<<আগের পর্ব
২৮শে জানুয়ারি: টুমলিং থেকে কালাপোখরি
|
সূর্যোদয় - টুমলিং |
সকালবেলা উঠে দেখি আগের দিনের মতো মেঘ নেই আকাশে, বেশ পরিষ্কার। কাঞ্চনজঙ্ঘা সমেত ঘুমন্ত বুদ্ধকেও বেশ দেখা যাচ্ছে, ঝলমল পরিবেশ। রাস্তার ধারে কালকের তুষারপাতের চিহ্নও স্পষ্ট। আজ আমাদের যেতে হবে গৈরিবাস, কায়াকাট্টা পার করে কালাপোখরি, সব মিলিয়ে প্রায় বারো কিমি। ঠিক হলো, দুপুরের খাওয়া হবে হয় গৈরিবাসে, না হয় কায়াকাট্টায়, সুবিধে মতো। টুমলিং থেকে বেরোনোর প্রায় এক ঘণ্টা পরে আমরা সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক এর চেক পোস্ট পার করলাম, এখানে আমাদের সবার পারমিট করাতে হলো। এই পথে অনেক নাম-না-জানা পাখির দেখা পেলাম, আর রাস্তার ধারে প্রচুর রডোডেন্ড্রন গাছ। ফুল ফুটে নেই, তবে কুঁড়ি ধরে আছে অনেক। এগারোটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম গৈরিবাস নামক লোকালয়ে। খাওয়ার সময় হয়নি, তাই শুধু চা বলা হলো। এখানেই আমাদের আলাপ হয় সুদাসবাবুর সাথে। অনবদ্য মানুষ একজন! পঞ্চাশের ওপর বয়স, কিন্তু উদ্যমের কোনো খামতি নেই। পাহাড় ভালোবাসেন খুব। একাই বেরিয়ে পড়েছেন সান্দাক্ফুর পথে, এই নিয়ে তাঁর ছ’বার। সুদাসবাবুকে সাথে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম গৈরিবাস থেকে। গৈরিবাসের পর রাস্তা বেশ খাড়া। প্রায় দেড়’ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছলাম কায়াকাট্টাতে, আরেকটা ছোট্ট লোকালয়। সুদাসবাবু একটু গল্প করে, দুপুরের খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লেন। খাওয়া শেষ করে বেরোতে আমাদের একটু সময় লাগলো। প্রায় দেড়’ঘণ্টা পরে আমরা রওনা দিলাম কালাপোখরির উদ্দেশ্যে। রাস্তায় তখনও অনেক জায়গাতেই জল জমে বরফ হয়ে আছে। কালাপোখরি পৌঁছতে বিকেল সাড়ে চারটে বেজে যায়। গ্রামে ঢোকার আগেই একটা ছোট্ট পুকুর, নাম কালাপোখরি। এই পুকুরকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষজনের মধ্যে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে। গ্রামের নামকরণ এই পুকুরের নাম থেকেই। এই গ্রাম থেকে পাহাড়ের মাথায় সান্দাক্ফু চোখে পড়ে।
|
ঘুমন্ত বুদ্ধ - টুমলিং থেকে |
বেশি দূর নয়, মাত্র ছয় কিমির মধ্যেই, তবে উচ্চতার পার্থক্য ভালোই। এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা কর্মা তেনজিং নামে একটা হোমস্টেতে। দু’টো বেড়ার ঘর, একটাতে গৃহকর্তা তার পরিবার নিয়ে থাকেন, আর আরেকটাতে ডরমিটরির ব্যবস্থা করেছেন পর্যটকদের জন্যে। ব্যবস্থা আহামরি কিছু না হলেও, গৃহকর্তার ব্যবহার আর আতিথেয়তা মন ভরিয়ে দেয়।
|
বরফ হাতে এইমার, সঙ্গে অজিত |
|
কালাপোখরি পুকুর |
|
পড়ন্ত বিকেল - কালাপোখরি |
|
জগদ্দল - কালাপোখরি |
|
সূর্যাস্ত - কালাপোখরি |
২৯শে জানুয়ারি: কালাপোখরি থেকে সান্দাক্ফু
|
কালাপোখরির সকাল |
|
জমে যাওয়া কালাপোখরি |
কাল রাতে আমরা সবাই প্রায় কমবেশি ঠাণ্ডায় কাবু হয়েছি। বেড়ার ঘরে ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরের হিমশীতল বাতাস ঢুকেছে সারারাত। ভোরবেলা আর থাকতে না পেরে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। বেরিয়ে দেখি কালাপোখরি তখনও ঘুমোচ্ছে, পাখির দলের গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কালাপোখরি পুকুরের ওপরের স্তরের অনেকটাই জমে গিয়েছে ঠাণ্ডায়। বুঝলাম, কাল রাতে তাপমাত্রা শূন্যের অনেকটাই নিচে নেমেছিল। বাকিদের ঘুম ভাঙ্গতে সময় লাগলো। এই সুযোগে আমিও বেশ এদিক-সেদিক ছবি তুলে নিলাম। সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যে আমরা সবাই তৈরি হয়ে রওনা দিলাম সান্দাক্ফুর উদ্দেশ্যে। আজ যেতে হবে মাত্র ছ’কিমি। তিন কিমি পথ পার করে আমরা এসে পৌঁছলাম ভিকেভঞ্জন গ্রামে। এখান থেকে রাস্তা তিন ভাগ হয়ে বেরিয়ে গিয়েছে সান্দাক্ফুর দিকে। বাঁদিকের রাস্তা নতুন, নেপালের মধ্যে দিয়ে অনেকটা ঘুরে পৌঁছবে গন্তব্যে। ডানদিকের রাস্তা পুরোনো, দৈর্ঘ্যে অনেকটাই কম। আমরা নিলাম মাঝের পায়েচলা পথ, দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে ছোটো, কিন্তু অনেক খাড়া। এখান থেকে সান্দাক্ফু মাত্র তিন কিমি হলেও খাড়া উঠতে হবে অনেকটাই। একের পর এক পাহাড়ি বাঁক পার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম আমরা। সান্দাক্ফু পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে যায়।
|
পাহাড়ের চূড়ায় সান্দাক্ফু |
উঠেই দেখি সামনে দৈত্যের মতো উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁওয়া যায়! এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। এতোটা পথের ক্লান্তি এইবার যেন সার্থক হলো। দূরে মাকালু আর লোৎসে সমেত এভারেস্টও মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধতার এই উদ্দীপনায় ভেসে বেড়াতে বেশ লাগছিল।
|
সুদাসবাবু আর অজিত |
|
সান্দাক্ফুর পথে |
|
ফেলে আসা পথ |
|
আর মাত্র ৩০০ মিটার |
এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা সানরাইস লজে। লজের মধ্যে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা আছে। বাকি আয়োজনও ভালো।
|
ঘুমন্ত বুদ্ধ - সান্দাক্ফু থেকে |
|
হাত বাড়ালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা - সান্দাক্ফু । |
আলো একটু কমে আসতে তেন্জি আমাদের নিয়ে গেলো সান্দাক্ফুর সর্বোচ্চ টিলায়। সে আক্ষরিক অর্থেই “top of the world”। নিচে পাহাড়ের গায়ে ঘন মেঘের দল জড়ো হয়েছে একে একে, আমাদের ধরার সাধ্য নেই তাদের। পড়ন্ত বিকেলের লাল আভা আছড়ে পড়েছে সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর; দূরে এভারেস্ট থেকে কাছের ঘুমন্ত বুদ্ধ পুরো হিমালয়ই চোখের সামনে প্রবল ভাবে উদ্ভাসিত; এক কথায় স্বর্গীয় দৃশ্য!
|
ঘুমন্ত বুদ্ধ - সান্দাক্ফু |
|
এভারেস্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা - সান্দাক্ফু |
|
সূর্যাস্ত - সান্দাক্ফু |
সূর্যডুবির কিছু পরেই আমরা নেমে আসি। কাল ভোরে আবার এখানেই আসতে হবে, সূর্যোদয় দেখার জন্য।
বাকি সন্ধ্যেটা আমরা আড্ডা জমাই লজের ডাইনিং রুমে। কিন্তু মাথার ভেতর মাঝেমাঝেই উঁকিঝুঁকি দিয়েছে আজ সারাদিনে দেখা অবিস্মরণীয় সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। বাইরে উষ্ণতার পারদ তখন শূন্যের অনেক নিচে।
৩০শে জানুয়ারি: এবার ফেরার পালা
|
প্রথম আলো - সান্দাক্ফু |
|
এভারেস্ট পরিবার - সান্দাক্ফু |
ভোরবেলা আমাদের উঠতে হয় সাড়ে চারটে নাগাদ। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। টর্চের আলো ভরসা করেই আমরা কালকের পাহাড়ের মাথায় উঠলাম। দিগন্তের প্রথম আলো এসে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপর। তারপর শুরু তুষারস্নাত হিমালয়ের গায়ে রঙের খেলা; প্রথমে লালচে কমলা, তারপর সোনালী, শেষে হলুদ। ওদিকে এভারেস্ট পরিবারও ততক্ষণে সোনালী আভায় জ্বলজ্বল করেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে আমরা উপভোগ করলাম এই দৃশ্য। কিন্তু নেমে আসার খানিক পরেই মনটা কেমন করে উঠলো। এবার তো ফেরার পালা!
|
যাওয়ার আগে |
|
সান্দাক্ফু থেকে গুরদুম্ এর পথে ১ |
|
সান্দাক্ফু থেকে গুরদুম্ এর পথে ২ |
আজ আমরা নামব শ্রীখোলা অবধি। কাল ভোরে সেখান থেকেই শিলিগুড়ির গাড়ি ধরার কথা। সান্দাক্ফু থেকে শ্রীখোলার দূরত্ব প্রায় ষোলো কিমি। পুরো রাস্তাটাই প্রায় সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে দিয়ে। দু’দিকে ঘন বন, মাঝে মাটির পথ। মাঝেমাঝে পথের ধারে বরফও পড়ে আছে। পথের ঢাল খুব বেশি। খুব সাবধানে নামতে হয়েছে। তবে সকালের প্রাণখোলা দৃশ্য মনে আলাদা বল এনে দিয়েছিল আমাদের। মাত্র তিনঘণ্টায় প্রায় নয় কিমি পথ পার করে আমরা এসে পৌঁছই গুরদুম্-এ। পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে এই গ্রাম, ছবির মতো সুন্দর। এখানে আমাদের শেষবারের মতো সুদাসবাবুর সাথেও দেখা হয়ে যায়। দুপুরের খাওয়া শেষ করে, আমরা আবার বেরিয়ে পড়ি। এখান থেকে প্রায় ঘণ্টা খানেক লাগে শ্রীখোলা পৌঁছতে। শ্রীখোলার পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটা পাহাড়ি নদী, একই নাম, শ্রীখোলা। এই নদীর ওপর একটা ঝুলন্ত ব্রিজও রয়েছে। এখানে আমাদের পৌঁছে দিয়ে বর্ফি আর তেন্জি বিদায় নিলো, রেখে গেলো কিছু স্মৃতি আর ফোন নাম্বার। আমরা বাকিরা শেষদিনের এই শেষবেলা স্মৃতিচারণ করেই কাটিয়ে দিলাম।
পাহাড়ের নেশা, প্রবল নেশা! সে ভুক্তভুগি মাত্রই জানেন। আজ প্রায় চার-পাঁচ মাস পরেও মনে পড়ে টুমলিং, কালাপোখরি, শ্রীখোলার কথা; মনে পড়ে সেই সব মানুষজনের কথা। একত্রিশে জানুয়ারি আমরা ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শ্রীখোলা থেকে বেরিয়ে আসি। পথে সুকিয়াপোখরির কাছে বিদায় নেয় অজিত, এইমার আর মধুরা। ওরা চলে যায় দার্জিলিং এর পথে, আর আমি শিলিগুড়ির…