Thursday, July 6, 2017

কি সুর বাজে আমার প্রাণে -- রম্যাণী

উৎস
"আহ! চুপ করো। ফোন-টোন কিচ্ছু করতে হবে না।", বলেই গাড়ির জানালায় মুখ সেঁটে বসে গেলো। আমিও তত সময়ে বদ্ধ কালা, বাইরে আকাশ, সামনে পাহাড়, প্রাণে তখন বর্ষাকালে বসন্ত-বাহার। ব্যাগে সাত দিনের ছুটি-হঠাৎ পাওয়া। তিন দিন রাস্তায়- হাতে রইল চার, তাই "পথে এবার নামো সখা"; ভাগ্যি ভালো, অফ সিজ্যন, তাই মাফলার জড়ানো-ফ্লাক্স বগলে জনস্রোতে ভাঁটা। রাস্তার দু’পাশে 'ফুডিং এভেলেবেল' ধাবায় ফাঁকা চেয়ার টেবিল, যেন মেলা খুলেছে, কিন্তু জমে উঠতে এখনো দেরি। রাস্তায় পাহাড়ি পোশাকে ঝলমলে বাচ্চা, আপেল টুকটুকে গাল, গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাহাড়ি বুলবুল।

গাড়ি পাহাড় বেয়ে চলেছে কুমায়ন এর দিকে। আমি তাল গুনি, চৌদ্দ মাত্রা- আমির খান গেয়ে যান "পরান কোয়েলিয়া কুকো রহি"; ধিন-নাউকুচিয়া তাল, ধা-ভীম তাল। সারথি বাবু বলে ওঠেন, "বাকি লৌটনে কে টাইম"। আমরা নামি একটা ছোট্ট কাঠের ঘরের সামনে, বাইরে টেবিল পাতা, গাছের গুঁড়ির তৈরি। খিদেয় পেট চুঁই-চুঁই। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি গরম পরোটা ভাজা হচ্ছে। খদ্দের আমরা ছাড়া আরেক দল। 'ফরেনোর', বলে উঠলেন আনন্দ জী। ঘুরে দেখি ঢাউস ক্যামেরা নিয়ে গাছে জড়ানো কুমড়ো লতার ছবি তুলছে। ফুলে ভর্তি। দিম্মা পোস্ত-বাটা মাখিয়ে মুচমুচে করে ভেজে দিতেন, সাথে ঘি-ভাত। মাখন দেয়া পরোটা চিবোতে চিবোতে পোস্ত-বাটার কথা ভাবি। ধোঁয়া ওঠা ঘি-ভাত, কাঁচা লঙ্কা আর গর্মা-গ্রম দহি-পরোটা-তুলনাটা গুছিয়ে তোলার আগেই দেখি পাশের ভদ্দরলোক শেষ টুকরো মুখে পুরছে। তেল জবজবে হাতটা পাঞ্জাবি তে মুছে ফেলেই এক গাল হাসি-
-ছুটি চলছে কিন্তু
-জাহান্নামে যাও। আমি মনোযোগ দিয়ে পরোটা চিবোই। পাশে কমলা-হলুদ কুমড়ো ফুল। আনন্দ জী শুনি তখনও বলছেন, "অর এক লাও", মুখে স্বর্গীয় আনন্দ। পোস্ত-মাখা কুমড়ো ফুলের স্বাদ যদি জানতো!
"অর দো ঘণ্টে মে মুক্তেশ্বর পৌঁছ জায়েঙ্গে"। রাষ্ট্র-ভাষায় আমাদের অভয় দান করে আবার যাত্রা শুরু হলো।
গান চলছে, পুরোনো হিন্দি গান, কাশ্মীর কি কলি। গুনগুনিয়ে উঠতে গিয়ে থেমে যাই। যেন এক যুগ আগের কথা। মায়ের হাত ধরে, বাড়ির পাশেই দিদির বাড়ি - গানের দিদিমণি। শখ মায়ের, উৎসাহ আমার।

রবিবার সকাল... দিদি রান্নাঘরে শাক কাটেন, আমি হারমোনিয়ামে সা রে গা রে সা সাধি। তেলে ফোড়ন পড়ে, দিদি ভূপালি শেখান - মা নি বর্জিত। খাতা দেখে সাদা কালো রিডে সুর খোঁজার চেষ্টা করি। আরোহে দিদি হাত ধরে নিয়ে যান। অবরোহে একাই নামি, পা ফস্কে যায়। দিদি এসে পাশে বসেন। সাদা চুল, সাদা শাড়ি, হাতে হলুদের ছোপ। ভুল করি বারবার, দিদি হাসেন, বলেন, "বাড়ি গিয়ে রেওয়াজ করবি"। আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ি। কোনো কোনো রবিবার দিদির ছেলে রাজু দাদা নেমে আসে, "মায়ের রান্না হতে হতে আমার সাথে চল"। ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি ভাঙি, কাঠের পুরোনো সিঁড়ি, বড্ডো উঁচু। ওপারে অন্য জগত। সেতার, তানপুরা, "ওটা কি?", রাজু দাদা চিনিয়ে দেয়, 'সুর মণ্ডল।' 



-''তুমি পড়াশোনা করো না?'' তারে ভয়ে ভয়ে আঙ্গুল ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করি।
-''এই তো, করছি"। একটা একটা সুর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে বাগান, বাগান থেকে রাস্তা পেরিয়ে যেন আমাদের বাড়ি পর্যন্ত ভেসে যায়।
-"ধুর। এটা তো গান। তোমার স্কুল নেই? হোমওয়ার্ক নেই?"
সেতারে তার বাঁধতে বাঁধতে হাসি ছড়িয়ে উত্তর, "হোমে বসে করছি, এই তো আমার হোমওয়ার্ক", অকাট্য যুক্তি।
দিদি উঠে আসেন, হাতে নারকেল নাড়ু। এবার দেশ রাগ, সুর ঠিক হলে দু’টো নাড়ু। একটাও মেলে না। মন খারাপ করে নাড়ু খাই, দুটোই।
-রেওয়াজ করিসনি?
মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ি।
-কোলে টেনে বোঝান,"না করলে শিখবি কি করে"।
দিদি চেষ্টা করে যান। পারেন না। অসুর থেকে 'অ' আর বাদ পড়ে না। দেশ থেকে কষ্টে-সৃষ্টে দুর্গা।

একদিন রাজু দাদা ডেকে বলে, "আমরা শিলচর থেকে চলে যাচ্ছি রে..."। ততদিনে বুঝেছি যে চলে যাওয়ার মানে আর ফিরে না আসা। দিদি নারকেল নাড়ু খাওয়ান। মাথায় হাত দিয়ে বলেন, "চেষ্টা করিস, ফাঁকি দিসনে আর। হোমওয়ার্ক দেয়া থাকলো তোকে। "মিথ্যে হাসি, জানি পারবো না। কান্না চেপে পুকুর ধার ধরে একা বাড়ি ফিরি। হারমোনিয়াম খাটের তলায় ধুলোয় ঢাকা পড়ে। ফাঁকি দিয়ে লেখাপড়া হয়, গান নয়। তাই ঠোঁট টিপে গলা মেলাই, "তারিক কেরু কিয়া উস্কি, যিসনে তুঝে বানায়া"। শহর ছেড়ে গাড়ি আরো উপরে যায়। আনন্দ বাবু গাড়ি থামান, গান বন্ধ হয়। নেমে খাদের ওপারে আঙ্গুল তুলে দেখান- রোদ ঝলমলে হিমালয়! 'অফ সিজন মে সবকো নসিব নেহি হোতা"। দু’জনের চোখে মুগ্ধতা, এতো কাছে! আনন্দ বাবু হেসে ওঠেন, ঠিক যেমন দিদি হাসতেন, সুর চিনিয়ে দিয়ে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই