১
পলের বাবা-মা ওর ছোটবেলায় ওকে অন্য অনেকের মতোই
পিয়ানো শিখতে বাধ্য করেছিলেন। সে বয়সে কি আর অত শান্ত সুর ভাল লাগে? নিয়ম করে
রেওয়াজই বা কাঁহাতক সহ্য হয়! তাই সে চেষ্টা বৃথা গেল। বেশ খানিকটা বড় হয়ে, নানা
ঘাটের জল খেয়ে, নিজের দেশ উটায় ফেরত আসার আগে নতুন করে প্রেমে পড়তে হলো- ডিজিটাল
পিয়ানোর প্রেম। নেহাত শখেই পিয়ানো, আর তার নানা ঘুপচি খবর জেনে ফেললো পল। তবে
আমাদের অনেকের মতোই সে সব জানা ওর কোন কাজে লাগেনি। দেশে ফিরে ও কাজ নিলো এক পানীয়
জল সরবরাহ করে, এমন সংস্থায়।
ওর যাতায়াতের রাস্তায় একটা ইয়ামাহা পিয়ানোর দোকান
পড়ে। সেখানে জল পৌঁছে দিয়ে একদিন ও বসে নতুন ক্ল্যাভিনোভা ডিজিটাল পিয়ানোয় টুংটাং
করছিল, এমন সময় এক ভদ্রলোক দোকানের দরজা খুলে ভেতরে এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন এই
যন্ত্রটা কি?(আহা, আমাদের সঙ্গে এরকম হয়না কেন! মাঝেমাঝে মনে হয় না, যে বিষয়ে
গুচ্ছের জেনে গেছেন, যেটা খুব বেশি ভালবাসেন, তা নিয়ে কেন কেউ একটাও প্রশ্ন
করেনা?) লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পল দেখাতে শুরু করলো ক্ল্যাভিনোভা ঠিক কি আর কত মজার কাজ
করতে পারে। কিছুটা যন্ত্রের গুণে, আর বেশ খানিকটা ওর ছোঁয়াচে উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে
ভদ্রলোক কিনেই ফেললেন জিনিসটা। মনে রাখবেন, দেশটা আমেরিকা হলেও আর যন্ত্র ডিজিটাল
হলেও- একখানা পিয়ানো বেচে ফেলা কিন্তু চাড্ডিখানি কথা নয়! দোকানের মালিক যারপরনাই
খুশি হয়ে পলকে দোকানে চাকরির প্রস্তাব দিলেন আর পলও এককথায় রাজি হয়ে গেল!
রাজি হওয়ার কারণ আছে। ওই দোকানেই এক সোনালি চুলের
কন্যে কাজ করেন- যার সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করার ইচ্ছে পলের অনেকদিনের।
কন্যের নাম ট্রেসি। এ সব সুযোগ কি ছাড়তে আছে! (পরে এই ট্রেসিই পলের চার-চারজন গুড়গুড়ে খোকাখুকির মা হবেন, তবে সে সব অনেক পরের গপ্পো।)
কন্যের নাম ট্রেসি। এ সব সুযোগ কি ছাড়তে আছে! (পরে এই ট্রেসিই পলের চার-চারজন গুড়গুড়ে খোকাখুকির মা হবেন, তবে সে সব অনেক পরের গপ্পো।)
এর ঠিক পরের গল্পটা মোটেই সোজা নয়, পরিশ্রমের,
যন্ত্রণার। টানা ছ’বছর ওখানে কাজ করে অবশেষে পল ওই ব্যবসাটা আগের মালিকের কাছ থেকে
কিনে নিলেন ২০০১ সালে। ব্যবসার নতুন নাম দিলেন- ‘Piano Gallery of Southern Utah’।
ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করা শুরু করলেন, সোশাল নেটওয়ার্কিং
সাইটগুলো ব্যবহার করা শুরু করলেন। ব্যবসা কিছু বাড়লো, কিন্তু মনের মতো নয়। এর
মধ্যে ২০০৭-এ পল পিঠে চোট পেয়ে ছ’মাসের জন্য শয্যাশায়ী হলেন। একঘেয়েমি কাটাতে যে
কাজটা শুরু হলো, সেটা একসময় নেশার পর্যায়ে পৌঁছে গেল- ইউটিউব আর ফেসবুকে ঘণ্টার
পর ঘণ্টা কাটানো। (এ আর নতুন কথা কি, প্রতিদিন আমরা সক্কলে তো তা-ই করছি! তবে
পলের মনের কোণে অন্য ছক কষা হচ্ছিল- কি করে এই দুই মাধ্যমকে ব্যবহার করে দোকানে
আরও বেশি খদ্দের আনা যায়)।
এই রকম সময়ে একদিন স্থানীয় পিয়ানো-বাজিয়ে ‘জন’ এলেন
ওর দোকানে। নতুন নতুন পিয়ানো বেছে দেখা, আর সঙ্গে অল্প রেওয়াজ, এই ছিল লক্ষ্য।
বাজনা শোনার অনেক আগে থেকেই জনের নাম জানতো পল। কিছুদিন আগেই ইউটিউবে আরেক
চেলো-বাদক স্টিভের সাথে একটা বাজনা শুনে এতটাই ভাল লেগেছিলো, যে মনে হয়েছিলো, ইস্!
যদি আর একটু ভাল ভিডিও থাকতো এদের! জনকে দেখে তাই দ্বিধা কাটিয়ে বলেই ফেললো ওর
মনের কথা। বললো, ‘যদি আপনারা মিউজিক তৈরি করেন, তবে আমি ভিডিও তৈরি করতে রাজি’।
শর্ত একটাই, প্রতি ভিডিওতে একটা করে ইয়ামাহা পিয়ানো থাকতে হবে আর লোগোটা পরিষ্কার
দেখা যেতে হবে। জন একটু অস্বস্তি নিয়েই রাজি হলেন।
২
জনের বয়স পলের থেকে অনেক বেশি। জীবনটাও অনেকখানিই
আলাদা। প্রবাসী জার্মান পরিবারে জন্মানো জনের ছেলেবেলায় সেই যে পিয়ানো শেখা শুরু
হয়েছিল, তারপর একেবারে রেসের ঘোড়ার দৌড়। প্রথম গান লিখে ফেলা ১১ বছর বয়সে, তার
কিছুদিন পর থেকেই পিয়ানো শেখানো শুরু। মানে, প্রতিভার যাকে বলে লেখাজোকা নেই। কুড়ি
বছর বয়স হওয়ার আগেই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ওই আঁকিবুঁকি লেখার ভাষা, যাকে বলে ‘Sheet Music’ (আমরা চলতি কথায় বলি স্টাফ নোট),
কমবয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানোর নতুন এক কায়দা বের করে ফেললেন। পিয়ানোয় হাতেখড়ি
হলে কি পদ্ধতিতে শেখা শুরু হবে, তা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে তক্কো শুরু হয়ে গেল।
এ হেন জনও এক সময়ে এসে ভাবলেন- সক্কলে তো ভাল বলছে,
কিন্তু প্রশংসা দিয়ে তো আর পেট ভরে না! তাই কলেজে ভর্তি হলেন ইংরেজি নিয়ে, পরে
এম.বি.এ করার পরিকল্পনা। জনের অন্যরকম পিয়ানো বাজানোর ভঙ্গি, আমুদে স্বভাব, মিষ্টি
ব্যক্তিত্ব ইতিমধ্যে এত অনুগামী জোগাড় করে ফেলেছে, যে তাদের কথা ভেবে যা-হয়-হবে
ভঙ্গিতে একটা কনসার্ট হল ভাড়া করে ফেললেন- এক সন্ধ্যে পিয়ানো বাজানোর জন্য।
এর পরে আর জনকে ইংরেজি বা এম.বি.এ র দিকে ফিরে
তাকাতে হয়নি। কুড়ি বছর ধরে চলা কর্মজীবনে অ্যালবাম, বই, পুরস্কার অনেক জুটেছে জনের ভাগ্যে। অগুনতি কিশোরী-যুবককে পিয়ানোয় আগ্রহী করে তুলেছেন
উনি। মাত্র ২১ বছর বয়সে একটা গান লিখেছিলেন- ‘All ofMe'- এহেন নামের কারণ, গানটা বাজাতে সত্যিই পুরো হাত ব্যবহার
করতে হয়। সে গান এতই বিখ্যাত, যে ইউটিউব ছেয়ে আছে কচি-কাঁচাদের হোঁচট খেয়ে বাজানো
ভিডিও দিয়ে।
পলের সঙ্গে কথা হওয়ার পরে কিছু রেকর্ডিং করা হলো, কিন্তু বিশেষ জমলো না। একটা ভিডিওকে ইউটিউবের জলপ্রপাতে মাথা তুলে ভাসিয়ে রাখা অতটাও সোজা নয়। কিন্তু ভিডিওর মান বেশ উন্নত- কে বলবে দেখে ওগুলো কমদামী ডি.এস.এল.আর ক্যামেরায় তোলা! ভিডিওগুলো তোলা, এডিট করা- এ সবই করছিল টেল।
পলের সঙ্গে কথা হওয়ার পরে কিছু রেকর্ডিং করা হলো, কিন্তু বিশেষ জমলো না। একটা ভিডিওকে ইউটিউবের জলপ্রপাতে মাথা তুলে ভাসিয়ে রাখা অতটাও সোজা নয়। কিন্তু ভিডিওর মান বেশ উন্নত- কে বলবে দেখে ওগুলো কমদামী ডি.এস.এল.আর ক্যামেরায় তোলা! ভিডিওগুলো তোলা, এডিট করা- এ সবই করছিল টেল।
৩
দু’জন কমবয়সী এই সময় জড়িয়ে পড়েছিল পল আর জনের কাণ্ডকারখানার সঙ্গে। টেল আর অ্যাল। টেলএর পড়াশুনো প্রধানত ডিজিটাল ফিল্ম তোলা নিয়ে। খুচরো কিছু কাজ এদিক ওদিক করতে করতে একসময় ও কাজ নেয় পলের দোকানে। পিয়ানোর মত বিরাট যন্ত্র নাড়ানো সোজা কাজ নয়- তার সঙ্গে ওর যন্ত্র-সম্পর্কে জ্ঞান কিছুদিনের মধ্যেই পলকে বাধ্য করে দোকানের সব যান্ত্রিক খুঁটিনাটির ভার ওর ওপর ছেড়ে দিতে। এই রকম সময়, ও একদিন নিজের বানানো একটা ভিডিও এনে পলকে দেখায়- জঙ্গলের মধ্যে একলা একটা পিয়ানো নিজে থেকেই বাজছে। ব্যস , ভিডিওগ্রাফার খোঁজা নিয়ে পলের দুশ্চিন্তার অবসান।
নিউজিল্যান্ডে জন্মানো, ডাচ বাবা আর সামোয়ান মায়ের ছেলে অ্যালএর ছোটবেলা থেকেই সংগীতের সঙ্গে ওঠাবসা। নানা রকম যন্ত্র বাজাতে ওস্তাদ অ্যাল নিজের খরচে বাড়িতে একটা রেকর্ডিং স্টুডিও-ও খুলে ফেলেছিল। এ ছাড়া শৌখিন অ্যালএর পক্ষে ফ্যাশনে অশিক্ষিতদের শুধরে না দেওয়া একরকম অসম্ভব! একসময় ওদের পাড়ায় এল আরেক কমবয়সী, কিন্তু ইতিমধ্যেই চেলো বাজিয়ে নাম করে ফেলা স্টিভ। পড়শি হিসেবে নতুন বাড়িতে জিনিসপত্র সরানোর সময় সাহায্য করতে করতে একটু সঙ্কোচের সাথেই অ্যাল স্টিভকে প্রস্তাব দিয়ে বসলো ওর স্টুডিওয় কখনো কখনো এসে বাজানোর জন্যে।
৪
স্টিভ আরেক প্রতিভা। পশ্চিমী মার্গ-সঙ্গীতের কনসার্টে যারা চেলো বাজায়, তাদের দেখেছেন কখনো? দেখে মনে হয় মাস-দুয়েক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভুগছেন। স্টিভ উলটো রাস্তার লোক। চেলো বাজানোর সময় ওর মুখে হাসি ধরে না। আর বাজানো! সে যে কতরকম করে বাজায় ওই একটা যন্ত্র! ও খুব ভাল করে জানে গিটার আর ড্রাম বাজাতে। সেই বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে চেলো থেকে কর্ড, পারকাশন- আরও অজস্র আওয়াজ তৈরি করতে পারে। আর লাউঘন্টে চিংড়ির মতো ফাউ হলো ওর অফুরন্ত হাস্যরস। যে কোন সময়, যে কোন মজলিশ জমিয়ে দিতে পারে।
জনের সঙ্গে আগে আলাপ থাকলেও অ্যালএর সূত্রেই স্টিভ এসে পড়ে পলের উদ্ভট পরিকল্পনার রাজ্যে।
ওরা প্রথম যে ভিডিওটা করে, তার নাম ‘Michael Meets Mozart’- মাইকেল জ্যাকসন আর মোৎসার্টের উদ্দেশ্যে। ভিডিওতে শুধু স্টিভ আর জন। সমস্ত শব্দ তৈরি হয়েছে একটা ইয়ামাহা পিয়ানো, দু’রকম চেলো আর একটা কিক-ড্রাম দিয়ে। বাজিয়েছে শুধু ওই দু’জন।
তারপর? তারপর আবার কি? এই পাঁচজনে মিলে দল বাঁধলো The Piano Guys নামে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা করে ভিডিও বেরোতে শুরু করলো ইউটিউবে। পল ঠিক করলেন প্রত্যেকটা ভিডিওয় এমন কিছু থাকতে হবে যাতে অন্তত একবার দর্শকের চোয়াল ঝুলে পড়ে। কি না করেছেন ওঁরা সেই কথা রাখতে গিয়ে। দ্রুতগতির ট্রেনের ফ্ল্যাট-কারে, রেললাইনের ওপরে, জঙ্গলে, ঝরনার ধারে, আইস স্কেটিং রিঙ্কের ভেতর, খাড়া পাহাড়ের মাথায়- কোথায় না বসিয়েছেন পিয়ানো! এ সব করতে গিয়ে প্রায় দেউলিয়া হতে বসে টনক নড়ে পলের। এমন ব্যবস্থা করলেন, যাতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অনুগামীরা কিছু করে অন্তত অর্থসাহায্য করতে পারেন। বদলে তাঁদের সিডি, টি-শার্ট আরও অনেক কিছু পাঠানোর ব্যবস্থা হলো।
এখন? ইউটিউবে ওঁদের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ১৫ লাখের ওপরে, ভিডিওগুলো মোট দেখা হয়েছে ২২ কোটির বেশিবার, Sony সদ্য ওঁদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে, ওঁরা সক্কলে নিজেদের অন্য কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, হ্যাঁ, পলের পিয়ানো ব্যবসাও বন্ধ। গ্যাংনাম স্টাইলের মত হয়তো নয়, কিন্তু গুগ্ল তাদের ২০১২ Zeitgeist এ ওঁদের এক-ঝলক দেখিয়েছে- সেটাই বা কম কি!
ওঁরা আর কেউ আলাদা নন- ওঁরা এখন Piano Guys, যাদের বাজনায় মন-মাতানো আধুনিক গানের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর। একবার পরখ করে দেখুন- হয়তো আর মায়া কাটাতে পারবেন না।
[ঠিক কেন এদের নিয়ে লিখলাম জানি না। অনেকদিন পর কোন একটা চেষ্টা এত উৎসাহ দিল বলে, স্বপ্ন-পূরণের গল্প বলে, নাকি নেহাত সুর ভাল লাগে বলে- বলতে পারবো না। এটুকু বলতে পারি- সামর্থ্য যা-ই থাক না কেন, শিল্পের মানের সঙ্গে আপস না করার ওঁদের উদাহরণ এখনো অনেকদিন মনে থাকবে। পারলে ওদের সব বাজনা-ভিডিও শুনুন, দেখুন, আর সব্বাইকে দেখান।]