চেন্নাইতে আসা এক মাস হয়ে গেল। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, কাছাকাছি বাজার-হাট দেখে নেওয়া, কাজ করার ঘর, টেবিল আর কম্পিউটার পাওয়া সবই মোটামুটি হয়ে গেছে, বাকি বলতে একটা সাইকেল জোগাড় করা আর প্রথম চেকটা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসা। দ্বিতীয়টা করতে গেলে প্রথমটা দরকার বলে দু’টোর কোনটাই করবো করবো করে আর করা হয়ে উঠছে না। তবু যাকে বলে সেট্ল্ করে গেছি। একটা নবীনবরণ গোছের অনুষ্ঠানও হয়ে গেছে। সোজা কথায় আমি এখন পাকাপোক্ত দক্ষিণ-ভারতের বাসিন্দা। কেমন আছি, কোথায় আছি, সেই নিয়ে নিয়মিত গল্প করবো বলেই লিখতে বসা। এর থেকে বেশি আর কোন মহৎ উদ্দেশ্য নেই।
রাতের শেষ
প্রহরে ট্রেন থেকে নেমে কাজের জায়গায় আসতে গিয়েই পরিষ্কার বুঝলাম, কেন আসার আগে এত
লোকে এত শোক পালন করছিল। সত্যি, শোক পালন! “যা, এবার সারাদিন কি করে দোসা-ইডলি
খেয়ে কাটাস দেখি!” থেকে শুরু করে “আর যাওয়ার জায়গা পেলে না! ব্যাঙ্গালোর গেলেও
বুঝতাম... চেন্নাই! খুব খাজা জায়গা ভাই, সত্যি বলছি” পর্যন্ত কত কিই না শুনলাম।
যেন শখ করে জায়গা বেছেছি! ভারত সরকার কেন যে ট্যুরিস্ট-স্পটগুলোয় দেখে দেখে
ইন্সটিটিউট বানায় না, হুঁহ্– যাক্, সে আর দুঃখ করে কি হবে। সব মিলিয়ে বেশ
খানিকটা ভয় ছিলই, তার উপরে ভাষার অসুবিধে। ভাসা ভাসা জানা ছিল যে বহুদিন যাবৎ
এখানে হিন্দির বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে – তাই কেউই ও ভাষায় কথা বলে না।
জানলেও বলে না। সে ঠিক আছে। তাহলে বলেটা কি? নিশ্চয়ই ইংরেজি? তাহলেও তো অসুবিধে
নেই- চালিয়ে নেবো। এইসব ভেবে দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পৌঁছে কি দেখলাম?
দেখলাম, ওইসব ভাষার গরিমা-ফরিমা এককালে থেকে থাকতে পারে, আমার জানা নেই। এখন যেটা হয়, তাকে এককথায় বলে ধান্দাবাজি। ধরুন, ট্যাক্সিতে উঠেছেন। প্রথমে ইংরেজি, পরে হিন্দিতে নানা রকম করে ড্রাইভারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন আপনার গন্তব্য, দরকার হলে গুগ্ল ম্যাপ খুলেও দেখালেন। সে এমন ভাব করবে, যে না জানে হিন্দি, না ইংরেজি। যদি ভাগ্যক্রমে কোনভাবে আপনার গন্তব্যের ফোন নম্বর জানা থাকে, আর উল্টোদিকের মানুষটি তামিল জেনে থাকেন, তবে আপনি বেঁচে গেলেন। নইলে ভোগান্তির একশেষ। এ আমার একার অভিজ্ঞতা নয়, নানা রকম গল্প শুনেছি। এক কথায়, গভীর রাতে চেন্নাই এসে পৌঁছলে, ট্যাক্সিতে (সে রেডিও বা প্রি-পেড যাই হোক) খুঁটিয়ে জেনে নেবেন আপনার ড্রাইভার কোন ভাষা কতটা জানে।
এ হেন শহরের
রিসার্চ ইন্সটিটিউটে প্রতি মাসে একটি করে ‘হিন্দি ডে’ পালন হবে তাতে আর আশ্চর্য
কি? মাইরি! ‘হিন্দি ডে’! তাতে প্রতিযোগিতা হয়, বিচারক থাকেন, পুরষ্কার বিতরণ হয়।
হাঃ!
ভাষার
চচ্চড়ি যখন হচ্ছেই, তখন বলে রাখি, আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি বাঙালি দিয়ে ভর্তি।
একেবারে যাকে বলে গিজগিজ করছে। এতটাই, যে জয়েন করার দিন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী
আমায় সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললেন, “ওহ্, ইউ আর আ বেঙ্গলি? ওয়েলকাম! দিস ইস আ
বেঙ্গলি ইন্সটিটিউট!” এইটুকু হলেও রক্ষে ছিল। আসল ধাক্কাটা খেলাম দিন সাতেক পরে, সামনের
রাস্তায় ফোনে কথা বলতে বলতে পায়চারি করতে গিয়ে। সে গল্প করার আগে একটু ওই রাস্তাটা
সম্পর্কে বলা দরকার। যদি কখনো আপনার মনে হয় পশ্চিমবঙ্গেই একমাত্র লোকে দায়িত্ব
এড়াতে পছন্দ করে, এই গল্পটা মনে করবেন।
এই
ইন্সটিটিউটে নিয়মিত দেশ-বিদেশ থেকে নানা শ্রেণীর, নানা বয়সের গবেষকরা আসেন। প্রতিদিন ঝাঁ চকচকে সব গাড়ি ঘোরাফেরা করে কম্পাউন্ডে। এমনকি, বিগশটেরা এক বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে
অন্য বিল্ডিং-এ খেতেও যান গাড়ি করে (আমিও আপনার মতোই অবাক)! এ হেন জায়গায় সামনের
রাস্তায় একগ্লাস জল ঢেলে দিলেও সেটা জমে থাকবে। দেখে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক কালে
কখনো একটা রাস্তায় পিচ ছিল, এখন বৃষ্টি হলে জলাশয় হয়ে যায়। সেই জল একটু শুকোলে পড়ে থাকে প্যাচপেচে কাদা। একটা ফুটপাথও নেই
যেখানে উঠে দাঁড়াতে পারবেন। জানি, জানি – আমিও কলকাতাতেই এই সেদিনও ছিলাম মশাই –
বিশ্বাস করুন, এমন অবস্থা ওখানে হলে পেপারে ছবি বেরোত। অথচ, একটু দূরেই বড়রাস্তা
দেখলে ভিরমি খাবেন। দোকান, রেলস্টেশন – সব ঝকঝকে!
এই দশার কারণ হিসেবে জানতে পারলাম, ওই রাস্তাটা যে ঠিক কার এক্তিয়ারে পড়ে, সেটা নাকি কেউ জানে না। রাস্তার দু’পাশে নানান সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট। রাজ্য সরকার বলে রাস্তা সারানো কেন্দ্রের দায়, কেন্দ্র বলে রাজ্যের। কেউই আর রাস্তা সারায় না। কেমন একটা ধর্ষণের খবর পাওয়ার পর বঙ্গের পুলিশ-স্টেশনের মতো শোনাচ্ছে না? মোদ্দা কথা, ও রাস্তায়, বিশেষ করে এখন যেমন বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে হাঁটা যায় না।
তাহলে
প্রশ্ন, আমি কি করে ফোন কানে নিয়ে পায়চারি করছিলাম? উত্তর হলো, রাস্তার দু’পাশে
বিরাট হাইড্রেনের ওপর বানানো কংক্রিটের ঢাকা। দেখতে সরু ফুটপাথের মতো – ভুল ভাঙবে
তিন হাত অন্তর ম্যানহোলের ঢাকনা দেখতে পেলে। সব্বাই ওখান দিয়েই হাঁটে। তা, সেই
ফুটপাথের ওপর, ফোনে একমনে গল্প করতে করতে আমার চটকা ভাঙলো বাঙলা হরফ দেখতে পেয়ে। যখন
সিমেন্ট জমানো হয়েছিল, কোন এক বং-সন্তান তার ওপর কাঠি দিয়ে লিখেছিলো,
“এই রাত তোমার আমার”।
এখন সেটা
জমে অক্ষয় হয়ে গেছে।
এক কট্টর(?)
তামিল-ভাষী শহরে, যেখানে সরকারি খরচে নিয়মিত ‘হিন্দি ডে’ পালন করা হয়- সেখানে
রাস্তায় এ জিনিস দেখতে পেলে ঠিক কেমন লাগে বলুন তো?