বছরে! সঙ্গের কার্টুনটি XKCD-খ্যাত Randall Munroeর আঁকা। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আরও ভাল করে যদি জানতে ইচ্ছে করে ঠিক কি করে, কখন উষ্ণতা বেড়েছে/কমেছে পৃথিবীর, তবে এই লিঙ্কে চলে যেতে হবে (বিশ্বাস করুন, ঠকবেন না)।
উৎস |
তা, এই ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’ যে বিরাট মহাযজ্ঞ হয়ে গেলো প্যারিসে, তাতে সুবিধে? আদৌ কি কিছু হলো? হলো কি না জানতে, আগে ব্যাপারটার শুরু জানা দরকার। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-দি-জেনেইরো তে রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রথম একটি চুক্তি করে বায়ুস্তরের গ্রিন-হাউস গ্যাসের (GHB -যাদের জন্যে উষ্ণতা বাড়ে) পরিমাণ থিতু করার জন্যে। তাতে বিশেষ কিছুই বলা হয়নি, শুধু বলা হয়েছিল, সব দেশ যেন নিজেরা নিজে থেকেই এই ব্যাপারে কিছু একটা করে (সেই! ক্লাসে টিচার বেরনোর সময় –“তোমরা গোলমাল কোরো না, কেমন?” বলে গেলে খুব কাজ হয় কিনা!!)। বলা বাহুল্য, এতে কিস্যু হয়নি। ১৯৯৭-এ কিয়োটোতে হওয়া মিটিঙে ঠিক হয় যে প্রথম বিশ্বের শিল্প-নির্ভর দেশগুলো নিজেদের GHB-উৎপাদনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমাবে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশেরা তেমন কিছু চাপ নেবে না (যুক্তি সহজ – তারা থোড়েই পিপে পিপে তেল পুড়িয়ে এই অবস্থা তৈরি করেছে এতদিন ধরে!)। বড় আর প্রচুর জনসংখ্যার দেশ ভারত আর চীন অল্প চেষ্টা করবে বলে, কিন্তু গুচ্ছের লোক যেখানে খেতে পায় না, তাদের কয়লা ব্যবহার করতে বারণ করার বোকামি কেউ করেনি। তবু, ঠিক সেই বোকামিই করলো একটি দেশ (কে আবার? আমেরিকা) – তাদের দাবি, “ওয়াঁয়াঁয়াঁ, আমরা যদি এত চাপ নিই, ওরা কেন নেবেনাআঁআঁআঁ?” তেলের ডিপো দেশ কিছু দাবী করে বসলো, তাদের ছাড় দিতে হবে। ধান্দাবাজ এক দু’টো পয়সাওয়ালা দেশ গরীব কিছু দেশকে প্রস্তাব দিলো, “ভাই, তোরা বরং এই সব চাপ নে, আমি পারছিনা, বদলে তোদের বেশ কিছু টাকাপয়সা দিয়ে দেবো”।
উৎস |
আবারও, কিস্যু হলো না। এরপর বারো বছর ধরে ক্রমাগত চেষ্টার পর ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন-এ আবার বসলো সব দেশের মিটিঙ – মূল হোতা হয়ে দাঁড়ালো অবশেষে আমেরিকা আর চীন। সব্বাই গাল ভরে বলে চললো- “হ্যাঁ, ২˚ সে. এর থেকে উষ্ণতা একটুও বাড়তে দেওয়া যাবে না।” কিন্তু কেউ বললো না, কিভাবে। আবার, কি আশ্চর্য, কিস্যুটি হলো না। একবার ভেবে দেখুন তো, সেই মানুষগুলোর কথা, যাঁরা এই এতদিন ধরে ক্রমাগত নানা দেশের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন! এঁদের ঘাড়ে ভয়ানক দায়িত্ব, কিন্তু ক্ষমতা? কানাকড়িও নেই। এমনই একজন মানুষ - ChristianaFigueres। সঙ্গের ভিডিওতে চাইলে শুনতে পারেন, এরপরও কি করে ধৈর্য রাখা যায়, আশা পোষণ করা যায়।
অবশেষে, ২০১৪ সালে, লিমায়, ডিপ্লোম্যাটেরা ঠিক করলেন, এক কাজ করা যাক, প্রতিটা দেশকে নিজেদেরকেই ঠিক করতে দেওয়া হোক, লক্ষ্যপূরণে তারা ঠিক কি করতে পারবে। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া হবে, লক্ষ্যটা কিন্তু আসলে ২˚ সে. এর মধ্যে উষ্ণতা বৃদ্ধিকে বেঁধে রাখা। প্ল্যান কাজে দিলো। ২০১৫ র ডিসেম্বরে ১৯৫টা দেশ সই করলো চুক্তিতে। ঠিক ছিলো, ২০১৮ সালে সমস্ত দেশ নিজেদের ঠিক করা লক্ষ্যপূরণে কি করেছে, তার হিসেব দেখাবে। তার আগেই, ডোনাল্ড ডাকের আপন বেরাদর হংসমধ্যে বকযথা হয়ে ইউরোপ ভ্রমণ সেরে ফিরে নিজের অর্শাহত পশ্চাদ্দেশে পুলটিশ দিতে গিয়ে নিজেদের পায়েই এক মোক্ষম কালিদাস-কোপ বসিয়ে দিলেন।
কি লাভ হলো এতে, কি ক্ষতি হলো? কি করা যেতে পারে এরপর? কিছু করা না গেলেই বা কি হবে? আমাদের, মানে ভারতের খবর কি? সে সব পরের দিন বলবো, এখন বেজায় খিদে পেয়েছে। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আপনারা পারলে একটু নিজের গ্রহটার দিকে তাকাবেন সময় করে। এসব পরিবেশ-ফরিবেশে ওর কিছু যায় আসে না, কেসটা খাবো আমরা। কেন, সেটাও পরদিন বলবো। এখন আসি, কেমন?
(চলবে...)