সময়টা
মোটেই ভালো যাচ্ছে না প্রতুলের। গালভরা নাম হলে কি হবে, পাড়ায় আর পার্টি অফিসে
তিনি পুঁটু’দা নামেই বিখ্যাত। কলেজ থেকেই যখন রাজনীতি করছেন, তখনই প্রথম দেওয়াল
লিখনে
নিজের
নাম দেখে চমকে উঠেছিলেন। পুঁটুদা’কে এই চিহ্নে ভোট দিন। “ট” এর টিকি’র ওপর থেকে
ধারালো কাস্তে উঁকি মারছে। সিনিয়র নেতাকে পুঁটু নামটা নিয়ে আপত্তি করতেই একসার
লাল দাঁত (পার্টির নয়, পানের রঙ) বার করে হাসলেন ভদ্রলোক-
-
আরে বাবা মানুষের কাছাকাছি থাকবে, বুঝলে পুঁটু?
-
হ্যাঁ, তা তো আছিই, কিন্তু প্রতুল নামটা দিলে ভালো হত না কি?
-
আরে বাবা, আচ্ছা বোকা ছেলে তো, ভুলে গেলে, আমাদের সর্বহারার মহান নেতা কমরেড কি
বলেছেন? বলেছেন, ওসব বাহারি নাম নিয়ে বুর্জোয়ারা মাতামাতি করে। উই আর দ্য কমন
পিপল... ইত্যাদি ইত্যাদি।
সর্বহারার
মহান নেতার নাম দিয়ে নিজের বেশ কিছু ডায়ালগ চালিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে সবার
জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে পাঁচিলের ওপর বসলেন ভদ্রলোক। দাম মিটিয়ে বাড়ি ফেরার
পথেও এই নাম নিয়ে প্রতুল চিন্তিত। চিন্তা ভাঙল বাপের প্রবল গালাগালি খেয়ে।
-
হারামজাদা ছেলে, সারাদিন শুধু টো টো কোম্পানি হয়ে ঘুরে বেড়ানো। তোমার ঠ্যাং
খোঁড়া করে ছাড়ব আমি।
দেশ উদ্ধার হচ্ছে, না? দাঁড়াও। কি হবে ওসব করে? নিজের নাম তো ডোবাবেই, সাথে
আমারটাও।
উফ্,
আবার সেই নাম নিয়ে খোঁটা। আচ্ছা মুশকিল তো। নাহ্, চুপচাপ থাকলে চলবে না।
লিফলেটে যেন অন্ততঃ প্রতুল নামটা থাকে, সেটা অবশ্যই দেখতে হবে।
লিফলেটে যেন অন্ততঃ প্রতুল নামটা থাকে, সেটা অবশ্যই দেখতে হবে।
সকালে
ঘুম থেকে উঠে উঠোনে বসে দাঁত মাজতে গিয়ে চোখে পড়ল দু’চারটে লাল কালিতে লেখা
লিফলেট ঝাঁট দিয়ে ফেলছে কাজের মাসি।
-
এই দাঁড়াও, কি হচ্ছে? এগুলো নির্বাচনী...
-
ওসব নিব্বাচুনি কথা ক’ইয়ো না দাদাবাবু, কত্তা ঠ্যাঙ্গাবেক। এই বেলা ঝাঁট দিয়ে
আপদ দূর কর।
নিরাশ
হয়ে কাগজ ক’টা কুড়িয়ে নেয় প্রতুল। এবং দেখে বেশ কিছু উঁচুমানের সাম্যবাদী
প্রতিজ্ঞা ও আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতির নীচে জ্বলজ্বল করছে নমস্কারান্তে “পুঁটু”। গা
জ্বলে ওঠে প্রতুলের। ক্লাবে গিয়ে জুনিয়রদের ওপর চেল্লায়
- এর
মধ্যেই ছাপা হয়ে গেল? আমাকে জানাসনি কেন আগে? বেয়াদব, ফাঁকিবাজের দল।
- আমরা
কি করব দাদা? পার্টি অফিস থেকে এল তো!
- তা
এলেই হল? সব ঠিকঠাক লেখা আছে কিনা দেখতে হবে না? অশিক্ষিত লোকজনে পার্টি ভরে গেল।
দাঁত
কিড়মিড় করতে করতে বেরিয়ে যায় প্রতুল। পেছন থেকে অস্পষ্ট খিস্তি শুনেও পেছনে
ফিরে তাকায় না আর। নিতাইদা’কে বলে লাভ নেই। প্রথমত মহান নেতা’র বিভিন্ন মন্তব্যের
পেটেন্ট নিয়ে রেখেছেন তিনি। কিছু বললেই বুঝিয়ে ছাড়েন যে আসলে প্রতুলেরই এই
বিষয়ে পড়াশোনার ঘাটতি থেকে গেছে। নাহলে এটাও শুনতে হবে যে আবার করে লিফলেট
ছাপাতে গেলে সর্বহারার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টান পড়বে, যা কিনা শুধু বুর্জোয়াদেরই
শোভা পায়। অতএব পুরসভার ভোটে এই নামটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।
তবে
বিরোধী দলের অবস্থা এই ওয়ার্ডে খুব খারাপ। জিতবে প্রতুলই, থুড়ি পুঁটু। রাস্তার
মোড়ে দূর থেকে বিমলা ঘোষকে আসতে দেখা যায়। গতবারের বিজয়িনী। বর্তমানে
কাউন্সিলর। তিনি ও তার পার্টি, দু'জনেই জানেন এবছর আর জিততে হচ্ছে না তাঁদের।
বিমলার গুণধর হাসব্যাণ্ড মাসছয়েক আগেই বিশাল আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে জেলে
গেছেন। পুরসভার একাধিক টেন্ডার নিয়ে তাতে টাকা নয়ছয় করার অপরাধে। বিমলাও কোর্ট
কেস প্রায় হারতে চলেছেন। আর নেহাতই কোন ক্যান্ডিডেট দাঁড় করাতে না পেরে ওঁর
পার্টি ওকে টিকিট দিয়েছে। তবে পাবলিকের হাতে হেনস্থা হওয়ার ভয়ে ভদ্রমহিলা
সবসময় দু’জন বখাটে কর্মীকে বডিগার্ড হিসেবে নিয়ে ঘোরেন।
ভদ্রতা
সবসময় আগে। পার্টির ক্লাসে শিখেছিল প্রতুল। ভালোমানুষের মত জিজ্ঞাসা করল
-
বিমলাদি, কোথায় যাচ্ছেন? সব ভালো তো?
উনি
কিছু বলার আগেই কর্মীপ্রবর দু’জনের মধ্যে একজন ফচকে হেসে বলল
-
আরে ভাই, দিদি বাজারে যাচ্ছে। আজ সবাইকে পুঁটি মাছের ঝোল খাওয়াতে চেয়েছে দিদি,
বুঝলে?
খ্যাঁক
খ্যাঁক করে হেসে দিদি ও ভাইয়েরা সামনের দিকে হাঁটা দেয়।
মুখ
চুন করে বাড়ি ফেরার পথে প্রতুল মনে মনে ভাবে, শালা, একবার জিতি, তোদের সবকটাকে
জেলে না ভরেছি তো আমার নাম... তার নাম? আচ্ছা, তার নাম কি সত্যিই প্রতুল?
বাড়ি
ফিরে দেখল বাবা মন দিয়ে রেডিও শুনছেন। কেন্দ্র সরকার চালের দাম আরো কমাবার আশ্বাস
দিয়েছে। বাবা খুব তৃপ্ত। মাকে বললেন
-
যাক বাঁচা যাবে, বুলির পড়ার খরচটাও তো বাড়ছে।
-
বাবা, ওসব ভাঁওতা, চালের দাম দু’পয়সা কমিয়ে তোমাদের বোকা বানাচ্ছে সরকার।
মুখখানা
রাগে বেগুনি হয়ে উঠলো বাবার। স্পষ্ট দেখল প্রতুল। কিন্তু না, বার্স্ট করলো নাতো।
হুঁকোতে দুটো টান মেরে শান্তভাবেই বলল
-
তা কি আর করব বাবা বল, বোকা বনে যাওয়া ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই। চীনের
চেয়ারম্যান তো আর আমাকে এসে খাইয়ে যাচ্ছে না, তোমাকেও না। দু’বেলা বাড়িতে বসে
এই বুড়ো বাপেরই অন্ন যখন ধ্বংস করতে হবে, তখন ওসব বারফট্টাই নিজের পকেটে রেখে যাও
বুলিকে ইস্কুল থেকে নিয়ে এসগে।
দেখেছো,
একে বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। সে কিনা বিশ্ব সাম্যবাদের সেনানী, সে যাবে
বুলিকে ইস্কুল থেকে আনতে! ফুঃ এই শালা বুর্জোয়া সমাজে...
-
কি হল, কথা কানে গেল না নাকি? না আজকাল পুঁটু ছাড়া অন্য কোন নামে বাবুর মন ওঠে না?
হাড়
হিম করা গর্জনে অতএব তক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হল বোনের স্কুলের পথে।
*****
যাক,
ভোট মিটেছে। বিমলার কোন চালই খাটে নি। বিশাল ভোটে এলাকার তরতাজা যুবক পুঁটু সামন্ত
জিতে গিয়েছে। পাড়ার একমাত্র বাইকটা চেপে লাল আবির মেখে ঘুরতে পুঁটুর মন্দ লাগছিল
না। তার ওপর দু’বছরের মধ্যে শহরের হাইস্কুলে চাকরীটা পেয়ে যাওয়ার পর থেকে বাবাও
একটু সমঝে কথা বলেন পুঁটুর সাথে। আর দু’বেলা পুঁটুদা পুঁটুদা শুনতে শুনতে নামটাও
বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার। আজকাল ভালোই লাগে।
এরপর
যা হয়। লাল টুকটুকে বউ ঘরে আনলেন মা। বুর্জোয়া স্ট্যাম্প লেগে যাওয়ার ঝুঁকির
কথা বারবার বললেও খাটটা, টিভিটা ‘উপহার’ হিসেবে নিতে কসুর করলেন না বাবা। পরপর
চারবার ভোটে জিতে যাওয়ার পর এখন দু’একটা মাস্তানও তার হয়ে পুষছে পার্টি। একে ওকে
ধমকটা দেওয়া, অমুকের হাজতবাস আটকানো এসব করতে পুঁটুদাই শেষ কথা। চুলে পাক ধরেছে
ভালোই। বাবা গেছেন তাও অনেকদিন হল, ছেলের বয়স এখন পঁচিশ। সেও সেই সেনানীর দলেই
নাম লিখিয়েছে।
বসে
নেই বিমলারাও। তার দাদার মেয়ে ছায়া নেমেছে মার্কেটে। তবে পিসির মত শতাব্দী
প্রাচীন রাজনৈতিক দলে নাম লেখায়নি। তাদেরই ভাঙ্গা অংশটায় চেপে বসেছে। কলকাতা
থেকে প্রতুলদের পার্টির নানা বিপর্যয়ের খবর আসছে মাঝে মাঝেই। বিশ্বসাম্যের মহান
সিংহাসনটির আয়ু ফুরিয়ে আসছে সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। গোদের ওপরে বিষফোঁড়া
হয়েছে ওই রুদ্রমূর্তি বিরোধী নেত্রীটি। তার উদ্বোধনের ঘটায় কান পাতা দায়। কিছুদিন
আগেই এই ছোট্ট শহরে কোচবিহার এক্সপ্রেসের স্টপেজ ঘোষণা করে বসলেন ভদ্রমহিলা। এই
নিয়ে একটা বিশাল অনুষ্ঠানও হয়ে গেল প্রস্তাবিত রেলস্টেশনের জায়গাতে। ছায়া তাকে
নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল বটে। প্রাচীন ইগোতে যাননি পুঁটু। বিশেষতঃ কার্ডের ওপরে ওই
“মাননীয় পুঁটু সামন্ত” লেখা দেখে রাগ সামলানো যাচ্ছিল না। আমার পার্টির লোকে না
হয় বলে। তা’বলে তুমি সেদিনের পুঁচকে ছুঁড়ি, তুমি আমায় অপমান করার সাহস পাও কোথা
থেকে? বিমলাদিই এসব শিখিয়েছে নিশ্চয়।
জানলা
দিয়ে দেখতে পান ছেলে অতুল বিড়ির শেষ টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলেই প্রায় দৌড় দিয়ে
বাড়ি ঢুকলো। ব্যাপার কি? বেলা একটার মধ্যেই তরতাজা ভাবী নেতা বাড়ি ঢুকে পড়লেন
যে? ও আচ্ছা, বৃষ্টি নামল জোরে, সেজন্যেই বাবু সটান ঘরে।
ভেবেছিলেন,
শিলান্যাসের পর কাজ তো আর এখুনি শুরু হচ্ছে না, বরং ফেলে রাখলেই তার লাভ। এটাকে
ইস্যু করে যদি এ যাত্রা ভোটটা পার হওয়া যায়। একবার স্টেশনের কাজ শুরু হয়ে গেলে
তার আর কোন চান্স নেই। বিশেষতঃ সেই নেত্রী সারাক্ষণ ছায়াকে পাশে নিয়ে ঘুরেছেন।
পাবলিককে হাত নেড়েছেন দু’জনে একসঙ্গে। স্টেশনের জন্য নেওয়া জমিটা একটু নিচু। এই
বর্ষাটা যদি ভালোমত জম্পেশ করে নামে, তাহলে আর চিন্তা নেই। স্টেশনের গুড়ে বালি।
শরীরটা আজ আর ভালো নেই। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে।
সকালে
উঠে দোতলা থেকে নীচে তাকিয়ে নেচে উঠল মনটা। গোটা উঠোন জলে থইথই করছে। তাহলে
বাদুড়ঝোলার মাঠের কি অবস্থা, সেটা মনশ্চক্ষে পরিষ্কার দেখতে পেলেন। আনন্দে এই
বয়সেও নাচতে ইচ্ছে করছে। পার্টি অফিসে এখন গৌরাঙ্গ থাকবে না? নিশ্চয় থাকবে। ওর
সাথে প্রচারের ব্যাপারটা নিয়ে একটু বসতে হবে। ব্যাটা কথাবার্তা বলার কায়দা জানে
ভাল। ফোনটা কানে নিতেই দরজায় দেখলেন রুদ্রমূর্তি স্ত্রী’কে। ওই বদমেজাজি বিরোধী
নেত্রীর মতই দেখাচ্ছিল তাকে। ঝঙ্কার দিয়ে উঠলেন সহধর্মিণী
-
বলি সারাদিন কানে ফোনটা নিয়ে বসে না থেকে ঘরবাড়ির অবস্থা দেখলেও তো পার।
-
কেন? কি হলটা কি? শুভকাজে বাধা পেয়ে ক্ষেপে ওঠেন প্রতুল।
-
বাড়ির ড্রেনটা যে তিনদিন ধরে আটকে গেছে, সে খবরটা কি টিভি নিউজে দেব?
মাথায়
বজ্রপাত হলেও বোধহয় এর থেকে কম ব্যথা পেতেন প্রতুল। উঠোনের জলটা তাহলে...
-
কি হল? কলকাতা থেকে লোক আসবে নাকি ড্রেন পরিষ্কার করতে?
-
অতুল কোথায়? হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করেন তিনি।
-
সে বাবু তো তোমার মতই দেশ উদ্ধার করে বেড়াচ্ছেন। মোবাইলে ফোন ধরার সময় কোথায়
তার? আর সারাদিন যেসব ছেলে ছোকরা পুঁটুদা পুঁটুদা করে বেড়ায়, তাদেরও তো দেখা পাই
না। কাজের বেলায় পুঁটু সামন্তের ঘরে লোক মেলে না, আর রাজ্যের ইনকিলাব জিন্দাবাদের
বেলায়...
স্ত্রীর
মুখঝামটা বিশেষ গায়ে লাগে না প্রতুলের। জানলা দিয়ে দেখতে পান সামনের ছোট্ট
পার্কটায় এতটুকুও জল জমেনি। পার্কটা তিনিই তৈরি করিয়েছিলেন একবছর আগে। এখনও কাজ
অল্প বাকি। তাহলে বাদুড়ঝোলার মাঠে সত্যি কি রেলস্টেশনটা...
এরপর
আশ্চর্যভাবে বৃষ্টি আর হলই না কদিন। সারা বাংলার চাষীভাইদের থেকেও বেশি কষ্ট পেলেন
প্রতুল। স্টেশনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। শেষ হতেও বেশিদিন লাগবে না। এর মধ্যেই
পুরসভার ভোট। আর তার সামনে ছায়া ঘোষ। ছায়া বাড়ি বয়ে এসে ঘটা করে প্রণাম করে
গেল একদিন। সঙ্গের ছেলেপিলেদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে কিছুদিন আগেও তিনি নিজেদের
অফিসে দেখেছেন। বেইমান সব। কিন্তু অতুল বেইমান নয়। হবে কি করে, তার রক্ত বলে কথা।
সে এখন পার্টির হোলটাইমার। উঠতি নেতা। একটু মাথাটা গরম বটে। এই যেমন সেদিন ছায়ার
পার্টি তাকে লিলিপুটু বলে সভায় সম্বোধন করেছে শুনেই ব্যাটা এমন ভাষায় কথা বলল যা
তিনি কখনোই বাপের সামনে বলতে পারতেন না।
বুধবার
বিক্রম ক্লাবের মাঠে তার একটা সভা করার কথা ছিল। শরীর খারাপ থাকায় যেতে
পারেননি। শুনলেন সেখানে নিজের লাইফের ফার্স্ট বক্তৃতা দিয়েছে অতুল। আরো
শুনলেন বারবার ছায়া ঘোষ কে “মায়ার দোষ” বলে প্রচুর হাততালিও কুড়িয়েছে সে। বোঝা
গেল, বক্তৃতার স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছে গৌরাঙ্গ।
আরেকদিন
ছায়ার বয়ফ্রেণ্ডকে মাঝরাস্তায় চড়চাপড় মারার দায়ে তারই বাড়ির সামনের
রাস্তায় পেশী ফুলিয়ে শাসিয়ে গেল ছায়ার ছায়াসঙ্গীরা। পরদিনই ওই কর্মীদের সাথে
ছায়ার সম্পর্ক নিয়ে একটা ছাপানো লিফলেট পড়ে থাকতে দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায়।
একখানা হাতে পেয়েছিলেন অতুল। পড়ে দেখলেন, দু’মিনিট ভাবলেন, আচ্ছা, পার্টি এদের
ক্লাস নেয় না আজকাল?
অতুল
এসব বিষয়ে বাপের পরামর্শ নেওয়া মোটেই পছন্দ করে না। সে গুটিকতক ছেলেপিলেকে
কোথায় কার পোস্টার ছিঁড়তে হবে তা নিয়ে একটা বিশেষ ক্লাস নিচ্ছিল অল্পবয়সীদের।
ঘাড় ঘুরিয়ে বলল
-
কিছু বলবে?
-
না, মানে বলছিলাম কি, ছায়া তো আমার চেয়ে অনেক ছোট, আর এই মুচমুচে লিফলেট লেখার
দায় তো শেষমেশ আমার ঘাড়েই পড়বে, তার চেয়ে বরং অন্যভাবে...
-
কি, অন্যভাবে পার্টিকে খোঁড়া করবে?
- মানে?
-
মানে নিজে যেভাবে আমার ঘাড়ের ওপর বসে বসে আছ, সেভাবেই পার্টিকেও বসিয়ে দেবে
তাইতো?
মানে
মানে ঘরে ফিরে আসেন প্রতুল, নাহ্, যুগ বদলেছে।
যুগ
যে বদলে গেছে, বোঝা গেল ক’দিনেই। ছায়া ঘোষের কাছে গোহারান হারলেন প্রতুল সামন্ত।
বদল খুব শিগ্গিরি ছোঁয়াচ লাগল কলকাতাতেও। অতুল এবং অতুলের পার্টি এখন সমান
বেকার। শরীরটা আরও খারাপ যাচ্ছে প্রতুলের। আরো খারাপ হল যেদিন শুনলেন বিমলাদি মারা
গেছেন। না, না, নিজের প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বীর শোকে নয়। তিনি যে ভয়টা পাচ্ছিলেন
সেটাই হল। বাড়ির সামনের রাস্তাটা খুব শিগগিরই বিমলা সরণীতে পরিণত হল। ওই
রাস্তাটার ওপর তার লোভ আজকের নয়। আর একটা মুশকিল হয়েছে। আজকাল পার্টি অফিসে বড়
একটা কেউ আসে না। যারা খুব বাচ্চা, মানে সদ্য স্কুল ছেড়েছে, তাদের কেউ কখনও কখনও
বিড়িতে টান দিতে আসে। কিন্তু সবাই আজকাল প্রতুলবাবু বলেই ডাকে। পুঁটুদা নামটা বোধহয়
উঠেই গেল। নাহ্ শরীরটা আর সত্যিই দিচ্ছে না... কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে।
ঘোরটা
যখন কাটল তখন বেশ ঝরঝরে লাগছে নিজেকে। খুব তাজা লাগছে। ব্যাপারটা কি! বাড়িভর্তি
লোকজনের সামনে নিজেকে শোয়ানো অবস্থায় দেখে ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়
প্রতুলের। তিনি নির্বিঘ্নে টেঁসে গেছেন। ও এসবও তাহলে হয়। মানে ‘ওপার’ সম্পর্কে
পার্টি যা বলেছিল তা পার্টির আরও অনেক গুলের মতই নির্জলা, শালা নিতাইকে একবার
খুঁজে পেলে হয়। কানের গোড়ায় এমন একটা...
অতুল
কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে, এত ভালোবাসত বাপকে! কোনদিন মনে হয়নি তো! বাইরে
বেরিয়ে দেখলেন। গৌরাঙ্গই সব ব্যবস্থা করছে। অতুল একবার বাগানে এল। পকেট থেকে
ছোট্ট বোতল বার করে ঢেলে নিল খানিকটা। ওহ্ চোখ লালের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে
তাহলে। ওই তো ছায়াও এসেছে দেখা যাচ্ছে।
স্মরণসভার
আগে অবধি বেশ মজায় কাটল প্রতুলের। কতজন এল গেল, সবাই জানাল প্রতুলকে তারা কতটা
ভালবাসত। এই যেমন অনীশবাবু। নিজে টিকিট পাননি বলে ক্যাডারদের একটা বড় অংশকে
ছায়ার জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনিও এসে নিজের শ্রদ্ধার কথা জানাতে গিয়ে কেঁদেই
ফেললেন। বাহ্, এরা এভাবে নিজের প্রতিভা নষ্ট করে কেন? পার্টির নাট্যগোষ্ঠীতে ভালো
অভিনেতার অভাব। সেখানেও তো নাম লেখালে পারে। অতুল নেহাত মন্দ নেই। এর তার কাছ থেকে
এক আধ ঢোঁক মেরে, বিড়ি সিগারেট খেয়ে দিন খারাপ কাটছিল না তার। স্মরণসভার আয়োজন
হল সামনের পার্কে। সন্ধ্যাবেলা প্রচুর লোকের ভিড়। তার দু’দিন আগে থেকে ছায়া বেশ
কয়েকবার এসে অতুলের সাথে শলা পরামর্শ করে গেছে। স্মরণসভাটা একরকম হাইজ্যাকই করেছে
বলতে গেলে। যাক, পাঁচিলে বসে নিজের স্মরণসভা শুনতে মন্দ লাগছিল না প্রতুলের। সবাই
অনেক ভালো ভালো কথা বললেন। এক এক সময় প্রতুলেরও সন্দেহ হচ্ছে, কই এত ভাল ছিলেন না
তো তিনি! সভার শেষে গম্ভীর মুখে ছায়া এগিয়ে এল। ফিতে টানল। তুমুল হাততালির মাঝে
জ্বলজ্বল করে উঠলো শ্বেতপাথরের ফলকটা।
“পুঁটু কানন”জন্মঃ ১৮ই ভাদ্র, ১৩৫৩ মৃত্যুঃ ৩রা কার্ত্তিক, ১৪২০উদবোধকঃ শ্রীমতী ছায়া ঘোষমাননীয়া পৌরমাতা, বাদুড়ঝোলা পুরসভা।