Thursday, August 29, 2013

আমার প্রাইমারি বেলা -- আবির

প্রাইমারি উত্তর জীবনে কোথাও শুনেছিলাম যে, 'প্রাইমারি' স্কুল হলো সেই স্কুল যেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায়ই মারেন। আমার অভিজ্ঞতা অতটা করুণ না হলেও কথাটা বেশ মনে থেকে গেছে। বরং উল্টোটাই আমার কাছে সত্যি। হাইস্কুলেই প্রহারের প্রয়োজন ও প্রয়োগ যেন বেশি। হাইস্কুলের কথা পরে হবে খন। আজ খুলছি প্রাইমারি স্কুলের ঝাঁপি। চিন্তা নেই, শুধু করুণ রসেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এই গল্পগাথা। অন্যান্য জিনিসপত্রও থাকছে!

একদম শুরুতে, শহরের ছোঁয়া পাওয়া আমার গেঁয়ো বাবা-মা আমার নাম লেখালেন গ্রামের একমাত্র ইঞ্জিরি মিডিয়াম প্রাইমারিটিতে। আইডিয়াটা ছিল, বছর দুয়েক ইঞ্জিরি শিক্ষানবিশি করে, ইংরাজির ভিতটা একটু পোক্ত করে - 'বাংলায় ফিরে এসো বাওয়া' দু’-একজন তুতো দাদার ক্ষেত্রে এইরকমটিই হতে দেখেছি কিনা। সে যাই হোক, শুরু হলো লাল জামা, কালো প্যান্ট, কালো টাই (সেটা আবার নট্‌ করাই থাকত, গলায় গলিয়ে নিলেই হত), কালো জুতো (মোজার রঙ ভুলে গেছি) পরে বিদ্যাদেবীর আরাধনা। ওহ্‌, বলতে ভুলে গেছি, সাথে সবুজ ফিতেওয়ালা ওয়াটার বটল্‌, টিনের বাক্স আর সেই বাক্সে কিছু বই আর রুলটানা খাতার সাথে আকাশী রঙের টিফিন বাক্সও ছিল। কিন্তু ছিলো না একটা জিনিস। অনেককেই দেখতাম খাঁচাগাড়ি করে স্কুলে আসত। বাড়ি থেকে ইস্কুল মেরে-কেটে ৩০০-৩৫০ মিটার হওয়াতে আমি ছিলাম ও সুখে বঞ্চিত। বেজায় রাগ হত জানেন। পরে অবিশ্যি, কি কারণে মনে নেই, একবার সুযোগ হয়েছিল এতে চড়ার। সেই 'রঙ দে বসন্তী' তে কুণাল কাপুর যেরকম বলেছিলেন না,
- ট্রেনে ৩ জনের সিটে ৬ জন বসে, আর তারপর সপ্তম জন এসে বলে 'ইয়ার থোড়া অ্যাডজাস্ট করলে' - আমার অবস্থাও সেরকমটিই হয়েছিল। কাজেই নাক কান মুলেছিলাম - খাঁচাগাড়ি, কভি নেহি। আমার ক্ষেত্রে কেন কে জানে এই স্কুলে থাকার মেয়াদ এক বছর বেড়ে গেল, অর্থাৎ কিনা ৩ বছর আমায় সেখানে রাখা হলো। হয়ত আরো দুবছর রেখেই দেওয়া হত, কিন্তু সে গুড়ে বালি। আমার এক মামাদাদু তখন উত্তর কীর্ণাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। তিনি এসে তার ভাগ্নিকে (অর্থাৎ আমার মা-কে) বললেন, 'কিরে তোর এই ছেলেটাকে কবে আমার হাতে দিবি'? আর সেই বছর শেষেই আমি চলে গেলাম উত্তর কীর্ণাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হয়ত, মামাদাদুর এই কথাটা কাকতালীয়, তবু আমার এটা বিশ্বাস করতেই ভালো লাগে। আমিও নিয়ে যাব ওখানে আপনাদের। একটু সবুর করুন, একটা ঘটনার কথা বলে নিই। আমার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা গুণ চিহ্নের (x) মত দাগ আছে। তার একটা দাগ হয়েছিল গ্রামের আখড়ায় পড়ে গিয়ে। এটা এতটাই কচি বয়সে হয়েছিল যে আমার কিছু মনে নেই। অন্যটা হয়েছিল, এই ইংরেজি ইস্কুলে। টিফিনের সময় পড়ে গিয়ে স্কুলের গেটের কাছে। কান্নাকাটি তো হয়েইছিল, তবে বেশি করে যেটা মনে আছে সেটা হলো, ঐদিন ঠিক টিফিনের পরেই বাড়ি চলে এসেছিলাম, এবং পুরো রাস্তাটাই মা-র কোলে চড়ে।

যাই হোক এসে গেলাম উত্তর কীর্ণাহারে - লোকমুখে উত্তরপাড়া ইস্কুলে। কি কি বদল হলো জীবনে? সে অনেক। কয়েকটা বলি। প্রথমেই লাল জামা, জুতো, টাই এসব জলাঞ্জলি গেলো। ইউনিফর্ম বলে কিছু নেই এ ইস্কুলে। আমি তো তাও হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে ইস্কুলে যেতাম, বেশিরভাগ সহপাঠীই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হওয়ায় সেটুকুও জুটত না। খালি পা-ই ভরসা। বেঞ্চ-টেঞ্চেরও বালাই ছিল না। তবে তার বদলে একটি অমূল্য জিনিসের মালিক হলাম - একখানা নিজের আসন! ভাবা যায়, একটা ৭-৮ বছরের ছেলের নিজের একটা আসন! আহ্‌, তা বলে ভাববেন না, সে কারুকার্য করা রাশভারী আসন। আসলে আসন বলছি বটে, তবে ঠিকঠাক আসনেরা একে আসন-কুলীন গোত্রীয় মনে করবে কিনা এ নিয়ে এখন আমার বেজায় সন্দেহ হয়। এটা ছিল একটা খালি বস্তা, চারধারটা সেলাই করা এই যা। তা সে আপনি যতই মুখ সিটকান এ তখন আমার 'সাত রাজার ধন, এক মানিক'
বাক্সে করে নিয়ে যেতাম, মেঝেতে পাততাম, বসতাম আবার স্কুল ছুটি হলে ভাঁজ করে বাড়ি। বাক্সের ভিতরের অন্যান্য জিনিসের (মানে বই  খাতা আরকি) যত্ন ততটা না হলেও এর জন্য প্রায়ই মা-র কাছে ঝুলোঝুলি করতুম। কেচে-টেচে ফিটফাট করে দিতেন মা। আর একটু উলোঝুলো হয়ে গেলেই বাবার কাছে বদলির দাবি। বার কয়েক খারিজ হওয়ার পর পেতাম আরেকটা নতুন আসন, থুড়ি বস্তা।



আরেকটা বিশাল চেঞ্জ ছিল মাইনের অ্যামাউন্টে। ইঞ্জিরি ইস্কুল নিত মাসে ২০ টাকা, আর এটি অ-বৈ-ত-নি-ক। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি পরবর্তী ৯ বছরে কখনো মাসে ২০ টাকা করে মাইনে কোনো স্কুলে দিতে হয়নি। উত্তরপাড়ার কথা তো বললাম, হাইস্কুলে দিতে হত বছরে ৬৩ টাকা। বড় দাঁও মেরেছি, কি বলেন? উত্তরপাড়া আবার আগের স্কুলের মত নিতান্ত নবীন নয়, এতে আমার দাদারা তো কোন ছার, বাবা-কাকারাও পড়ে গেছেন। আর আমার সময়েও বাবা কাকাদের পড়িয়েছেন এমন গোটা দুই মাস্টারদাদু ছিলেন। একটু বেচাল করলেই মারধোরের থেকেও বেশি ভয় দেখাতেন বাবাদের টেনে নিয়ে আসবেন বলে। তো উত্তরপাড়ায় বেশ চলতে লাগল, কিশলয়-সহজপাঠ-নবগনিতমুকুল নিয়ে। এই বইগুলিও কিনতে-টিনতে হত না। সরকারি বই, পাওয়া যেত বিনি পয়সায়। ছাত্রের তুলনায় বরাদ্দ বই কম থাকায় পুরনো বই-এও কাজ চালাতে হত। আর ঠিক এই কারণেই বছর শেষে সেসব বই ফেরত দিয়ে দিতে হত।

আমার সেই মামাদাদুর গল্প এবার একটু করি। আমার দাদা যখন এ স্কুলের ছাত্র, তখন তিনি দাদাকে বশ করার জন্য মাঝে সাঝে চক দান করতেন। আর তাই কৃতজ্ঞতা বশতঃ দাদা সেই দাদু কাম মাস্টারমশাই এর নামকরণ করল চকদাদু। স্বাভাবিক নিয়মে উনি আমারও চকদাদু হলেন। আমি যখন থ্রি-তে পড়ি, উনি ক্লাস ফোরের কিছু ছেলেমেয়েকে স্কুলের পরে আলাদাভাবে পড়াশুনো দেখিয়ে দিতে লাগলেন। অবশ্যই অবৈতনিক ভাবে, কিছুটা গ্রীষ্মের দুপুরগুলোর সদ্‌গতি করতে আর কিছুটা ছেলেগুলোর ভালো করতে। আমার মা আমায় তাদের সাথে ভিড়িয়ে দিলো। থ্রি-র আমি ছাড়া আর একটি ছেলেই ছিল। হলো কি, আমরাও ঐ ফোরের অঙ্ক, ফোরের বাংলা, ইতিহাস পড়তে লাগলাম। আমার ক্লাসের বাকি ছেলেরা যখন দশমিকের গুণ ভাগ নিয়ে ব্যস্ত, আমি তখন ল.সা.গু.-গ.সা.গু. গড়ের অঙ্ক করছি। খুব আনন্দ হতো জানেন। এখন বুঝি, ওটা বোধ হয় নিষিদ্ধ জিনিস চাখবার আনন্দ। এই একটা কারণে চকদাদুর কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব। আজ উনি নেই। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।

এইভাবে চলছিল। ক্লাস ফোরের শেষদিকে হঠাৎ শোনা গেল, মহামান্য সরকার প্রাইমারী স্কুলগুলিতে
পঞ্চম শ্রেণী চালু করতে চলেছেন। আমার মা পড়ে গেলেন চিন্তায়। প্রাইমারী স্কুলের নতুন হওয়া সবচেয়ে বড় ক্লাসটিতে আমায় রাখবেন নাকি হাইস্কুলের একদম নিচু ক্লাসটিতে। মা-র ভোট প্রথম অপশনটিতে ছিল, কিন্তু বাগড়া দিলাম আমি। আমার দাবী আমি বড় স্কুলে পড়ব। ঐ নিষিদ্ধ আনন্দ বোধ হয়। তবে একটা ১০ বছরের ছেলের চাওয়ায় আর কবে কি হয়েছে? আমারও হত না, যদি না বাবা চাইতেন। আমি এখনো জানি না, মার মত বদল কি করে হলো, তবে সন্দেহ হয় বাবা-ই রাজি করিয়েছিলেন বোধহয়।

সে যাই হোক, প্রাইমারীর পাট চুকলো। হাইস্কুলের গল্প অন্য কোনদিন। উচ্চশিক্ষার বেসাতি করতে করতে ক্লান্ত আমি ভাবলাম গোড়ার কথাগুলো লিখলে কেমন হয়। তাই এই লেখা। কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না। সাথে আপনার গল্পও করুন না আমার সাথে। খুব ভালো লাগবে তা হলে।

About Us | Site Map | Privacy Policy | Contact Us | Blog Design | কথা তো বলার জন্যেই